ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন ধানের গন্ধ ভরা উৎসব

সম্প্রীতির নবান্ন

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

সম্প্রীতির নবান্ন

মনোয়ার হোসেন ॥ বাংলা পঞ্জিকার হিসাবে মঙ্গলবার ছিল পহেলা অগ্রহায়ণ। কৃষকের বোনা মাঠের ফসল ঘরে তোলার দিন নবান্ন। পাকা ধানের ম-ম গন্ধে গোলা ভরে ওঠার দিন। আবহমান গ্রাম বাংলার উৎসব-আনন্দের দিন। যদিও শহুরে নাগরিক জীবনে সেই দৃশ্যের দেখা মেলে না। পাওয়া যায় না শেকড়ের সেই অনুভব। তবে এদিন যান্ত্রিক শহর ঢাকায় বিরাজ করেছে নবান্নের আবহ। বহুমাত্রিক আয়োজনে নানা অনুষঙ্গে হাজির হয়েছে ফসলভিত্তিক উৎসবটি। আর সেই সব আয়োজনে প্রাণের স্পন্দনে মেতেছে শহরবাসী। মৃত্তিকাসংলগ্ন উৎসবের টানে সাত-সকালে ঘর থেকে বেরিয়েছে সংস্কৃতিপ্রেমী নগরবসী। সেই সুবাদে শাহবাগের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ চারুকলার বকুলতলা যেন হয়ে উঠেছিল এক খ- গ্রাম বাংলা। উৎসবে আগত শুভানুধ্যায়ীদের জন্য নৃত্য-গীত ও কথনের নবান্ন আবাহনের পাশাপাশি ছিল মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা কিংবা পিঠা-পুলি পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন। নানা পরিবেশনা ও বিশিষ্টজনদের আলোচনায় উচ্চারিত হয়েছে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বারতা। হেমন্তের হালকা শীতের চারুকলার বকুলতলায় বেজেছে ঢাক-ঢোলের বোল। একতারা-দোতারা ও বাঁশির সুরে নাগরিক মন ফিরে গেছে শেকড়ের পানে। সকালের মৃদু শীতল ভাবটি ঝেড়ে ঝলমলে রোদ ছড়াতেই বেড়েছে উৎসব উপভোগকারীদের আনানাগোনা। উৎসবের বদৌলতে নারী-পুরুষ ও শিশুর পোশাকেও ছিল রঙের ছটা। লোকজ আমেজের সঙ্গে প্রাণের উচ্ছ্বাসে মুখর হয়েছে নবান্ন উৎসব। ‘এসো মিলি সবে নবান্নের উৎসবে’ সেøাগানে গ্রামীণ ঐতিহ্যের অনুসারী এ উৎসবের আয়োজন করে জাতীয় নবান্ন উৎসব উদযাপন পর্ষদ। বিকেলে পর্ষদের পক্ষ থেকে ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরেও অনুষ্ঠিত হয়েছে এ উৎসব। এছাড়াও বাংলাদেশ ইয়ুথ এ্যান্ড স্টুডেন্টস ফোরাম ফর ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্টের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সড়কদ্বীপে এদিন থেকে শুরু হয়েছে দুই দিনের নবান্ন ও লোকজ মেলা। চারুকলার বকুলতলা ও ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চে নবান্ন উৎসব উদযাপনের জন্য দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সুরের সঙ্গে দিনভর ছিল নানা আয়োজন। বকুলতলায় ভোরের প্রথম প্রহরে শুরু হয় নবান্ন উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। বাঁশরিয়া এসএম মোর্তজা কবির মুরাদের রাখালিয়া বাঁশির সুরে দুই পর্বের আয়োজটির সূচনা হয়। সুরেলা শব্দধ্বনি তুলে পরিবেশন করে রাগ ভৈরবী। ছিল নবান্নকথন। নবান্নকথনে স্মৃতি থেকে উঠে আসে আবহমান বাংলার গ্রামীণ চিত্র। নাচে-গানে কিংবা কবিতার শিল্পিত উচ্চারণে বারবার নাগরিক মন যেন ফিরে গেছে সবুজ-শ্যামল গাঁয়ের পানে। সকাল ও বিকেল দুই পর্বের উৎসবটি উদ্বোধন করেন ভাষা সংগ্রামী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। নবান্নকথনে অংশ নেন পর্ষদের চেয়ারপার্সন লায়লা হাসান, শুভ রহমান, কাজী মদিনা, হাসিনা মমতাজ এবং পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান ল্যাবএইডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ এএম শামীম। স্বাগত বক্তব্য দেন পর্ষদের আহ্বায়ক শাহরিয়ার সালাম। উদ্বোধনী বক্তব্যে নবান্ন উৎসবের প্রাচীন ঐতিহ্যটি বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান আবুল মাল আবদুল মুুহিত। বলেন, সর্বজনীন উৎসব চর্চা বাড়াতে হবে। নবান্ন উৎসব আমাদের সর্বজনীন উৎসব। এ উৎসবে সব ধর্ম, শ্রেণী-পেশার মানুষ একত্রিত হতে পারে। নবান্ন উৎসবে গ্রাম বাংলার কৃষককে স্মরণ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, অগ্রহায়ণের শুরুতে সারাদেশের মতো ঢাকাতেও মহাÑধুমধামে নবান্ন উৎসব উদযাপিত হচ্ছে। যে কৃষি আমাদের জীবনপ্রবাহ নিশ্চিত করে, তাদের নিয়েই তো আজকের এই উৎসব। দেশব্যাপী উগ্রবাদের উত্থান মোকাবেলায় এ উৎসবের তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন, দেশে আজ পুরোপুরিভাবে শান্তি নেই। একটি নিকৃষ্ট শ্রেণী দেশে শান্তির প্রতি নানাভাবে আঘাত হানছে। তার বিপরীতে আজকের এই অসাম্প্রদায়িক উৎসব বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। নবান্নকে সম্প্রীতির উৎসব উল্লেখ করে বলেন, এ উৎসবে এসে কি জাতি, কি ধর্ম, কি বর্ণ- তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আজ আমরা এক দেহে লীন হয়ে গেছি। আজ আমাদের সবার একটাই পরিচয়, আমরা বাঙালী। এই তো উৎসবের মাহাত্ম্য। পর্ষদের চেয়ারপার্সন লায়লা হাসান নবান্ন উৎসবকে জাতীয়ভাবে উদযাপন ও এই দিবস উপলক্ষে সরকারী ছুটি দাবি করেন। উৎসব সাজানো হয় নবান্ন বিষয়ক গান ও নাচ দিয়ে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ব্যাপ্তির সকালের আয়োজনে ছিল মাটির গান, কৃষকের গান, ফসল তোলার আনন্দের গান। ফরিদা পরভীন পরিবেশন করেন ফকির লালন সাঁইয়ের গান ‘সত্য সুপথ না চিনলে পাবিনে মানুষের দরশন’। আবু বকর সিদ্দিক গেয়ে শোনান ‘আমার গোঁসাইরেনি দেখছো খাইজর গাছ তলায়’। সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পীরা পরিবেশন করেন ‘আবার জমবে হাটখোলা বটতলা নবান্ন উৎসবে’। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী গেয়ে শোনায় ‘নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে’, বহ্নিশিখা ‘আয়রে আয়রে ছুটে আয় সবে আয়রে ধান কাটি ধান কাটি’, স্বভূমি ‘সুন্দর সুবর্ণ লাবণ্য’। ‘চাঁদ উঠেছে ওই, ফুল ফুটেছে ওই, নাচো দেখি সোনার মেয়ে চুল খোলে’ গানের সুরে সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে এমআর ওয়াসেকের পরিচালনায় নন্দন কলাকেন্দ্র। ‘ঢোল বাজে ঢোল বাজেরে’ গানের সুরে অনিক বসুর পরিচালনায় দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে স্পন্দন। সাইরেনের পরিচালনায় গারো আদিবাসীদের ওয়ানগালা জুম নৃত্য পরিবেশন করেন গারোদের সাংস্কৃতিক সংগঠন আচিক। ঘরে ফসল তোলা ও বণ্টনের রকমফের নিয়ে বিভিন্নধর্মী নৃত্য পরিবেশন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন কাঁদা মাটি। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মানজার চৌধুরী সুইট। প্রথম পর্বের পরিবেশনা শেষে সকাল ৯টা ৫ মিনিটে চারুকলার বকুলতলা থেকে বের হয় নবান্ন শোভাযাত্রা। এটি টিএসসি চত্বর ঘুরে পুনরায় চারুকলার বকুলতলায় এসে শেষ হয়। পরে বিকেল তিনটা থেকে আটটা পর্যন্ত একযোগে চারুকলার বকুলতলা ও ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরে উৎসবের দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। টিএসসিতে নবান্ন ও লোকজ মেলা ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়কদ্বীপে বাংলাদেশ ইয়ুথ এ্যান্ড স্টুডেন্টস ফোরাম ফর ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্টের আয়োজনের মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে দুই দিনের নবান্ন উৎসব ও লোকজন মেলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বেলুন উড়িয়ে এ মেলার উদ্বোধন করেন। প্রধান অতিথি ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। বিশেষ অতিথি ছিলেন পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ড. অপরূপ চৌধুরী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, মিডিয়া কাউন্সিল ফর ট্যুরিজম বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা। রাশেদ খান মেনন বলেন, নবান্ন উৎসব কৃষকদের উৎসব। এ ধরনের আয়োজন দ্বারা সমাজে সম্প্রীতি বাড়বে। পর্যটন শিল্পের বিকাশে নবান্ন উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, নবান্ন আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের অতিথিপরায়ণ কৃষকদের উৎসব এটি। অতিথি পরায়ণ হিসেবে বাংলাদেশীরা খুব পরিচিত। অতিথিপরায়ণ এই জাতি পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করবে, এটাই স্বাভাবিক। পর্যটনের বিকাশে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সচেতন হতে হবে। আজ বুধবার সমাপনী দিনে মেলা সকাল ৯টায় শুরু হয়ে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে। বিকেল ৩টায় থাকছে ‘লোকজ সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প’ শীর্ষক আলোচনা। মুখ্য আলোচক থাকবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খান। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান।
×