ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আরএআই সূচকে ভারত, নেপাল, পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে ;###;সড়ক যোগাযোগের আওতায় এসেছে দুর্গম চর, হাওড় ও পার্বত্য অঞ্চল

পল্লীবাসীর জীবনমানে সমৃদ্ধির ছোঁয়া ॥ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নেও বিশ্বে মডেল বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

পল্লীবাসীর জীবনমানে সমৃদ্ধির ছোঁয়া ॥ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নেও বিশ্বে মডেল বাংলাদেশ

আনোয়ার রোজেন ॥ গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সমপর্যায়ের স্বল্পোন্নত অনেক দেশকেই ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। এমনকি এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান, নেপালকেও ছাড়িয়ে গেছে সরকারের প্রয়াস। স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক সেবাপ্রাপ্তিতে মূল বাধা অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। উৎপাদিত কৃষি ও অকৃষি পণ্য পরিবহন এবং বিপণনেও প্রধান প্রতিবন্ধকতা এটি। গ্রামাঞ্চলে এ সমস্যা আরও প্রকট। দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্যের সঙ্গেও এর সম্পর্ক আছে। তবে বর্তমান সরকার গত সাত বছরে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চিত্রটি বদলে দিয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সর্বশেষ তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি বিশ্বব্যাংকের ‘নতুন গ্রামীণ যোগাযোগ অবকাঠামো সূচক’-এ (নিউ রুরাল এ্যাকসেস ইনডেক্স) সবার ওপরে রয়েছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সামনে মডেল। সর্বশেষ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৮৬ দশমিক ৭। ২০০৬ সালের একই সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল মাত্র ৩৭। নতুন এ সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের সর্বশেষ তথ্যের উল্লেখ নেই। তবে বিশ্বব্যাংকেরই তৈরি করা গ্রামীণ যোগাযোগ বিষয়ক অপর একটি সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের স্কোর ৬১। নতুন সূচকে নেপালের স্কোর ৫৪ দশমিক ২। যোগাযোগ খাতের উন্নয়ন পরিমাপে যে কয়টি বৈশ্বিক সূচক রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে গ্রামীণ যোগাযোগ অবকাঠামো সূচক বা আরএআই। এটি তৈরির ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয় প্রতি দুই কিলোমিটার এলাকার চারপাশে সুবিধাভোগীর সংখ্যা, জনসংখ্যার ঘনত্ব, চলাচলের উপযোগী মানসম্মত রাস্তার পরিমাণ ও গ্রামীণ রাস্তার মোট দৈর্ঘ্য। এসবের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় গ্রামীণ যোগাযোগ অবকাঠামো সূচক। চলতি মাসের শুরুর দিকে ‘নিউ রুরাল এ্যাকসেস ইনডেক্সঃ মেইন ডিটারমিনেন্টস এ্যান্ড কোরিলেশন টু পভার্টি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। এ প্রতিবেদনেই প্রাপ্ত তথ্যেরভিত্তিতে তৈরি অঞ্চলভেদে স্বল্পোন্নত দেশের গ্রামীণ যোগাযোগ অবকাঠামো সূচক তুলে ধরা হয়েছে। নতুন সূচকে বাংলাদেশের পরের অবস্থানে থাকা আফ্রিকা অঞ্চলের দেশ কেনিয়ার স্কোর ৫৬। তৃতীয় স্থানে থাকা নেপালের স্কোর ৫৪ দশমিক ২। এছাড়া উগান্ডার ৫৩ দশমিক ১, তানজানিয়ার ২৪ দশমিক ৬, ইথিওপিয়ার ২১ দশমিক ৬, মোজাম্বিকের ২০ দশমিক ৪ ও সর্বেশেষ অবস্থানে থাকা জাম্বিয়ার স্কোর ১৭। এর মধ্যে সর্বশেষ হিসাবে বাংলাদেশ, নেপাল, ইথিওপিয়া ও উগান্ডার ২০১৫ সালের সূচক উল্লেখ করা হয়েছে। আর কেনিয়ার ২০০৯, মোজাম্বিকের ২০১০, তানজানিয়ার ২০১৪ ও জাম্বিয়ার ক্ষেত্রে ২০১১ সালের সূচক সর্বশেষ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০০৬ সালে গ্রামীণ রাস্তার মোট দৈর্ঘ্য আর জনঘনত্বের হিসাবে প্রথমবারের মতো আরএআই সূচক তৈরি করে বিশ্বব্যাংক। ওই সময় বাংলাদেশের স্কোর ছিল মাত্র ৩৭। স্বল্পোন্নত অন্য দেশগুলোর মধ্যে নেপালের স্কোর ছিল সে সময় ১৭, ইথিওপিয়ার ৩২, কেনিয়ার ৪৪, মোজাম্বিকের ২৭, তানজানিয়ার ৩৮, উগান্ডার ২৭ ও জাম্বিয়ার ৬৪। আরএআই সূচকে উন্নতির বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পরিকল্পনা) ইফতেখার আহমেদ গণমাধ্যমে বলেছেন, আমরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে হাট-বাজারের যোগাযোগ স্থাপন করেছি। আফ্রিকার দেশগুলোসহ বিশ্বের অনেক দেশই এখন আমাদের মডেল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। গ্রামীণ যোগাযোগের উন্নয়নে আমরা ভারতের চেয়েও এগিয়ে আছি। নবেম্বরে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ট্রান্সপোর্ট কানেকটিভিটি (পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থা) অপরিহার্য। এজন্য স্থানীয়, জাতীয় এবং বৈশ্বিক শ্রমবাজার-ব্যবসার সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের সংযোগ স্থাপন করতে হবে। অথচ বিশ্বে গ্রামীণ অধিবাসীদের মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ এখনও সড়ক যোগাযোগের বাইরে। গ্রামীণ অধিবাসীদের শতকরা হিসেবে এই সংখ্যা ৬৮ দশমিক ৩ ভাগ। তবে অঞ্চলভেদে সড়ক সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অসমতাও আছে। পূর্ব এশিয়ায় গ্রামীণ বাসিন্দাদের ৯০ শতাংশ ন্যূনতম দুই কিলোমিটার পাকা সড়ক ব্যবহারের সুবিধা পান। আফ্রিকায় এই হার মাত্র ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভাল অবস্থানে আছে। ভৌগোলিক অবস্থান ও সরকাররের নীতি- মূলত এ দুটি কারণেই সূচকে বাংলাদেশ অন্য দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করছেন ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স এ্যান্ড ডেভলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি। এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিবেশে এক ধরনের সমরূপতা বা অভিন্নতা আছে। নিয়মিত বন্যা ও নদী ভাঙনের পরও আমাদের এখানে গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ টিকে যায়। আবার এটাও ঠিক যে, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। অন্যান্য ক্ষেত্রে মতের বিরোধিতা থাকলেও প্রায় প্রতিটি সরকারের আমলেই গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন গুরুত্ব পেয়েছে। এখন এর ইতিবাচক ফলও আমরা পাচ্ছি। তিনি বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। পণ্য উৎপাদন, উপকরণ সংগ্রহ, পরিবহন, বাজারজতাকরণ ও ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তির সঙ্গে দারিদ্র্যের বিষয়টি জড়িত। সড়ক যোগাযোগ উন্নত হলে এসব ক্ষেত্রে মানুষের প্রবেশগম্যতা বাড়ে। শিক্ষা বিস্তার ও স্বাস্থ্য সেবাপ্রাপ্তি সহজ হয়। জনঘনত্ব বেশি হওয়ায় এখানে এক কিলোমিটার রাস্তা করলে অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি মানুষ সেবা পায়। সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি রাজধানীতে একটি সেমিনারে বলেছেন, পল্লী অবকাঠামো উন্নয়নে জেলা ভিত্তিক প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। সরকার সুষম উন্নয়নের জন্য শহর ও গ্রামের বৈষম্য কমিয়ে আনতে চায়। এজন্য আধুনিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ বিভিন্ন সুবিধা গ্রামে দেয়া হবে, যাতে মানুষ শহরমুখী না হয়।
×