ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

স্বদেশে ’৫৮ সালে গণতন্ত্র ধ্বংসের সূত্রপাত ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা হয়। এ বছরের প্রথম দিনেই ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কমিশন (ঊঊঈ) প্রতিষ্ঠা পায়। এই বছরেই যুদ্ধ শেষে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক শিল্পমেলা অনুষ্ঠিত হয় ব্রাসেলসে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে সর্বশেষ শিল্পমেলাটিও অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৫ সালে ব্রাসেলসে। ফ্রান্সে রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান হয় এই বছর যখন সকলে মিলে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একজন উল্লেখযোগ্য নেতা চার্লস দ্য গল আমন্ত্রিত হয়ে সে দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে। পূর্ব-পশ্চিম শক্তিগুলো একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয় যে, ৩ বছর তারা আণবিক টেস্ট বোমা বিস্ফোরণ বন্ধ রাখবে। এই বছর মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া এবং মিসর একীভূত হয়ে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র (টঅজ) গঠন করে। অবশ্যি এই উদ্যোগটি ক্ষণস্থায়ী ছিল। ১৪ জুলাই এক রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যুবরাজ ফয়সালকে হত্যা করে জেনারেল আবদুল করিম কাশেম ইরাকে সামরিক সরকার গঠন করেন। খেলার জগতে ১৪ বছর বয়স্ক ববি ফিসার আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতার অত্যাশ্চর্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আবির্ভূত হন। এই বছরই আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন উদ্যোগে সবিশেষ জোর আসে যখন বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে দুর্যোগের সৃষ্টি হয়েছিল তা মোকাবেলা করার জন্য পশ্চিমের সব ধনী দেশ যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে। দুই বছরের জন্য ভারতের উন্নয়ন কার্যক্রমকে পুনরুদ্ধার করে বহাল রাখার জন্য বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে এই এইড কনসোর্টিয়াম প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের জন্য অনুরূপ একটি এইড কনসোর্টিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অন্যান্য দেশের জন্য এই ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের অনুরোধে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ এইড গ্রুপ স্থাপিত হয়। ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমরা করাচীতে নির্দেশ পেলাম যে, আমাদের পূর্ববাংলায় পদায়ন হয়েছে। পূর্ববাংলায় প্রত্যাবর্তন করে কিছুদিন সিলেটে অবস্থান করে ঢাকা যাওয়ার আগেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই অতিরিক্ত কয়েকদিন আমাকে সিলেটে থাকতে হলো। ঠিক তারিখ মনে নেই যখন ঢাকায় সংস্থাপন বিভাগে হাজিরা দিলাম তখন আমাকে বলা হলো যে, আমি ফরিদপুরের সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পদায়ন পেয়েছি এবং যোগদানের জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সেখানে হাজির হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমার অসুস্থতার কারণে ইতিমধ্যেই আমার কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই আর সময় না নিয়ে আমি ফরিদপুরে যাওয়ার ব্যবস্থা নিলাম। ট্যাক্সি করে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে জাহাজ করে গোয়ালন্দ এবং তারপর ট্রেনে ফরিদপুরে। ঢাকা ছাড়লাম একদিন দুপুরে পরের দিন সকালে গোয়ালন্দ পৌঁছে সেদিনই দুপুরের দিকে ফরিদপুর পৌঁছলাম। সেটা ছিল ৭ অক্টোবর ১৯৫৮ সাল। আমি সেদিনই জেলা প্রশাসক আরেফ সিদ্দিকী, সিএসপির সঙ্গে দেখা করে কাজে যোগ দিলাম। আমার আদালতে সামান্য হাজিরা দিয়ে দিনের কাজ শেষ হলো। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম যে, ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজটি কাছেই অবস্থিত এবং সেখানে যাওয়ার পথে রয়েছে ফরিদপুর স্টেশন ক্লাব। যেখানে বিকেলে টেনিস খেলা হয় এবং রাতে বসে আড্ডা এবং তাসের আসর। টেনিস খেলার মাঠের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিল রাজেন্দ্র কলেজের খেলার মাঠ। সেখানে ফুটবল ছাড়াও ভলিবল খেলা হতো। ফরিদপুর শহরটি দেখতে বিকেল বেলা গেলাম জিপে চড়ে। খুব সম্ভবত মাইলখানেক গেলেই শহরের বাজার এলাকা শেষ হয়ে গেল। সেখানে পেলাম একটি মনিহারি দোকান। যার নাম ছিল ‘দোকান ঘর’। এই মনিহারি দোকানের মালিক ছিলেন একজন প্রাক্তন সরকারী কর্মকর্তা; সম্ভবত সাব-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ফরিদপুর শহর খুবই অনুন্নত ছিল এবং সেখানকার দোকানপাটে ঢাকার উৎপাদিত দ্রব্যাদির ছিল দারুণ অভাব। ভাল পণ্যের সবই সূত্র ছিল কলকাতা। দোকান ঘরে খোঁজ করলে ঢাকায় উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য পাওয়া যেত। তবে সেজন্য প্রায়ই ২/৩ দিন অপেক্ষা করতে হতো। কারণ, দোকানের মালিক সেগুলো ঢাকা থেকে আমদানি করতেন। আমি প্রতি পক্ষকালে তাকে আমার কিছু প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের তালিকা করে দিতাম এবং তিনি আমাকে সেগুলো সরবরাহ করতেন। আমি আমার সঙ্গে একজন পরিচালক নিয়ে গিয়েছিলাম। যে আমাদের বাড়িতে বহুদিন ছিল। তার পরিবারের সদস্যদের অনেকেই আমাদের বাড়িতে কাজ করত। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় চাঁদপুর থেকে সিলেটে এসে বসতি স্থাপন করে। সেই পরিবারের ছেলে মতি আমার ফাই-ফরমাশ খাটার জন্য এবং প্রয়োজনে সামান্য রান্না-বান্না করার উদ্দেশ্যে আমার সঙ্গে ফরিদপুরে যায়। ফরিদপুরে তখন মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুত সরবরাহ হতো। সম্ভবত সন্ধ্যা বেলা থেকে রাত ১০/১১টা পর্যন্ত। নবেম্বরের ৭ তারিখে শীতের ছোঁয়া লেগেছে কিন্তু ফ্যান ছাড়া কামরাগুলো তখনও আশাতীতভাবে উত্তপ্ত থাকত। সার্কিট হাউসের চৌকিদার আমাকে উপদেশ দিল যে, আমার বিছানাটি কামরার বাইরে সামনের বারান্দায় সাজানো যায় এবং তাতে ভাল করে মশারি এঁটে দেয়া যাবে। সেইভাবেই আমি প্রায় রাত ১২টার পরে বারান্দায় শুইতে যাই। ভোরবেলায় তখনও আমি বিছানা ছাড়িনি, সেই সময়ে যে জিপ ড্রাইভার আমাকে গতকাল রেলওয়ে স্টেশন থেকে শহরে নিয়ে আসে সেই-ই আমাকে ডাকতে থাকে। তার ডাকে আমার ঘুম ভাঙ্গে এবং তখন সে আমাকে বলে যে, আমাকে এখনই জেলা প্রশাসকের বাড়ি যেতে হবে এবং সেজন্যই সে গাড়ি নিয়ে এসেছে। আমি তাড়াহুড়া করে তৈরি হয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, জেলার সব বড় কর্মকর্তারা উপস্থিত। আগের দিন বিকেলে জেলা প্রশাসক সাহেবের বাড়িতে দু’জন গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। তাদের একজন ছিলেন জেলা জজ মৌলভী আবদুল মওদুদ। যিনি পরবর্তীকালে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি হন। আর অন্যজন ছিলেন সম্ভবত জেলার সরকারী উকিল খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল। ইসমাইল সাহেব প্রতিদিনই কোর্টে আসতেন। কোর্তা-পাজামার উপরে কালো কোট পরে এবং একটি সুন্দর কিস্তি টুপি মাথায় পরে। তার দু’জন সুপুত্র দেশব্যাপী পরিচিত- মোহাম্মদ আসাফুদ্দৌলা এক সময় প্রসিদ্ধ সাঁতারু, গীত ও সুরশিল্পী এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসেবে সচিব পদ থেকে অবসরপ্রাপ্ত। আর অন্যজন মোহাম্মদ আনিসুদ্দৌলা যিনি বহুদিন ওঈও নামক আন্তর্জাতিক বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করার পর বাংলাদেশে যখন কোম্পানিটি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলল তখন এসিআই নামে একটি প্রতিষ্ঠান তিনিই স্থাপন করেন। তিনি এখন অবসর জীবনযাপন করেন। তবে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের একজন নেতা হিসেবে এখনও কর্মঠ। তাদের বোন ছিলেন এদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ নজরুল সঙ্গীতজ্ঞ, যিনি অল্প বয়সে কবি নজরুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং কমল দাসগুপ্তের অধীনে নজরুল সঙ্গীতের চর্চা করেন। যেনে রাখা ভাল যে, তখন ফরিদপুর থেকে কলকাতা যেতে আড়াই থেকে চার ঘন্টা লাগতো এবং অনেকেই ইস্ট বেঙ্গল, মোহনবাগান বা মোহামেডান স্পোর্টিং-এর খেলা দেখতে কলকাতা যেতেন এবং দিনে দিনে ফরিদপুর ফিরতেন। আমি ফরিদপুর থাকাকালে খান বাহাদুর সাহেবের বাড়িতে কয়েকবারই গিয়েছি। ফরিদপুরে তখন একজন ভূমি রাজস্ব কর্মকর্তা ছিলেন মাসুদ। যিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে খুবই আগ্রহী ছিলেন। ফরিদপুরের একজন ছোটখাটো জমিদার লাহিড়ি বাবুও ভাল সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। মাঝে মাঝে তাই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেরও ঘরোয়া আসর বসত। ফরিদপুরের মুসলমান পরিবারের মধ্যে বিখ্যাত ছিল মোহন মিয়া, লাল মিয়া এবং তারা মিয়া ভ্রাতৃত্রয়ের বাড়ি। তারা মিয়া ফরিদপুরেই থাকতেন এবং লাল মিয়া সাহেবের যুবক সন্তান রাজা মিয়া মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে টেনিস খেলত। মোহন মিয়া সাহেবের বাসস্থান তখন ছিল ঢাকার আরমানিটোলায় এবং সেখানে তার ছেলেমেয়েও থাকত। আমার স্বল্প সময়ে ফরিদপুর থাকাকালে তাদের কাউকেও কখনও দেখিনি। আমার প্রথম সমস্যা হলো একজন বাবুর্চি খোঁজা। কারণ, আমার মতি মিয়া আসলেই ছিল ফাই-ফরমাশ খাটার জন্য উপযুক্ত। প্রয়োজনে সে রান্না-বান্না করতে পারত। তারা মিয়া এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেন। তিনি বললেন যে, তার পরিচিত একজন ভাল লোক আছে যে অত্যন্ত ভাল পাচক। সে লোকটি অত্যন্ত দুঃখকষ্টে আছে। তাকে একটু বেশি বেতন দিতে হবে। তার নামটা ভুলে গেছি। সচরাচর সে গর্ডন সাহেবের ছেলে বলে পরিচিত ছিল। এক সময়কার ফরিদপুরের পুলিশ সুপার রিচার্ড গর্ডন তাকে ফাই-ফরমাশ খাটার জন্য বয় হিসেবে নিযুক্তি দেন। গর্ডন সাহেব পরে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে সম্ভবত সর্বশেষ ব্রিটিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে অবসরে যান। তিনি এই ছেলেটিকে তার সঙ্গে নিয়ে যান এবং কালক্রমে সে ওস্তাদ পাঁচক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ভারত বিভাগের সময় এই বালকটি হয় অবিবাহিত একটি আকর্ষণীয় যুবক এবং সে তখন মোটেই বিয়েশাদিতে আগ্রহী ছিল না। তার জন্য গর্ডন সাহেব একটি বাড়ি নির্মাণ করে দেন। যার নাম আমি যখন ফরিদপুরে যাই তখনও গর্ডন হাউস ছিল। তাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য গর্ডন সাহেব তাকে কিছু টাকা-পয়সাও দিয়ে যান। সে মহা ধুমধামে জীবন কাটিয়ে মধ্যবয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং তার পরেই শুরু হয় তার দুঃখের দিন। সে উচ্চ বেতনে চাকরি চায় বলে কেউ তাকে পাঁচক নিযুক্ত করে না। আর অন্য কোন কাজের কোন যোগ্যতা তার ছিল না। তাকে শহরের বড় লোকেরা এবং জেলা প্রশাসক মাঝে মাঝে কোন উৎসব বা মেজবানী খানার জন্য স্বল্প সময়ের জন্য নিযুক্তি দিতেন। তারা মিয়া আমাকে উপদেশ দিলেন যে, আমি তাকে ২৫/৩০ টাকা দিলে সে আমার কাজ করবে। আমি তাকে ২৭ টাকা বেতনে আমার পাঁচক নিযুক্ত করি। সে তার বাড়িতেই থাকত। সারাদিনই সে আমার খাওয়া-দাওয়ার জন্য রাত পর্যন্ত সার্কিট হাউসে থাকত। সে পারতপক্ষে এক ধরনের খানা দ্বিতীয় দিন দিত না। খানার ব্যাপারে আমি ছিলাম বিশেষ আগ্রহী এবং সব ধরনের খানা দেশী-বিদেশী আমার ছিল খুবই পছন্দ। তাই বলা যেতে পারে যে, তথাকথিত গর্ডনপুত্র আমার পাঁচক হিসেবে খুবই খুশি ছিল। সে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকে। সে মাসে আমার কাছ থেকে ১০০ টাকার মতো খানা খরচ নিত। তার সঙ্গে আমার এই সুখের সম্পর্ক সম্ভবত ৫/৬ মাসের মতো স্থায়ী ছিল। ৮ অক্টোবর সকালবেলা জেলা প্রশাসক আমাদের ডেকেছিলেন বলে আগেই উল্লেখ করেছি। আমরা কেউই অনেক আলাপ-আলোচনা করে বুঝতে পারলাম না, কেন এই সাত সকালে আমাদের আহ্বান করা হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমরা যখন নানা ধরনের উপলক্ষ অনুসন্ধান করছিলাম তখন জেলা প্রশাসক আরেফ সিদ্দিকী অত্যন্ত গম্ভীরভাবে স্যুট-কোট পরে তার আসনে বসলেন। বসেই তিনি কোন ধরনের ভূমিকা না করে তার বক্তৃতা শুরু করলেন। বললেন, গত রাতে রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইস্কান্দর মির্জা সারাদেশে সামরিক শাসন ঘোষণা করেছেন এবং সংবিধান বাতিল করেছেন। তাকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে জানানো হয়েছে যে, একজন মেজর যশোর থেকে স্থলপথে অতি সত্বর ফরিদপুর পৌঁছবেন এবং তিনিই হবেন এ্যাসিস্ট্যান্ট জেলা সাব-এ্যাডমিনিস্ট্রেটর বা এএসএ। জেলা প্রশাসক তার অধীনে হবেন ডেপুটি এ্যাসিসটেন্ট এ্যাডমিনিস্ট্রেটর বা ডিএএসএ। তিনি না আসা পর্যন্ত আমরা বুঝতে পারব না যে, কিভাবে জেলা প্রশাসন চলবে। ইতোমধ্যে শহরের কয়েকটি জায়গায় বিশেষ করে জেলা প্রশাসনের দফতর এবং সার্কিট হাউসে কয়েকটি তালাবদ্ধ অভিযোগ বাক্স স্থাপন করা হবে। সেখানে যে কোন ব্যক্তি যে কোন বিষয়ে তার দাবি বা অভিযোগ জানাতে পারবেন। সেজন্য তাদের লিখিত অভিযোগ জমা দিতে হবে। এএসএ সাহেব আসলে পরে এসব বাক্স খোলা হবে। আমি একটি প্রশ্ন করলাম যে, সংবিধান যখন বাতিল হয়েছে তাহলে আমরা কিভাবে কাজ করব। আদালতই বা কিভাবে বসবে। জেলা প্রশাসক উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, উড়হঃ ধংশ ংসধৎঃ য়ঁবংঃরড়হ। ক্রমেই এগুলো বুঝতে পারবে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ এই সভাটি শেষ হয়ে গেল এবং বিভিন্ন কর্মকর্তারা তাদের নিজেদের দফতরের দিকে প্রস্থান করলেন। আমি ১০টার দিকে আমার দফতরে গেলাম এবং কিছুক্ষণের জন্য আদালতেও বসলাম। তবে কোন কাজকর্ম করার সুযোগ ছিল না। আইন-টাইন ঘাটিয়ে দেখলাম, ফৌজদারি প্রসিডিউর আইনে সময়ে সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে সামরিক বাহিনীকে পুলিশকে সহায়তা করার জন্য ডাকা যায় এবং সেখানে তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার খাতিরে কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ারও অধিকার দেয়া হয়। এ রকম ধরনের সামরিক শাসন কিছুদিন আগে লাহোর এবং পাঞ্জাবে জারি করা হয়েছিল। সেখানে সামরিক আদালতের ফাঁসি দেয়ারও ক্ষমতা ছিল এবং আগেই বলেছি যে, লাহোরের তদানীন্তন সামরিক শাসক মেজর জেনারেল আজম খান মওলানা মওদুদীকে মৃত্যুদণ্ডও দিয়েছিলেন। কিন্তু আইনে সারাদেশে সামরিক শাসন জারি করার কোন ক্ষমতা কাউকে দেয়া ছিল না। সেই হিসেবে রাষ্ট্রপতি জেনারেল মির্জা কোনমতেই এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি করতে পারতেন না। জেনারেল মির্জা তার ঘোষণায় আর একটি কথা বলেন যে, পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান হবেন প্রধান সামরিক শাসক ঈগখঅ (Chief Martial Lwa Administrator) এবং তার ডেপুটিদের তিনি বিভিন্ন প্রদেশে নিযুক্ত করবেন এবং পাকিস্তানের জনপ্রশাসনে সর্বোচ্চ পদাধিকারী সেক্রেটারি জেনারেল আজিজ আহমেদ হবেন অন্যতম Deputy Chief Martial Lwa Administrator। বুঝা গেল যে, দেশে পাঞ্জাবি স্বার্থান্বেষী একটি দুষ্টচক্র সামরিক শাসন জারি করেছে সারাদেশে তাদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যে। এটাও পরিষ্কার হয়ে গেল যে, এই সামরিক শাসনে পূর্ববাংলার কোনই অংশগ্রহণ থাকবে না। রাষ্ট্রপতি মির্জা কিন্তু তার কর্তৃত্ব খুব বেশিদিন বজায় রাখতে পারলেন না। সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান তাকে কিছুদিন পরেই কোয়েটায় গৃহবন্দী করেন এবং বেশ কিছুদিন আলোচনার পরে রাষ্ট্রপতি মির্জা চিরদিনের জন্য দেশত্যাগ করে লন্ডনে আশ্রয় নেন। তার থাকা-খাওয়ার জন্য তাকে বার্ষিক সম্ভবত ১২ হাজার পাউন্ড পেনশন দেয়ার ব্যবস্থা হয়। জেনারেল মির্জার কাছে এই বেতনটি সন্তোষজনক মনে হয়নি। তিনি তখনকার দিনে লন্ডনের বিখ্যাত প্রথম ভারতীয় উন্নতমানের রেস্তোরাঁ ভিরোশ্রামীতে জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই জেনারেলের লজ্জাশরম বলে কিছুই ছিল না। সে মীর জাফরের বংশোদ্ভূত ছিল বলে বাহাদুরি করত। আবার ভাল পেনশন নিয়ে একটি দেশের রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বিতাড়িত হবার পর একটি রেস্তোরাঁর জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্ব নিতে কোন অনীহা ছিল না। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বলেছি যে, ৫৭ সালে বিশেষ করে ন্যাপের উদ্যোগে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমাগত অস্থিতিশীল হতে থাকে। ২৩ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সংসদ অধিবেশনে এক নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ন্যাপ আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন সহযোগী ছিল, তারা হঠাৎ তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করল। তাতে সন্দেহের সৃষ্টি হলো যে আওয়ামী লীগ কি তখন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। পরিষদের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচিত স্পীকার আবদুল হাকিম চৌধুরী যুক্তফ্রন্টের দুটি বিবদমান দল কৃষক-শ্রমিক-প্রজা পার্টি এবং আওয়ামী লীগের কোনটিরই পক্ষে অবস্থান না নিয়ে অধিবেশন মুলতবি না করেই স্পীকার আসন ছেড়ে দিয়ে পরিষদ চত্বর ছেড়ে চলে যান। শূন্য আসনে নির্বাচিত ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী বসবার উদ্যোগ নেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগ দলের সদস্য। সেই সময়ই সংসদে হৈ-হুল্লা শুরু হয় এবং সংসদের কার্যক্রম বিঘিœত হয়। টানা-হেঁচড়ার ফলে ডেপুটি স্পীকার আহত হন এবং তাকে হাসপাতালে নেয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। চলবে...
×