ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ছয় মাস না যেতেই ক্যাবের আশঙ্কা সত্যি হলো

ব্যবসায়ীদের অপকৌশল, দফায় দফায় দাম বাড়ছে নিত্যপণ্যের

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

ব্যবসায়ীদের অপকৌশল, দফায় দফায় দাম বাড়ছে নিত্যপণ্যের

এম শাহজাহান ॥ জাতীয় বাজেট ঘোষণার আগে ‘ক্যাব’ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিল, ‘এ বছর নিত্যপণ্যের বাজারকে অস্থিতিশীল ও অসহনীয় করে তুলতে পারেন অতি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ীরা। সরকারের প্রতি সতর্ক বার্তা দিয়ে সংগঠনটি বলেছে, পণ্যমূল্য নিয়ে অসাধু সিন্ডিকেট বাজারে নিত্যনতুন অপকৌশল প্রয়োগ করে যাচ্ছে। দফায় দফায় বাড়িয়ে যাচ্ছে দাম। এটা ভোক্তা ও সরকার কারও জন্যই শুভকর নয়।’ ছয় মাস না যেতেই ক্যাবের (কনজ্যুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও দেশে দফায় দফায় বাড়ছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য চাল, চিনি, ভোজ্যতেল, লবণ, রসুন ও ডালের দাম। সবজির দাম এখন আকাশ ছোঁয়া। পেঁয়াজ ছাড়া গত এক বছরে ১১৪টি খাদ্যপণ্যের সবগুলোর দাম বেড়েছে। ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবা সার্ভিস নিতে মানুষকে আগের তুলনায় বেশি খরচ করতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের যাতাকলে পড়ে ভোক্তাদের ত্রাহি অবস্থা। স্বল্প আয়ের মানুষ ভোগ্যপণ্য কিনতে উপার্জনের সবটুকু ব্যয় করছেন। তারপরও স্বস্তি মিলছে না। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজার ব্যবস্থায় এ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির লাগাম টেনে ধরা ও কারসাজি রুখতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সরকারকে আরও কঠোর ও কৌশলী হতে হবে। কার্যকর করতে হবে প্রতিযোগিতা কমিশন আইন। জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের ঘুম ভাঙাতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ করে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ারও তাগিদ দিয়েছে দেশে ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের সংগঠনগুলো। এই বাস্তবতায় ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ে চরম অস্বস্তিতে দেশের কোটি কোটি সাধারণ ভোক্তা। লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধিতে অস্বস্তি বিরাজ করছে সব শ্রেণীর ক্রেতাদের মধ্যে। ভোক্তাদের জিজ্ঞাসা-আন্তর্জাতিক বাজারে যখন মূল্য কমছে তখন কেন বাংলাদেশে এসব পণ্যের দাম বাড়ছে? তবে এসব প্রশ্নের সঠিক কোন উত্তর নেই সংশ্লিষ্টদের। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এসব সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজি, জিম্মি হয়ে পড়ছে প্রশাসন। দুর্বল বাজার মনিটরিং, প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করা হলেও তা কার্যকর না হওয়া, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে যে আইন রয়েছে তা প্রয়োগ না হওয়া, ভ্রাম্যমাণ আদালত নিষ্ক্রিয় থাকা এবং পণ্যমূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করার সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং টিম শক্তিশালী করার সঙ্গে সঙ্গে সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা টিসিবিকে শক্তিশালী করার পরামর্শ রয়েছে তাদের। ক্যাব সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের মতে, বাজার ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা হ্রাস ও আইনী নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণেই অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গড়ে উঠছে। তারা অযৌক্তিক মুনাফার উদ্দেশ্যে সময় ও সুযোগ বুঝে বাজার বিভাজনের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে আসছে। এ প্রবণতা ভোক্তা কিংবা সরকার কারও জন্যই শুভকর নয়। তিনি ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণে বিশেষ আইন প্রয়োগ করারও প্রস্তাব করেন। ইতোপূর্বে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সব ধরনের পণ্যের বিক্রয় মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত নয়। সাধারণ মানুষের নিত্যব্যবহার্য সেবা ও পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপ সরকারের জনকল্যাণমুখী নীতির সঙ্গে কোনভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি করা হলে দ্রব্যমূল্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা গ্রাস পাবে। অসৎ ব্যবসায়ীরা আরও লাভবান ও জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে এটি ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণও বাড়াবে। এ পরিস্থিতিতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট আরোপ না করার পরামর্শ দেন তিনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্বৃত্তি টেনে ওই সময় ক্যাব জানিয়েছে, প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ, উৎপাদন ও আমদানি সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে। এটি সত্য বলে ধরা হলে বাজার ব্যবস্থায় চাহিদা ও যোগানের ফর্মুলা অনুযায়ী কোনভাবেই পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়া উচিত নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- চাল, ডাল, ভোজ্যতেল লবণ, রসুন, চিনি, ছোলাসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অনৈতিক বলেও উল্লেখ করেছেন ক্যাব সভাপতি। চিনি ভোজ্যতেল ও লবণের দাম বেশি নেয়া হচ্ছে ॥ পণ্যের দর ও জাহাজ ভাড়া মিলিয়ে এক কেজি চিনির উৎপাদন খরচ পড়ে ৪৬ টাকা। গত জুনে ইউনাইটেড সুগার মিলস অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেছে প্রতিটন ৩২০ ডলার দরে। এসব দরে আমদানি করা চিনি বর্তমানে দেশের বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে। অথচ আমদানি ব্যয়, পরিশোধন খরচ এবং সরকারের শুল্ককর ও ভ্যাট পরিশোধসহ প্রতিকেজি চিনিতে খরচ পড়ে ৫০ থেকে ৫২ টাকা। প্রতিকেজিতে পাইকারি ব্যবসায়ী বা পরিবেশক এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের দুই ও তিন টাকা করে লাভ ধরলে কেজিপ্রতি দর হওয়ার কথা ৫৫ থেকে ৫৭ টাকার মধ্যে। কিন্তু কারসাজি করে সেই চিনি এখন বিক্রি করা হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকায়। এ প্রসঙ্গে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও চিনি ব্যবসায়ী হাজী মোঃ আলী ভুট্টো জনকণ্ঠকে বলেন, মিলমালিকদের কারণে চিনির দাম কমছে না। এছাড়া অপরিশোধিত এবং পরিশোধিত চিনির শুল্কহার সমন্বয় করা হলে চিনির দাম কমে আসবে। এদিকে, গত মাসের শেষের দিকে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম লিটারে দুই থেকে চার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন মিল মালিকরা। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে এ কাজ করেছেন তারা। সরকারী প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এছাড়া সয়াবিন তেল খোলা প্রতিলিটার ৮৪-৮৬ টাকা বিক্রি হয়েছে। সম্প্রতি ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে ভোজ্যতেলের এই মূল্য বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে, টিসিবির তথ্যমতে, বাজারে প্রতিকেজি পরিশোধিত লবণের দাম এখন ২৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। গত বছর এই সময় প্রতিকেজি লবণের দাম ছিল ১৫ থেকে ২৮ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে লবণের দাম বেড়েছে ৫২ শতাংশ। এ অবস্থায় দেশের বাজারে কাঁচা লবণের দাম বাড়ার কারণে খাবার লবণের দাম বাড়ছে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। ঘাটতি লবণের চাহিদা মেটাতে জরুরী ভিত্তিতে দুই দফায় আড়াই লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। যদিও লবণ আমদানিতে শিল্প ও ভোজ্য লবণ হিসেবে কোটা সৃষ্টি করায় দাম বাড়াতে সিন্ডিকেট চক্র কারসাজি করতে পারে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক মাসের ব্যবধানে মসুর ডালের দাম ৩৫ শতাংশ কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে টনপ্রতি মসুর ডালের দাম ছিল ৫০ হাজার ৪৪০ টাকা। গত মাসের এই দিনে টনপ্রতি মসুর ডালের আন্তর্জাতিক দর ছিল ৭৭ হাজার ৯০৭ টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে মসুর ডালের দর কমেছে ৩৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর গত এক বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে মসুর ডালের দর কমেছে ২৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ। কিন্তু দেশের বাজারে গত এক মাসে দাম এক টাকাও কমেনি। বছর ওয়ারি হিসাব করলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় ২৪ শতাংশ দরপতন হলেও দেশের ভেতরে দাম বেড়েছে প্রায় ৭ থেকে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, এটা সত্য যে, সরকারী পলিসির কারণে গত এক বছরে চিনির দাম বেশ বেড়ে গেছে। যদিও মূল্য এত বাড়ার কথা নয়। এক্ষেত্রে বাজারে কিছু কারসাজি করা হতে পারে। কেন দাম বেড়ে চিনির দাম আর কমছে না তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। লবণের দাম বাড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই পণ্যটির দাম কমে আসবে। চাহিদার ঘাটতি পূরণে লবণ আমদানি করা হচ্ছে। এছাড়া ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ ও ডালের দাম এখনও মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের দাম যাতে আর না বাড়ে সে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য মজুদ এবং সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে আগামী ২ নবেম্বর জরুরী বৈঠক আহ্বান করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
×