ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মহারাসলীলা উৎসব

বর্ণাঢ্য আয়োজন- জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ভক্ত পর্যটকের ভিড়

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

বর্ণাঢ্য আয়োজন- জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ভক্ত পর্যটকের ভিড়

সৈয়দ হুমায়েদ শাহীন ॥ কার্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, আনন্দ-উল্লাস, ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়ে পালিত হলো মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে জোড়াম-পে সোমবার দুপুর থেকে শুরু হয়ে মঙ্গলবার ঊষা লগ্নে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়াম-পে ১৭৪তম ‘মহারাসলীলা উৎসব’ এবং আদমপুর তেতইগাঁও উন্মুক্ত মঞ্চে ৩১তম রাসোৎসব উদযাপিত হয়। মণিপুরী সম্প্রদায়ের এ বৃহত্তম উৎসব উপলক্ষে উভয়স্থানে বসেছিল রকমারি আয়োজনের বিশাল মেলা। রাসোৎসবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দসহ দেশী-বিদেশী পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত হয়েছিল কমলগঞ্জের দুটি এলাকার মণিপুরী অঞ্চলগুলো। মাধবপুর ও আদমপুরের উন্মুক্ত মঞ্চে সোমবার বেলা ১১টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় রাখাল নৃত্য। রাখাল নৃত্যের বিভিন্ন ধাপে রাধাকৃষ্ণের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনকালের বিভিন্ন চিত্র ফুটে উঠে। নিজস্ব পোশাকে সজ্জিত হয়ে মণিপুরী তরুণ-তরুণীরা এতে অংশ নেন। সন্ধ্যায় গুণীজন সংবর্ধনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এরপর রাত ১২টা থেকে শুরু হয় মণিপুরী নৃত্যের ধ্রুপদ ভঙ্গিমায় রাধাকৃষ্ণের রাসনৃত্য। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শৈশব এবং শ্রীমতি রাধিকার প্রেম কাহিনী নিয়ে রাসোৎসবের আয়োজন করা হয়। মণিপুরী গৌরবময় ঐতিহ্যের শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুকরণ উপলক্ষে মণিপুরী সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক পূণ্যস্থান হিসেবে বিবেচিত কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে রাসোৎসবের জন্য তৈরি ম-পগুলো সোমবার একটি রাতের জন্য হয়ে উঠছে হাজার হাজার মানুষের মিলনকেন্দ্র। মাধবপুরের শিববাড়ি থেকে শুরু করে গ্রামের তিনটি ম-পসহ পুরো এলাকা সেজেছে বর্ণিল সাজে। সাদা কাগজের ও সাদা কর্কসিটে নক্সায় সজ্জিত ম-পগুলোতে মণিপুরী নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুণ নৃত্যের তালে তালে মন মাতিয়ে দেয় উপস্থিত অতিথিদের। রাসলীলা উপলক্ষে আয়োজিত মেলায় খৈ, মুড়ি, বাতাসা, ছোটদের বিভিন্ন ধরনের খেলনা, মণিপুরী পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘর সাজানোর বিভিন্ন উপকরণ ও প্রসাধনী, শ্রীকৃষ্ণের ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির ছবিসহ ঐতিহ্যবাহী তাঁতের তৈরি চাদর, শাড়ি ও অন্যান্য কাপড়সহ কৃষি সরঞ্জাম, মাটির তৈরি সামগ্রী, ঘর সাজানোর সামগ্রীসহ লোক জীবনের সঙ্গে যুক্ত নানা দ্রব্য সাজিয়ে বসেছিল দোকানিরা। এছাড়া মাধবপুর ললিতকলা একাডেমির সামনে বসেছে মণিপুরী সম্প্রদায়ের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে বইপত্রের কয়েকটি স্টল। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব পেশার মানুষের মিলনমেলা ঘটেছে এ রাসোৎসবে। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৭৭৯ সালে মণিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্ন দৃষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রর্বতন করেছিলেন তাই রাসোৎসব। ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী রাজাদের বেশরিভাগই ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী এবং তারা নিজেরাও রাসনৃত্যে অংশগ্রহণ করতেন। ফলে মণিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যে এ কৃষ্টির ধারাবাহিকতায় কোন ছেদ পড়েনি। অতীতের সেই ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই কোন রূপ বিকৃতি ছাড়াই কমলগঞ্জে উদযাপিত হয়ে আসছে মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলা। আলাপকালে সংস্কৃতিকর্মীরা বলেন, বংশ পরম্পরায় নান্দনিকতার পূজারী মণিপুরীদের মেলবন্ধন এই রাসোৎসব। এটি এখন জাতিধর্ম নির্বিশেষে সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। এটি সিলেট বিভাগের মধ্যে ব্যতিক্রমী আয়োজন। এখানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের আগমন ঘটে। বর্ণময় শিল্প সমৃদ্ধ বিশ্বনন্দিত মণিপুরী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী রাসোৎসবে সবার মহামিলন ঘটেছিল। বাংলাদেশ মণিপুরী সমাজ কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক জানান, এখানে সব ধরনের সুবিধা বিদ্যমান থাকায় এটি উৎসবে রূপ নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উৎসবে যোগ দিতে হাজার হাজার ভক্ত অনুরাগী উৎসবে এসেছেন। বান্দরবান ॥ বান্দরবান থেকে এস বাসু দাশ জানান, পার্শ¦বর্তী চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়ায় বৈদ্যনাথ শিববাড়ি প্রাঙ্গণে বাজালিয়া সার্বজনীন রাস মহোৎসব উদযাপন পরিষদের আয়োজনে এখানে সার্বজনীন শ্রী শ্রী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে গত রবিবার সকালে রাসযাত্রা ও প্রতিমা প্রদর্শিত হয় এবং সোমবার সকাল দশটা থেকে বাজালিয়া ইসকন জগন্নাথ মন্দিরের পরিচালনায় শুরু হয় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ ও ধর্মীয় আলোচনা। বিকেল চারটার দিকে চট্টগ্রাম বেতারের শিল্পীদের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয় মনোরম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এরপর শুরু হয় মহতী ধর্মসভা। এ সময় ধর্মসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সিআইপি সভাপতি এমএ মোতালেব। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাতকানিয়া হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ঐক্যপরিষদের যুগ্ম সম্পাদক আশুতোষ চক্রবর্তী। ১৩নং বাজালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাপস কান্তি দত্তের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন করেন রাস মহোৎসব ও দুর্গাবাড়ি উন্নয়ন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অমল দত্ত। এ সময় প্রধান বক্তা ছিলেন সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কুতুব উদ্দিন চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন এ্যাডভোকেট রামপদ কায়স্তগির, অমল গুহ, বাবুল কান্তি দাশ, উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সালাউদ্দিন শাহরিয়ার, বাজালিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিক আহমদ চৌধুরী প্রমুখ। ধর্মসভায় বক্তারা সনাতনী সম্প্রদায়ের উপর গুপ্ত হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগসহ জুলুম ও অত্যাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি আবেদন জানান। আজ ১৬ নবেম্বর ষোড়শ প্রহরব্যাপী মহা নামযজ্ঞ, অহোরাত্র নাম সংকীর্র্তন ও আনন্দবাজারে মহাপ্রসাদ আস্বাদন এবং বৃহস্পতিবার ঊষালগ্নে নগরকীর্তন ও মহানামযজ্ঞের পূর্ণাহুতির মধ্য দিয়ে এই রাস মহোৎসবের সফল সমাপ্তি হবে।
×