ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

মার্কিন নির্বাচনের প্রতিক্রিয়া লঘু-গুরু সংবাদ

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

মার্কিন নির্বাচনের প্রতিক্রিয়া লঘু-গুরু সংবাদ

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়লাভের পর সারা দুনিয়াতেই একটা ছোটখাটো ভূমিকম্প হয়ে গেছে। এই বিজয়ে আমেরিকায় এক বিরাট অশ্বেতাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী বিক্ষুব্ধ। খুশি উগ্র শ্বেতাঙ্গ-জাতীয়তাবাদীরা। ভীত এবং কম্পিত ইউরোপের এলিট ক্লাস। চীন খুশি না হলেও ঝগড়া বাধাতে চায় না। তাই মৈত্রীর ডাক দিয়েছে। ভারত আগের মৈত্রী শুধু অক্ষুণœ রাখা নয়, তাকে আরও বাড়াতে চায়। পাকিস্তান ট্রাম্পের জয়লাভে খুশি। রাশিয়া খুব খুশি। বাংলাদেশ খুশি নয়, অখুশিও নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই নতুন প্রেসিডেন্টকে সস্ত্রীক বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। লন্ডনের সানডে টাইমস (১৪ নবেম্বর) ট্রাম্পের জয়লাভে বিশ্ব-প্রতিক্রিয়াকে সামারাইজ করেছে একটি সংবাদ শিরোনামে। ‘জঁংংরধ ড়ঢ়বহং ঃযব পযসঢ়ধমহব, পযরহধ যড়ঢ়বং ভড়ৎ ঃযব নবংঃ ধহফ ঊঁৎড়ঢ়ব’ং বষরঃং ঃৎবসনষব’ (রাশিয়া শ্যাম্পেনের বোতল খুলেছে। চীন আরও ভাল সম্পর্কের আশা করছে। ইউরোপের এলিট শ্রেণী শঙ্কায় কাঁপছে)। ব্রিটেনের ব্রেক্সিটের (নৎবীরঃ) পর ট্রাম্পের ভিক্টোরি ইউরোপকে গভীর শঙ্কা ও অনিশ্চয়তায় মুখে ফেলে দিয়েছে। অনেকের মনে প্রশ্ন, শরৎচন্দ্রের গল্পের ‘রামের সুমতি’ কি ঘটবে? প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও কি সুমতি ফিরে আসবে? অনেকেই আশা করছেন ফিরবে। ইতোমধ্যেই ট্রাম্প অনেক টোন ডাউন করেছেন। মেক্সিকো সীমান্তে সুউচ্চ ওয়াল নির্মাণের বদলে এখন বলছেন, বেড়া (ঋবহপব) দেবেন। মুসলমানদের আমেরিকায় ঢুকতে না দেয়ায় হুমকির পুনরাবৃত্তি তার কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে না। বরং নির্বাচন জয়ের পর তার শ্বেতাঙ্গ সমর্থকদের একাংশ তার বিরোধী অশ্বেতাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের উপর যে নির্যাতন চালাচ্ছে, তিনি তাতে ক্ষোভ প্রকাশ করে অবিলম্বে তা বন্ধ করার কথা বলেছেন। তবু মানুষের মন থেকে শঙ্কা যাচ্ছে না। জর্জ বুশ জুনিয়রের প্রেসিডেন্টগিরির আমলনামা দেখে বিশ্বের অনেক শান্তিকামী মানুষের মনে এই ভয় ঢুকেছে যে, সাপ খোলস বদলালেও চরিত্র বদলাবে না। ট্রাম্প অদূর ভবিষ্যতে একজন ভাল, না মন্দ প্রেসিডেন্ট হবেন, তা নিয়ে বিশ্বের রাজনৈতিক প-িতকুলের সিরিয়াস আলোচনা ও পর্যালোচনা এখনও শেষ হয়নি। আমিও ঢাকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই জাতীয় সিরিয়াস আলোচনা অনেক দফা করেছি। আজকের আলোচনায় ট্রাম্প-ভিকটোরির লঘুগুরু দু’দিকই একটু তুলে ধরতে চাই। ট্রাম্পের জয়ে সবচাইতে খুশি রাশিয়া। সানডে টাইমস (১৪ নবেম্বর) খবর দিয়েছে, গত বুধবার (১০ নবেম্বর) সকালে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে ট্রাম্পের জয়ের খবর রাশিয়ায় পৌঁছে, তখন রাশিয়ান পার্লামেন্টের নিম্ন পরিষদ ডুমার বৈঠক চলছিল। ডুমার একজন ডেপুটি ভাইসøাভ নিকোনোভ আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ঘোষণা করেন ‘প্রিয় বন্ধু ও সম্মানিত সহকর্মীবৃন্দ। তিন মিনিট আগে খবর এসেছে হিলারি ক্লিনটন তার পরাজয় মেনে নিয়েছেন এবং প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ভাষণ দেয়া শুরু করেছেন। আসুন, আমরা তাকে অভিনন্দন জানাই।’ তার বক্তব্য শেষ না হতেই রুশ পার্লামেন্টে আনন্দের হিল্লোল হয়ে যায়। রাশিয়ার আল্ট্রা ন্যাশনালস্টি নেতা ভøাডিমির জিরিনভোক্সি সঙ্গে সঙ্গে ১৩২ বোতল শ্যাম্পেনের অর্ডার দেন এবং মস্কোর পার্লামেন্টে ট্রাম্পের বিজয়োৎসব শুরু হয়। এই উল্লাস ও উৎসবের কারণ হিসেবে ইউরোপের অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন, রাশিয়ার খুশি হওয়ার এই আসল কারণ, তারা হয়ত মনে মনে আশা করছেন, ট্রাম্পের আমলে সুপার পাওয়ার হিসেবে আমেরিকার পতন শুরু হবে। যেমনটা হয়েছিল ইয়ালৎসিনের আমলে সাবেক সুপার পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়নের। ইতিহাসের কী পুনরাবৃত্তি, ইয়ালৎসিনের আগে রুশ-নায়ক গরবাচভ পশ্চিমা শক্তির মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করা সত্ত্বেও তাকে লাথি মেরে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ইয়ালৎসিনকে ক্ষমতায় বসাতে আমেরিকা সাহায্য যুগিয়েছিল। আর বর্তমানে সুপার পাওয়ার আমেরিকায় জাতীয় ঐক্য যখন বিভক্ত, বিশ্বময় আমেরিকার প্রভাবও পতনোণ¥ুখ, তখন ট্রাম্পের মতো এক বিতর্কিত ব্যক্তিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রকাশ্যে সমর্থন জুগিয়েছে পুতিনের রাশিয়া। হয়ত পুতিনের মনে গোপন আশা, ট্রাম্প যে নির্বাচনী অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, সেই অঙ্গীকার পুরণ করতে গেলে আমেরিকার জাতীয় ঐক্য নষ্ট করবেন এবং তার বিদেশ নীতিও বহির্বিশ্ব থেকে আমেরিকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। যদি তাই হয় তাহলে আমেরিকা তার সুপার পাওয়ার স্টেটাস রক্ষা করতে পারবে না। চাই কি ইউনাইটেড স্টেটসের বর্তমান কাঠামোতেও ভাঙ্গন ধরতে পারে। যেমন ধরেছিল ইয়ালৎসিনের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঐক্য ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে। জর্জিয়া, উজবেকিস্তান, ইউক্রেন, ক্রিমিয়া ইত্যাদি রাজ্য আলাদা হয়ে গিয়েছিল। আমেরিকার কয়েকটি রাজ্যেও বর্তমানে অত্যন্ত ক্ষীণকণ্ঠে হলেও বিচ্ছিন্নতাবাদী সুর শোনা যাচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় ট্রাম্পের নির্বাচন-বিজয়ের পরই ক্যালিফোর্নিয়ান ই-িপেন্ডেস ক্যাম্পেইনার নামে একটি ক্ষুদ্র গ্রুপ স্বাধীনতার দাবিতে অবলম্বে গণভোট অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছে। তাদের যুক্তি, ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতি ফ্রান্সের চাইতেও ভাল এবং তাদের জনসংখ্যা ইউরোপের কোন কোন দেশের চাইতে বেশি। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী কণ্ঠ আমেরিকায় এখন হয়ত ক্ষীণ। কিন্তু স্কটল্যান্ডের ইন্ডিপেল্ডেস দাবির মতো তা একদিন ব্যাপক হয়ে উঠতে পারে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প কি করবেন, ইউরোপের উদারনীতিকদের একটা বড় অংশই তা নিয়ে এখনও শঙ্কামুক্ত নন। ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর তার সমর্থকরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে তার সংখ্যা এ পর্যন্ত দু’শ’র বেশি। ট্রাম্প একদিকে এই সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন, অন্যদিকে তার এডমিনিস্ট্রেশনের চীফ স্ট্রাটেজিস্ট হিসেবে এক উগ্র শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীকে (যিরঃব ংঁঢ়ৎবসধপরংঃ) নিয়োগ দিয়েছেন। তার নাম স্টিফেন ব্যানন। ব্যানন জন্মনিয়ন্ত্রণের ঘোর বিরোধী, ফ্যামিনিজমকে ক্যান্সারের সঙ্গে তুলনা করেন এবং মুসলমানদের সম্পর্কে তার মন্তব্য, ‘মুসলমানেরা আমেরিকায় ল্যাম্প চপ, দই এবং গণধর্ষণ (মধহম ৎধঢ়ব) আমদানি করবে।’ আমেরিকার বিজয় ইউরোপের কট্টর ডানপন্থী এবং বর্ণবিদ্বেষী রাজনৈতিক দলগুলোকে খুবই উৎসাহিত করেছে। ফ্রান্সের বর্ণবাদী দল ফ্রন্ট ন্যাশনালের নেত্রী লে পেন বিবিসির এক সাক্ষাতকারে দম্ভের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন, ‘আগামী বছর আমি ফ্রান্সের নির্বাচিত প্রেসিডেনট থাকব।’ তার মতে, ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ব্রেক্সিট) ত্যাগের সিদ্ধান্তের পর আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় দ্বিতীয় বিশ্ব বিপ্লব। এই বিপ্লব সারাবিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি বদলে দেবে। এই ধরনের দম্ভোক্তি প্রকাশ করেছেন, ইউরোপের আরও কোন কোন ফ্যাসিবাদী নেতা। ডোনাল্ড ট্রাম্প কোন পথে এগুবেন তা এখনও নিশ্চিত নয়। যদি তার সুমতি ফেরে বিশ্ব একটি বিপর্যয় এড়াতে সক্ষম হবে। তিনি তা না পারলে সানডে টাইমসের ভাষায়- আমেরিকা এবং বিশ্ববাসীর সামনে এক ‘গ্রেট আনসারটেনিটি’ বা বিরাট অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। ইউরোপের এলিট ক্লাস তাই উদ্বিগ্ন। এশিয়ায়- বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশে এই উদ্বেগ কম। উপমহাদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের ধারণা, ট্রাম্প-হ্যারিকেন বা ঘূর্ণিঝড়ের গতি যতই প্রবল হোক, ভারত মহাসাগর পার হতে হতে তার বিপজ্জনক বেগ কমে যাবে অথবা ঝড় গতিপথ বদলাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন বিজয়ের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে একটু গুরু আলোচনাই করা গেল। এবার একটু লঘু আলোচনা করি। পাঠকদের কাছে একটু ক্ষমা চাই। এই লঘু আলোচনাটি আমার কল্পিত। তবে কল্পনাটি উর্বর মস্তিষ্কের ধারণা নয়। এমনটা হতে পারে বা হয়েছে এমনটা ভাবার একটা বাস্তব ভিত্তিও আছে। আমেরিকার নির্বাচনের ফল ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ঢাকায় এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তির বাসায় টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোনটি করেছেন বাংলাদেশের আরেক আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী এক ব্যক্তি। টেলিফোনে এই দ্বিতীয় খ্যাতিমান ব্যক্তির বিলাপ শোনা গেল, ‘হায় হায় হিলারি হেরে গেছেন। আমার শুধু ইনভেস্টমেন্ট নয়, সব আশা বরবাদ হয়ে গেল।’ ঢাকার খ্যাতিমান ব্যক্তি বললেন, ‘আপনি শুধু নিজের ক্ষতিটার কথাই ভাবছেন, আমি ভাবছি আমাদের কী হবে? হাসিনা নিশ্চয়ই মুচকি মুচকি হাসছেন!’ প্রথম ব্যক্তির গলায় শোনা গেল, ‘পৃথিবীর সব রাজ-রাজরাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক! শেষ পর্যন্ত এক পুঁচকে মেয়ের হাতে বার বার মার খাবো তা ভাবিনি। এখন কি করবেন ভেবেছেন?’ ঢাকার নেতা বললেন, ‘ভেবেছিলাম, হিলারির বিজয়ে অভিনন্দন জানিয়ে বিরাট একটা বিবৃতি দেব। খসড়াটা তৈরি করেও রেখেছিলাম। নিরপেক্ষ দৈনিক দুটি ফলাও করে ছাপবেও বলেছিল। আমার এই বিবৃতির পর সুশীল সমাজের অন্যরাও বিবৃতি দিতেন। এখন সব মাঠে মারা গেল।’ প্রথম ব্যক্তি বললেন, ‘হনুমানের লেজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম স্বর্ণলঙ্কা পোড়াবো বলে। সেই আগুনে নিজেদের মুখই পুড়ে গেল।’ দ্বিতীয় ব্যক্তি বললেন, হায় হায় করবেন না। দেখুন, ট্রাম্প-শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারেন কিনা। চেষ্টা করে দেখুন, হিলারিকে দিয়ে বাংলাদেশে যা করাবেন ভেবেছিলেন, ট্রাম্পকে দিয়ে তা করাতে পারেন কিনা।’ প্রথম ব্যক্তি বললেন, ‘ভারতের মোদিকে দিয়েও তো তা করাতে পারব ভেবেছিলাম। চেষ্টাও করেছি। মোদি পাত্তাই দিলেন না। ট্রাম্পতো মোদির চাইতেও শক্ত মানুষ। তাকে কি নড়াতে পারবো? ডিয়ার ফ্রেন্ড, আমি তার কোন আশা দেখছি না।’ [টেলিফোন সংযোগ হঠাৎ কেটে গেল। এই লঘু-গুরু আলোচনার পর পাঠকদের কাছ থেকে আপাতত: বিদায় চাই। [লন্ডন ১৫ নবেম্বর, মঙ্গলবার, ২০১৬]
×