ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসা করাতে গিয়ে বিপাকে রোগী ও স্বজনরা

ভারতীয় রুপী নিয়ে চরম ভোগান্তিতে বাংলাদেশীরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

ভারতীয় রুপী নিয়ে চরম ভোগান্তিতে বাংলাদেশীরা

রহিম শেখ ॥ ভারতের নিষিদ্ধ ৫০০ ও ১০০০ রুপীর নোট নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন বাংলাদেশীরা। বিশেষ করে কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে যারা চিকিৎসা করাতে গেছেন তাদের রোগী ও স্বজনরা ৫০০ ও ১০০০ রুপীর নোট নিয়ে জটিল সমস্যায় পড়েছেন। এদিকে নতুন করে ভারত ভ্রমণে বাংলাদেশীদের আগ্রহ কমছে অনেকাংশে। এরই মধ্যে বিভিন্ন পরিবহনের টিকেট বুকিং বাতিল করছেন অনেকে। এদিকে বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায় ভারতীয় নোট নিয়ে বিপাকে পড়েছেন অনেকেই। কেউ কেউ দালালদের কাছে অর্ধেক দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন ভারতের রুপী। মূলত মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানে রুপী লেনদেন বন্ধ করে দেয়ায় সুযোগ নিচ্ছে দালালরা। এই অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ভারতের সিদ্ধান্তে যারা ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তাদের জন্য আপাতত কিছুই করার নেই। অন্যদিকে ভারতে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলকে কেন্দ্র করে খুচরা নোট সঙ্কটে স্থানীয় বাজার থেকে পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে দেশটির রফতানিকারকরা। ফলে সাময়িকভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য রফতানিতে কিছুটা ধীরগতি নেমে এসেছে। জানা গেছে, ভারতে কালো টাকার আগ্রাসন ঠেকাতে গত ৮ নবেম্বর থেকে সেদেশের ৫০০ ও ১০০০ রুপীর নোট বাতিল করা হয়। ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন দেশটিতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকরা। ভারতের একাধিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, কলকাতার কয়েকটি হাসপাতাল বাংলাদেশ থেকে আসা অসহায় রোগী ও তাদের বাড়ির লোকজনের কথা ভেবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অচল নোট জমা নিয়েছিল। সে ক্ষেত্রে যিনি জমা করেছিলেন, তার সচিত্র পরিচয়পত্রের অনুলিপি দিতে এবং নিজের বিস্তারিত বিবরণ ও জমা করা নোটগুলোর নম্বর উল্লেখ করে একটি ফর্ম পূরণ করতে হয়েছিল। শুক্রবার থেকে সে সুযোগও বন্ধ রয়েছে। এখন বাংলাদেশী নাগরিকের কাছ থেকে কেবল ডলার চাইছে হাসপাতালগুলো। যদিও পাঁচশো ও হাজারের নোট বাতিলের ঘোষণা হওয়ার দু’দিন পর কলকাতায় বাংলাদেশের উপ-দূতাবাস থেকে লিখিতভাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও রাজ্য সরকারকে একটি চিঠি দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে বহু রোগী কলকাতায় এখন চিকিৎসা করাতে এসেছেন। নোট নিয়ে এই সমস্যার জেরে তাদের চিকিৎসার যেন সমস্যা না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অনুরোধ করেছে কলকাতায় বাংলাদেশের উপ-দূতাবাস। কিন্তু সেটা কিভাবে ও কি পদ্ধতিতে সম্ভব, উপ-দূতাবাসের উদ্বেগ প্রকাশ করে লেখা ওই চিঠিতে তার কোন প্রস্তাবনা নেই বলে জানা গেছে। এছাড়া ভারতে ৫০০ ও ১ হাজার রুপীর নোট বাতিলের কারণে বিপাকে পড়েছেন ভারতে বিভিন্ন কাজে ভ্রমণরত বাংলাদেশীরা। এ অবস্থায় নতুন করে ভারত ভ্রমণে বাংলাদেশীদের আগ্রহ কমছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন পরিবহনের টিকিট বুকিং বাতিল করছেন অনেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টিকিট বাতিলের কারণে মঙ্গলবার চট্টগ্রাম থেকে শ্যামলী, সোহাগ ও গ্রীনলাইনের বেশ কয়েকটি বাস সার্ভিস বাতিলও করা হয়েছে। আশানুরূপ যাত্রী না থাকায় আগামী কয়েক দিনের সার্ভিস চালানো হবে কিনা, সে বিষয়েও নিশ্চিত কিছু বলতে পারছেন না। এছাড়া রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি বাস সার্ভিস, উড়োজাহাজের টিকেটের এজেন্ট ও ট্রাভেলসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, ৫০০ ও ১ হাজার রুপীর নোট নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয়ার পর বিভিন্ন পরিবহন প্রতিষ্ঠানে ভারতে যেতে ইচ্ছুক যাত্রীর সংখ্যা কমে গেছে। এরই মধ্যে সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের ভোগান্তির খবর ছড়িয়ে পড়ায় ভারতে গমনেচ্ছুরা শঙ্কায় পড়েছেন। খুবই প্রয়োজন ছাড়া আপাতত কেউ ভারতে যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না। যেসব যাত্রী চিকিৎসা কিংবা ব্যবসায়িক কাজে আগাম ভারতীয় মুদ্রা সংগ্রহ করে রেখেছিলেন, তারাই সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন। মানি এক্সচেঞ্জ কিংবা কার্ব মার্কেটে ভারতীয় বড় দুই নোটের লেনদেন আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছোট নোট সংগ্রহ করতে না পারলে ভারতে যাওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন তারা। মঙ্গলবার মতিঝিলের কয়েকটি মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, ৫০০ ও ১০০০ রুপীর নোট নিয়ে অনেকেই আসছেন। কিন্তু মানিচেঞ্জার থেকে তা কিনতে অপারগতা প্রকাশ করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে আমিনুল ইসলাম এসেছেন মতিঝিলে ৫০০ রুপীর ৭০টি নোট নিয়ে। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, বেশ কয়েকটি মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান ঘুরেছেন। কোন প্রতিষ্ঠানই কিনতে রাজি হয়নি। তবে রাস্তায় কয়েকজন দালাল কিনতে চেয়েছে। কিন্তু দাম অর্ধেকেরও কম বলে। নিরুপায় হয়ে প্রতি রুপী ৭০ পয়সা দরে তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি জানান, তার নিজের চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ডলারের পাশাপাশি তিনি ৩৫ হাজার ভারতীয় রুপী কিনেছিলেন, সবগুলো ৫০০ রুপীর নোট। তিনি জানান, ৩৫ হাজার রুপী কিনতে তিনি ব্যয় করেছিলেন ৪২ হাজার টাকা। এবার সাড়ে ১৭ হাজার টাকা লোকসান দিয়ে ৪২ হাজার টাকার রুপী বিক্রি করেছেন সাড়ে ২৪ হাজার টাকায়। আমিনুলের মতো অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে অর্ধেক দামে দালালদের কাছে ভারতের রুপী বিক্রি করে দিচ্ছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোন দিকনির্দেশনাও নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় ৫০০ ও ১০০০ রুপীর নোট মজুদ রয়েছে। এসব নোটের বড় অংশই অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে আসা। ভারত ভ্রমণকারী, ব্যবসায়ী কিংবা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কাছে মজুদ থাকা এসব নোট এখন তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি নিবন্ধিত মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোও অবৈধ পন্থায় মজুদ করা ভারতীয় রুপী নিয়ে পড়েছে আর্থিক ঝুঁকিতে। একইভাবে ১০০০ রুপী ও ৫০০ রুপীর নোট বহনের কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যর্থ হচ্ছেন ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা। একটি মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, ভারত সরকার ৫০০ ও ১০০০ রুপীর নোট বাতিল করলেও তাদের দেশের নাগরিকদের তা ব্যাংকে জমা দেয়ার জন্য ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে। প্রতি সপ্তাহে একজন নাগরিক সর্বোচ্চ ২০ হাজার রুপী জমা দিতে পারছে। তিনি জানান, মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে প্রচুর ভারতের রুপী রয়েছে। আমরাই এখন বেকায়দায় আছি। ভারতের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশনা আসে কি না সে অপেক্ষায় আছি। এ মুহূর্তে আমরা তো কিনতে পারি না। তিনি জানান, এ সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে একটি দালাল চক্র। তারা অর্ধেক দামে এমনকি তারও কম দামে সাধারণের কাছ থেকে ভারতের রুপী কিনে নিচ্ছে। এসব নিষিদ্ধ রুপী কিনে দালালরা কী করে এ বিষয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক জানান, তিনি শুনেছেন, অর্ধেক দামে কিনে তা ওরা ভারতে পাচার করে দিচ্ছে। যেহেতু ভারতের নাগরিকেরা ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাতিল নোট ব্যাংকে বদলাতে পারছে, একটি চক্র বাংলাদেশ থেকে কম দামে ভারতের রুপী কিনে ভারতে অপর চক্রের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে দিচ্ছে। মাঝখানে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন সাধারণ বাংলাদেশীরা। মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, ভারতে ভ্রমণে যান এমন বাংলাদেশীর বেশিরভাগই চিকিৎসার জন্য যান। এক পরিসংখ্যান মতে, প্রতিবছর ১২ থেকে ১৩ লাখ বাংলাদেশী ভারতে চিকিৎসার জন্য ভ্রমণ করেন। তাদের কাছে ভারতের রুপী থাকে। অনেকে প্রতিমাসেই ভারতে চিকিৎসার জন্য যান। এ কারণে তাদের কাছে ভারতের কিছু রুপী থাকে। হঠাৎ ভারত সরকার ৫০০ ও ১০০০ রুপীর নোট নিষিদ্ধ করায় ওই সব বাংলাদেশী এখন বেকায়দায় পড়েছেন। মঙ্গলবার আবু আব্দুল্লাহ নামে এক ব্যক্তি জানান, প্রতিমাসেই তার ভাবি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। তার কাছে ১০ হাজার রুপী আছে। হঠাৎ নিষিদ্ধ করায় তিনি এসব রুপী নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন। চট্টগ্রাম থেকে তার ভাবি তাকে রুপীগুলো বিনিময় করতে ফোন করেছেন। কিন্তু কোথায় গেলে তিনি রুপীগুলো বিনিময় করতে পারবেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না। এছাড়া দেশীয় মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও বিপুল পরিমাণ ভারতীয় মুদ্রা আটকে গেছে। এর বাইরে ঢাকা, চট্টগ্রাম যশোর ও খুলনা অঞ্চলের একশ্রেণীর ব্যবসায়ী আছেন, যাদের কাছে বিপুল পরিমাণ ৫০০ ও ১০০০ রুপীর নোট রয়েছে। এসব ব্যবসায়ী কমিশনের বিনিময়ে মুদ্রা কেনাবেচা করতেন এবং অবৈধভাবে পণ্য আমদানি-রফতানির লেনদেন কমিশনের বিনিময়ে পরিশোধ করতেন। ৫০০ ও ১০০০ রুপীর নোট বন্ধ হওয়ায় তারাও চরম বিপাকে পড়েছেন। বিপাকে পড়েছেন হিলি স্থলবন্দরের ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ীরাও। হিলি স্থলবন্দর দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ১৫০-২০০ ট্রাক ভারত থেকে পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে আসে। আর এসব ট্রাকচালক হিলি স্থলবন্দরে রাতযাপন করেন। এর সুবাদে তারা হিলি বাজারে চাল, ডাল, মাছ, মাংস থেকে বিভিন্ন ধরনের বাজার করে থাকেন, যা ভারতীয় রুপীর মাধ্যমে লেনদেন করেন। মানিচেঞ্জার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম জামান জনকণ্ঠকে জানান, তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কয়েক দফা অলোচনা করেছেন। তারা শুধু পর্যবেক্ষণ করছে বলে তাদের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তিনি জানান, তারা আরও দুই দিন দেখবেন। বুধবার তারা এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে লিখিতভাবে জানাবেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, ভারতীয় ৫০০ ও ১০০০ রুপীর নোট যাদের কাছে আছে, তাদের জন্য আপাতত কিছুই করার নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের।
×