ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নাগরিক বিড়ম্বনা

নগরীর নতুন লজ্জা এখন পোস্টার

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

নগরীর নতুন লজ্জা এখন পোস্টার

আরাফাত মুন্না ॥ পোস্টার এক সময় ছিল প্রতিবাদের এক বারুদস্তূপ। গভীর রাতে লাগানো পোস্টারে দিনের আলোয় জানিয়ে দিত তরুণের রক্ত। সেসব দিন এখন ইতিহাস। এখন ঢাকার নতুন যন্ত্রণা যেন এ পোস্টার। যেমন যানজটের সমস্যা দূর করতে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গড়ে তোলা হচ্ছে ফ্লাইওভার। কোন কোনটি যান চলাচলের জন্য আংশিক খুলে দেয়া হয়েছে। কয়েকটির পূর্ণ সুবিধা ভোগ করছেন নাগরিকরা। যানজটের সমস্যা দূর করার পাশাপাশি এ ফ্লাইওভারগুলো নগরীর সৌন্দর্যও বর্ধন করবে- এমনটাই কথা ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফ্লাইওভারগুলোও দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে কাজের কাজ কি আসলে হয়েছে? মোটেও না। বরং সৌন্দর্য আরও নষ্ট হয়েছে। নির্মাণাধীন বা পূর্ণ নির্মিত কোন ফ্লাইওভারের পিলারই রক্ষা পায়নি পোস্টার থেকে। ফ্লাইওভারগুলোর প্রতিটি পিলারজুড়েই সাঁটানো হয়েছে রংবেরঙের পোস্টার। এমন যত্রতত্র পোস্টারিংয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের পরিবর্তে বরং সৌন্দর্যহানিই হয়েছে। কোথাও তো আবার ফ্লাইওভারের নিচের খালি জায়গায় ঘর তুলে সংসারও পেতেছেন অনেকে। এসব কারণে রাজধানীর নাগরিকরা যেন নতুন এক বিড়ম্বনার মুখে পড়ছেন প্রতিনিয়ত। ফ্লাইওভারসহ রাজধানীর বিভিন্ন দেয়ালে যেসব পোস্টার সাঁটানো থাকে তার অনেকগুলোতে তাকানোও যায় না বলে জানান পথচারীরা। প্রকৌশলী কিংবা অমুক বিষয়ে অভিজ্ঞ হতে চান ‘তাহলে যোগাযোগ করতে হবে উল্লিখিত কোচিং বা শিক্ষকের সঙ্গে, ...সমস্যা থাকলে যোগাযোগ করুন ওমুক হারবাল চিকিৎসালয়ে।’ ফ্লাইওভার, কলেজ, মার্কেট এমনকি সরু গলির দেয়ালে এভাবেই লেখা রয়েছে বড় বড় শত শত পোস্টার, সঙ্গে রয়েছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিং, সুন্দর হাতের লেখা আর অমনোযোগী শিক্ষার্থীদের গ্যারান্টিসহ ভাল রেজাল্ট করে দেয়াসহ নানা বিষয়ের পোস্টার, দেয়াল লিখন। পুুরো ঢাকা শহরে এমন কোন জায়গা নেই, যেখানে কোন পোস্টার বা দেয়াল লিখন নেই। যার অধিকাংশ দেয়াল লিখনের উদ্দেশ্য হলো প্রচার। বিভিন্ন ব্যক্তি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এগুলো বেশি করে থাকে। সুপ্রীমকোর্টের দেয়াল ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবনের মতো জায়গাও রক্ষা পায়নি পোস্টারের হাত থেকে। রাজধানীর নিউ ইস্কাটন থেকে কেউ যদি মগবাজার যেতে চায় তাহলে ফ্লাইওভারের (মগবাজার-মালিবাগ) পিলারজুড়ে চোখে পড়বে নানা ধরনের পোস্টার। রাজনৈতিক দলের নেতাদের পোস্টার, কোচিং সেন্টার, হারবাল চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে শুরু করে সিনেমা বিজ্ঞাপনের পোস্টার পর্যন্ত সবই দেখতে হবে। শুধু মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারই নয়, রাজধানীর কোন ফ্লাইওভারের পিলারই পোস্টারমুক্ত নয়। ফ্লাইওভার ছাড়াও ব্যক্তি মালিকানাধীন বাড়ি, ছোট-বড় শপিংমলসহ রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো রয়েছে রংবেরঙের চটকদার পোস্টার। দেয়ালগুলোতে যত্রতত্রভাবে পোস্টার সাঁটানোর ফলে নগরীর সৌন্দর্য ও পরিচ্ছন্নতা দুটোই নষ্ট হচ্ছে। সরেজমিন রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় দেয়াল লিখন ও পোস্টার সাঁটানোর বিষয়টি অসংখ্য দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলো পোস্টারের দাপটে মলিন হয়ে গেছে। বিভিন্ন কোচিং সেন্টার, অমুক দল, লীগের অভিনন্দন জ্ঞাপন আর মিডিয়ার কল্যাণে প্রতিভা খোঁজার প্রতিযোগিতার প্রতিযোগীদের জন্য ভোট চেয়ে পোস্টারের বন্যা। এমন অসংখ্য নামী-বেনামী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পোস্টারে ভরে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলো। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দেয়ালে রয়েছে কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন। যাত্রীছাউনিগুলোও রক্ষা পাচ্ছে না পোস্টারের কবল থেকে। রমনা থানার দেয়াল পুরোটাই পোস্টারে ঢেকে দেয়া হয়েছে। যেসব জায়গায় পোস্টার লাগানো নিষেধ করে দেয়া আছে যেসব জায়গায় দেয়ালে না পারলেও আশপাশে থাকা গাছ এবং বৈদ্যুতিক তারের খুঁটিতে পোস্টার সেঁটে দেয়া হয়েছে। বাসসহ অন্যান্য যানবাহনের চিত্র আরও বেশি নাজুক। এর মধ্যেই হাজারও ওষুধের বিজ্ঞাপনে প্রায়ই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। ঢাকা শহরের অপরিচ্ছন্নতার পেছনে অনেক বড় একটা অংশজুড়ে আছে এ দেয়াল লিখন আর পোস্টার। ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সায়মা আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, সকল জায়গায় দেয়াল লিখন আর পোস্টার সাঁটা। চোখ মেললে শুধুই পোস্টার আর পোস্টার, বিব্রতকর পোস্টারও চোখে পড়ে। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন। পুরো ঢাকা শহর ছেয়ে গেছে পোস্টারে। কোন কোন জায়গায় দেয়ালের রংটুকু চেনারও সাধ্য নেই বলেও মন্তব্য এই শিক্ষার্থীর। রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাব, পুরানা পল্টন মোড়, নয়াপল্টন, গুলিস্তান, জিরো পয়েন্ট, মতিঝিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বুয়েট ক্যাম্পাস, পুরান ঢাকা, মালিবাগ মোড়, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ী, ফার্মগেট, নিউমার্কেট, মিরপুর গোলচত্বর, ১ ও ১০ নম্বর, চিড়িয়াখানা ও শাহবাগ এলাকার কোন জায়গ দেয়াল লিখন ও পোস্টার ছাড়া নেই। একপক্ষের লেখা মুছে অন্যপক্ষের লেখা, এক পোস্টারের ওপর আরেক পোস্টার সাঁটানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা বেশ চোখে পড়ার মতো। সরকারী ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারী ও ব্যক্তি মালিকানাধীন দেয়াল- বাদ নেই কোনটি। ব্যানারে ছেয়ে আছে ব্যস্ত রাজপথের সবগুলো মোড়। গাছের কা- ও শাখায় পেরেক ঠুকে সেঁটে দেয়া হয়েছে লোহা ও টিনের সাইনবোর্ড। ডালে ডালে টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে ব্যানার। এ ধরনের নানা ছল-চাতুরির রংবেরঙের পোস্টার শুধু দেয়ালে, বাড়িতে, ব্রিজ-কালভার্টেই নয়; দখল করে আছে বিদ্যুত ও টেলিফোনের খুঁটিগুলো। পিছিয়ে নেই উরস মোবারক, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠানও। মহানগরীতে প্রত্যেকটি সড়কেই বিউটি পার্লার, জিমনেসিয়াম রয়েছে। সময়ের চাহিদা মেটাতেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নিজেদের প্রচার চালাতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান নানা ধরনের লিফলেট বিলি করে থাকে। এমনকি তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনেও কুরুচিপূর্ণ সাইনবোর্ড লাগিয়ে রাখে। রাতের বেলা নগরজুড়ে চলে ডিজিটাল সাইন ও নিয়ন সাইনের প্রতিযোগিতা। কারটা কত বড় আর বেশি রঙের আলো ছড়ায় সে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে পুরো নগরী। রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ফ্লাইওভারের (মগবাজার-মালিবাগ) দেয়ালে এমন সব পোস্টার লাগানো থাকে, ওদিকে তাকানোও যায় না। তিনি বলেন, আমার মেয়ে মগবাজারের ইস্পাহানী বালিকা বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে, ওকে নিয়ে সকালে স্কুলে যাই। একদিন একটি হারবাল চিকিসা কেন্দ্রের বিজ্ঞাপন দেখে আমাকে প্রশ্ন করে বসল, বাবা হয়ে আমি ওর ওই প্রশ্নের কী জবাব দেব- প্রশ্ন রফিকুলের। নগরীর সৌন্দর্য রক্ষায় সিটি কর্পোরেশনকে দ্রুত এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে বলে দাবি করেন রফিকুল। আইন থাকলেও কার্যকারিতা নেই ॥ আইন থাকলেও কার্যকারিতা নেই দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণ আইনের। আইন পাস হওয়ার পর চার বছর পেরিয়ে গেলেও একবারের জন্যও প্রয়োগ হয়নি আইনটি। ফলে দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানোর মাধ্যমে নগরীর সৌন্দর্য বিনষ্টের প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নগরীর সৌন্দর্য রক্ষা ও পরিচ্ছন্নতা বিধানে সরকার ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১২’ পাস করে। কিন্তু কোন কার্যকারিতা না থাকায় এ আইন শুধু কাগজবন্দী হয়েই পড়ে আছে। দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১২-এর ৩ ধারায় বলা আছে, ‘ধারা ৪ অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোন স্থানে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে না।’ কিন্তু কে শোনে এ কথা? এখন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানোর হিড়িক পড়ে গেছে। এ আইনের ৯ নম্বর ধারা (বিশেষ বিধান) অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন কর্তৃক পরিচালিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে প্রচার সংক্রান্ত দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে। এ আইনে দেয়াল লিখন বলতে বোঝানো হয়েছে যে, কোন উদ্দেশ্যে, যে কোন রঙের কালি বা চুন বা কেমিক্যাল দ্বারা দেয়াল বা যানবাহনে কোন লিখন, মুদ্রণ, ছাপচিত্র বা চিত্রাঙ্কন করা। আর কাগজ, কাপড়, রেক্সিন বা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমসহ যে কোন মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত প্রচারপত্র, প্রচারচিত্র, বিজ্ঞাপনপত্র, বিজ্ঞাপনচিত্র এবং যে কোন ধরনের ব্যানার ও বিলবোর্ড পোস্টারের অন্তর্ভুক্ত। এ আইন অমান্যের জন্য ধারা ৬ অনুযায়ী অন্যূন ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা এবং অনূর্ধ ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদ- আরোপ, অনাদায়ে অনধিক ১৫ (পনেরো) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদ-ের বিধান আছে। ধারা ৫ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিজ খরচে দেয়াল লিখন বা ক্ষেত্রমতে পোস্টার মুছে ফেলা কিংবা অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে এ আইনটি কোন কাজেই আসছে না। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অহরহ দেখা যাচ্ছে পোস্টার, ব্যানার আর দেয়াল লিখনে ছেয়ে আছে রাস্তার পার্শ্ববর্তী দেয়ালগুলো। সরকারী ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালত ভবন, বেসরকারী ও ব্যক্তিমালিকানাধীন দেয়ালও বাদ পড়েনি।
×