ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সভায় মতপ্রকাশ করা হয়েছে, ওসি সতর্ক হলে এ ঘটনা ঘটত না

নাসিরনগর নিয়ে ক্ষুব্ধ মন্ত্রিসভার আইনশৃঙ্খলা কমিটি

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

নাসিরনগর নিয়ে ক্ষুব্ধ মন্ত্রিসভার আইনশৃঙ্খলা কমিটি

তপন বিশ্বাস ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাসিরনগরের ঘটনায় ওসি ও ইউএনওর কর্মকা-ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। সভায় বলা হয়, ওসি সতর্ক থাকলে এ ঘটনা হয়ত ঘটত না। পাশাপাশি ওই সময় জনসভা করতে দেয়া ঠিক হয়নি। এ ঘটনায় প্রকৃত অপরাধী খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে মঙ্গলবার আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এই নির্দেশ দেয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি আমির হোসেন আমু বলেন, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করেছি। দেশ এখন সম্পূর্ণ স্থিতিশীল। তিনি বলেন, গাইবান্ধায় ভূমিদস্যুরা সাঁওতালদের ব্যবহারের চেষ্টা করেছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা হয়, সতর্কতার সঙ্গে নাসিরনগরের ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রকৃত অপরাধীতে খুঁজে বের করে তাদের আইনে সোপার্দ করতে হবে। বৈঠকে জানানো হয়, জাহাঙ্গীর আলমের দোকান আলামিন সাইবার পয়েন্ট থেকে সকল পরিকল্পনা করা হয়েছে। মোখলেচুর রহমান এবং আবুল কালাম নামে দুই ব্যক্তি মাইক সরবরাহ করে। এই মাইক দিয়ে মাইকিং করে অপপ্রচার করে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। সূত্র জানায়, বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ওসি সতর্ক থাকলে এই ঘটনা হয়ত ঘটত না। এছাড়া ওই সময় জনসভা করার অনুমতি দেয়াও ঠিক হয়নি। ইউএনও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ না করে এই অনুমতি দেয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। বৈঠকে আইজিপি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, নাসির নগরের ঘটনায় আমরা বিব্রত। এ ঘটনা দেশে-বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে। আমরা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। আমরা শান্তিতে বিশ্বাসী। দেশে কোন অবস্থাতে এই সকল অপতৎপরতা বরদাস্ত করা হবে না। তিনি বলেন, আর মাত্র দুই বছর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের আগে বিভিন্ন মহল সরকারের ভুল খুঁজবে। আন্দোলনের চেষ্টা করবে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নানাভাবে তৎপর হতে পারে। এগুলো বিবেচনায় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কাজ করতে হবে। সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। বৈঠক শেষে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, গত ৬ নবেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন সাঁওতাল নিহত হন। পুলিশ ও সাঁওতালদের অনেকে আহত হন। সাঁওতালদের গ্রেফতারও করে পুলিশ। সাঁওতালদের দাবি এ জমি তাদের পূর্বপুরুষদের। তিনি বলেন, ১৯৫৪ সালে সুগার মিল কর্পোরেশনের জন্য এই জায়গাটা (যে জমি নিয়ে গাইবান্ধায় সংষর্ষ) অধিগ্রহণ করা হয়। সেই থেকে ৬২ বছর পর্যন্ত এই জায়গাটা চিনিকলের অধীনে রয়েছে। এখানে আখ চাষ হয়ে আসছে। ৬২ বছরের মধ্যে এখানে কোন সাঁওতাল পল্লী বা কোন সাঁওতালের জায়গা বা অন্য কারো জায়গা ছিল না। ৬২ বছর এ জায়গাটা চিনি কলের অধিগ্রহণেই আছে এবং তাদের তত্ত্বাবধানেই চলছে। শিল্পমন্ত্রী বলেন, আজকে আমাদের ধারণা কিছু ভূমিদস্যু যারা ভূমি দখল করে তারা সাঁওতালদের ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। কিছু কিছু সাঁওতাল এনে বসিয়েছে। যাওয়ার সময় তারা যেভাবে আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে যদি কোন ব্যবস্থা নেয়া নাও হতো দেখা যেত ৬ মাস পর এদের (সাঁওতাল) তাড়িয়ে দিয়ে তারা (ভূমিদস্যু) জায়গাটা দখল করে নিত। সরকারী অধিগ্রহণের জায়গা সরকারী ব্যবস্থাপনায় চলছে এবং আখ চাষ করা হয়। সেই জায়গাটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার চেষ্টা হয়েছে। তিন তিনবার আমাদের পক্ষ থেকে যখন আখ চাষ করতে যাওয়া হয়েছে, তখন আক্রমণ হয়েছে, পুলিশ আহত হয়েছে। বারবার তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি আজ যারা সাঁওতালদের জন্য মায়া কান্না কাঁদছেন, তাদের মধ্যে কোন কোন নেতৃবৃন্দ প্রায় এক মাস আগে আমার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। আমি জিনিসটি তাদের বুঝিয়ে বলেছিলাম, অনুরোধ করেছিলাম আপনারা সাঁওতালদের বোঝান তারা ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে তারা (ভূমিদস্যু) তাদের থাকতে দেবে না। যারা তাদের আনছে তারা জায়গাটা দখল করতে চায়। ‘ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ অভিযান চালাতে বাধ্য হয়েছে। তিন মাস আমরা ধৈর্য্য ধারণ করেছি। আমরা তাদের বোঝাবার চেষ্টা করেছি। তারা জায়গা ছেড়ে যায়নি বরং যখনই আখ চাষ করতে গেছে তখনই আক্রমণ করেছে। পুলিশ আহত হয়েছে, সুপার মিলের কর্মচারীরা আহত হয়েছে। স্বার্থান্বেষী মহলের যোগসূত্র থাকতে পারে ॥ আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি বলেন, সম্প্রতিকালে বিভিন্ন জায়গায় মন্দির ভাঙ্গা, এ ধরনের ভাংচুরের যে ঘটনাগুলো ঘটছে আমরা মনে করি এর সঙ্গে কোন স্বার্থান্বেষী মহলের যোগসূত্র থাকতে পারে। দেশে যেহেতু জঙ্গীবাদ ফেল করেছে, এখন হয়ত আরেকটি পন্থা অবলম্বন করে একটু দেখাতে চায় আমাদের দেশের অবস্থা শান্ত নয় বা আমরা ধর্মীয় স্বাধীনতা দিতে পারছি না। সেই ব্যাপারেও আমরা কঠোর অবস্থান নিচ্ছি। এ ধরনের ঘটনা আর ঘটতে দেয়া হবে না বা ঘটবে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাসিরনগরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির ও ঘরবাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় ইতোমধ্যে ৮৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, যারা ওয়ান্টেড তাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ। ‘স্বার্থান্বেষী মহল’ এ কারা আছেন তা চিহ্নিত করা হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে শিল্পমন্ত্রী বলেন, চেষ্টা হচ্ছে। তদন্ত চলছে। এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, পত্রিকায় এসেছে (নাসিরনগরে) জাহাঙ্গীর নামের জামায়াতের একজন লোক তার দোকানে ডাউনলোড করে রসরাজ নামে একলোকের নামে (ধর্ম অবমাননা করে ফেসবুকে ছবি) ছেড়েছে, সেই জাহাঙ্গীরকে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। স্বার্থান্বেষী মহল বলতেও ওইটাই বোঝানো হচ্ছে। মোটমাট কথা হলো যারাই জড়িত সে যেই হোক না কেন তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। বৈঠকের বিষয়ে কমিটির সভাপতি আমু বলেন, ‘মিটিংয়ে আমরা পর্যালোচনা করে দেখলাম আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত ভাল। একটা স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশ নিয়ে আসা হয়েছে। বিদেশীদের আস্থা ফিরে আসার কারণে বিনিয়োগ বেড়েছে, রফতানি বেড়েছে। ভবিষ্যতে দেশে জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটবে না, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে দাবি করে আমু বলেন, তাদের সমস্ত কর্মকা- ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এবং তাদের মনিটরিংয়ে রাখা রয়েছে। তাদের সব ইন্টার লিঙ্কগুলোও আমাদের বাহিনীর জানা আছে। সহসা কেউ এদিকে আগাতে পারবে বলে আমরা মনে করি না। ফেসবুক ইন্টারনেট ব্যবহার করে যারা নাশকতা করে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাদের ব্যাপারটা মনিটরিং করা হচ্ছে। বিরুদ্ধে বললেই হাততালি বেশি পাওয়া যায় জানিয়ে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, এজন্য অনেকে বুঝেশুনে বিরোধিতা করে। শিল্পমন্ত্রী বলেন, দু’একটি বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে মিডিয়ায় কেউ কেউ যেভাবে কথা বলেন সেগুলোকে আপনারা (সংবাদ মাধ্যমগুলো) যদি একটু কম প্রশ্রয় দেন তাহলে সেটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে টকশো ব্যক্তিত্বদের সমালোচনা করে আমির হোসেন আমু বলেন, বিভিন্ন মিডিয়ায় আমরা বিভিন্ন লোক যাই, আমাদের বিজ্ঞতা জাহির করি। কথাবার্তা বলে মানুষকে অন্যরকম বলার চেষ্টা করি। আমাদের দেশে একটা প্রবণতা আছে, বিরুদ্ধে কথা বললেই হয়তো একটু হাততালি বেশি পাওয়া যায়। এটা স্বাভাবিক, বিরুদ্ধে কথা বললে হয়ত প্রশংসা পাওয়া যায়। এজন্য অনেক সময় আমরা বুঝেশুনে বিরোধিতা করি। তিনি বলেন, আমি সবাইকে অনুরোধ করব দেশের স্বার্থটাকে যাতে বড় করে দেখি, সত্যিকার ঘটনা অনুধাবন করে সেইভাবেই আমরা যেন পথ চলি।
×