ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ

৭১ বছরে ইউনেস্কো...

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

৭১ বছরে ইউনেস্কো...

যে বিশ্ব সংস্থাটি আমার অতি প্রিয় এবং শিক্ষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও শিক্ষার উন্নয়ন প্রয়াসে, মানবিকতার বিকাশ এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় যে প্রতিষ্ঠানটিকে আমি একান্ত নির্ভরযোগ্য মনে করি তার নাম ইউনেস্কো। আজ ১৬ নবেম্বর তার প্রতিষ্ঠা দিবস। সংস্থাটির একাত্তর বছর পূর্তিরও দিন। একই সঙ্গে এর গঠনতন্ত্রও আজকের দিনে স্বাক্ষর হয়। বিভিন্ন দেশের শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের কাছে ইউনেস্কো বিশেষভাবে আদৃত। এর পরিবেশিত তথ্য, পরিসংখ্যান ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রতিবেদন এবং সুপারিশ শিক্ষার উন্নয়নে, শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ও তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে, সংবাদ মাধ্যম ও মানবাধিকারের সংরক্ষণে, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঐতিহ্যসমূহ সুরক্ষায় ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করে আসছে। সাধারণ মানুষের কাছে ইউনেস্কোর জনপ্রিয়তা প্রবাদতুল্য। অনেকেই জাতিসংঘের বিশেষায়িত এ সংস্থাটির পুরো নামও হয়ত জানেন না। কিন্তু এর সৃজনধর্মী, জনহিতকর ও মানব উন্নয়নের অনুকূল অনেক কার্যক্রম সম্বন্ধে ধারণা রাখেন। বাংলাদেশে ইউনেস্কোর কার্যক্রম সবিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। বাংলা ও ইংরেজীতে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ মুদ্রণ, শিক্ষকদের অধিকার করণীয় ও মর্যাদা সংক্রান্ত ১৯৬৬ এবং ১৯৯৭ সালের সনদ বাংলায় প্রকাশ, বিশ্ব শিক্ষক দিবস জাতীয়ভাবে উদযাপনে সহযোগিতা প্রদান, ষাটগম্বুজ ও পাহাড়পুরের ঐতিহ্য স্মারকগুলো সংরক্ষণ থেকে শুরু করে মানব উন্নয়নের নানা কর্মসূচীতে ইউনেস্কোর অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করতে হয়। নানা প্রতিকূলতা ও বৃহৎ শক্তিগুলোর দিক থেকে সৃষ্ট বিভিন্ন সময়ের প্রতিবন্ধককে জয় করে ইউনেস্কো যেভাবে তার কার্যক্রম অব্যাহত ও অগ্রসরমান রেখে চলেছে তার উল্লেখ বা মূল্যায়ন স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। শিক্ষকপ্রিয় ইউনেস্কো বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের কাছে ইউনেস্কো বিশেষভাবে জনপ্রিয়। আবার ইউনেস্কোও শিক্ষকপ্রিয়। দশকের পর দশক কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে ইউনেস্কো বহুবার তার প্রমাণ রেখেছে। নতুন নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ১৯৬৬ সালে প্যারিসে ইউনেস্কোর উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের সরকারী প্রতিনিধিদের সভায় শিক্ষকদের মর্যাদা, অধিকার ও করণীয় সম্পর্কিত ১৪৫ সুপারিশমালা সংবলিত সনদ গৃহীত হয়। আবার বিভিন্ন পর্যায়ে সভা ও মতবিনিময়ের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ সভার ২৬তম অধিবেশনে ওইসব সুপরিবেশের সমর্থনে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শিক্ষার উন্নয়ন ও গুণগতমান নিশ্চিতকরণে শিক্ষকের করণীয় এবং তার দায়বদ্ধতার ওপর যৌক্তিক গুরুত্ব আরোপের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে, মিডিয়া এবং মানবাধিকারের সংরক্ষণে ইউনেস্কোর ভূমিকা অনন্য। বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক বৃহৎ শক্তিগুলোর দ্বন্দ্বের কার্যক্রম শ্লথগতি হলেও ব্যাহত বা বিপর্যস্ত হয়নি। পরিস্থিতির কৌশলী মোকাবেলা করে ইউনেস্কো তার উত্তরণ ঘটিয়েছে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার রক্তাক্ত সংগ্রামের স্মারক মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দানকারী এবং বিশ্বের ৬ হাজার ভাষাকে অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষাকারী ইউনেস্কো অব্যাহতভাবে তার কর্মকা-ের দিগন্তকে সম্প্রসারিত করে চলেছে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য হিসেবে আমার পক্ষে প্যারিসে এ বিশ্ব সংস্থার কার্যালয় পরিদর্শন, বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ও এর বহুমুখী কর্মকা- পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়েছিল। ২০১৪ সালে ইউনেস্কোর আমন্ত্রণে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত ‘টিচার এফেক্টিভনেস’ শীর্ষক সম্মেলনে যোগদান আমার অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে। ওই বছর ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভার ঢাকা সফরকালে আমার সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়। আমার সুযোগ হয় বাংলাদেশে শিক্ষার উন্নয়নে তার সঙ্গে মতবিনিময়ের। তিনি বাংলাদেশের প্রকৃত একজন শুভাকাক্সক্ষী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষা উদ্যোগ ও কার্যক্রমের প্রতিও তার ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। তিনি নিজেও শেখ হাসিনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রগতিশীল বিভিন্ন উদ্যোগ শিক্ষার উন্নয়নে ইউনেস্কো তার তৎপরতা ও কার্যক্রম শুধু অব্যাহতই রাখেনি, পূর্বের পদক্ষেপগুলোকে অতিক্রম করে গেছে। যথাযথভাবে বলতে গেলে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করে চলেছে। শতাধিক দেশের শিক্ষানীতি নিয়ে ২০১৬ সালের ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি প্যারিসে ইউনেস্কোর উদ্যোগে তিনদিনের আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামে উপস্থাপিত তিনটি বিষয়ের মধ্যে ছিল- স্কুল নেতৃত্ব, মূল্যায়ন ও পরিচালনা প্রক্রিয়া। এসব বিষয়ে ইউনেস্কো প্রকাশিত প্রতিবেদনের ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞগণ এ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন। প্যারিসের ওই সিম্পোজিয়ামের আগে বিগত বছর নবেম্বরের ৪ তারিখে ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে শিক্ষকনীতি প্রণয়নে উপস্থাপিত নির্দেশিকা বা প্রস্তাবনা নিয়ে দেশে দেশে শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মানুষের একটা বড় অংশ এখনও মতবিনিময় করে চলেছেন। দেখা যাচ্ছে, শিক্ষকনীতিকে অনেকে নতুন বিষয় মনে করছেন। তবে বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনায় বিশেষ করে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা এক বাক্যে বলছেন, শিক্ষকনীতির দরকার আছে। তারা মনে করছেন, এ কথা ঠিক, শিক্ষানীতির কথা শুনতে সকলে যতটা অভ্যস্ত, শিক্ষকনীতি সেক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে নতুন ভাবনা। সে সঙ্গে এ কথাও বলা হচ্ছে, শিক্ষকনীতি অতি সহজে, বিশেষ করে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষদের কাছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাদৃত হবে। যেসব দেশে শিক্ষকগণ বিভিন্ন বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার, তাদের কাছে এবং যেখানে শিক্ষকদের আচরণ নিয়ে অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষের অভিযোগ-অনুযোগ আছে, তারা উভয়ে শিক্ষকনীতিকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেখতে চাইবেন। বাংলাদেশে শিক্ষকদের কাছে এখন শিক্ষকনীতির সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের অধিনায়কত্বে শিক্ষক-অভিভাবক যৌথ উদ্যোগে স্কুল লিডারশিপ অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো এবং পাবলিক এ্যাডুকেশনে সর্বোচ্চ বরাদ্দের বিষয় গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হিসেবে পরিগণিত। বলাবাহুল্য, ইউনেস্কোর বিভিন্ন প্রস্তাবনা ও প্রকাশনা এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রসারণ ও মাধ্যমিক স্তর দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সম্প্রসারণের পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনেস্কোর শিক্ষায় অন্তর্বর্তী পরিকল্পনা গ্রহণের আবশ্যিক নির্দেশনামূলক সুপারিশের কার্যকারিতা নিয়েও ভাবতে সরকারের প্রতি শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা আহ্বান রাখছেন। ইউনেস্কোর নীতিগত অবস্থান ইউনেস্কোকে ঘিরে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। চল্লিশের দশকের শেষভাগে এবং পঞ্চাশের দশকের শুরুতে সোভিয়েত রাশিয়ার অভিযোগ ছিল, ইউনেস্কো বেশি মাত্রায় পশ্চিমা ঘেঁষা। আবার ইউনেস্কোর ‘নতুন বিশ্ব তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা’, বিশেষ করে ম্যাকব্রাইন্ড রিপোর্টের সংবাদ মাধ্যমের গণতন্ত্রায়ন এবং তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার আরও সুগম কথা বলায় পশ্চিমা দেশগুলো একে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের অপপ্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত করে। অব্যাহত প্রেরণার উৎস ইউনেস্কোর তথ্য পরিসংখ্যানের ব্যাপকতা ও নির্ভুলত্বে আমার আস্থা দীর্ঘদিনের। শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সঙ্কট মোকাবেলায়, জটিল সমস্যা নিরসনে এই বিশ্ব সংস্থাটির প্রগতিশীল উদ্যোগ ও কার্যক্রম অনেকের মতো আমার মনেও আশার সঞ্চার করে। দেশে দেশে শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষানীতি আলোচনা-পর্যালোচনা করে নতুন আলোর রেখাপাতে ইউনেস্কো এক কথায় অনন্য। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষকনীতির আবশ্যকতা, শিক্ষক-অভিভাবকের যৌথ ক্ষমতায়নের অপরিহার্যতা, শিক্ষার উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী পরিকল্পনার প্রস্তাবনা উপস্থাপন, সর্বোপরি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ মোকাবেলায় ও মানব উন্নয়নে শিক্ষায় পর্যাপ্ত বরাদ্দের যৌক্তিক উপস্থাপনার প্রাসঙ্গিকতায় ইউনেস্কোর ভূমিকা কালজয়ী। লেখক : চেয়ারম্যান, আইএইচডি [email protected]
×