ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধী বিচার

বড়লেখার তিন আসামির বিরুদ্ধে ৫ অপরাধের প্রতিবেদন চূড়ান্ত

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৫ নভেম্বর ২০১৬

বড়লেখার তিন আসামির বিরুদ্ধে ৫ অপরাধের প্রতিবেদন চূড়ান্ত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৌলবীবাজারের বড়লেখার তিন আসামির বিরুদ্ধে অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যা ও গণহত্যার মতো পাঁচ অপরাধের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। আসামিরা হলো, আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুল (৬৪), মোঃ আব্দুল মতিল (৬৩) ও মোঃ আব্দুল মান্নান ওরফে মনাই। তিন রাজাকারের প্রতিবেদনটি সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে দাখিল করা হয়েছে। অন্যদিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে নোয়াখালীর সুধারামপুরের পাঁচ রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের চতুর্থ সাক্ষী মোঃ আবুল কালাম জবানবন্দী প্রদান করেছেন। জবানবন্দীতে সাক্ষী বলেন, রাজাকার ও পাকিস্তানী আর্মিরা আমাদের বাড়িসহ আমাদের গ্রামের অন্যান্য বাড়িঘরে হত্যাকা-, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা আক্রমণ চালিয়ে আমাদের উঠানে নিরপরাধ লোকজনকে জড়ো করে গুলি করে হত্যা করে। সাক্ষীর জবানবন্দী শেষে জেরা করার জন্য আজ মঙ্গলবার দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ প্রদান করেছে। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান সোমবার ধানম-িতে তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মৌলবীবাজারের বড়লেখার তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর এ মামলার তদন্ত শুরু করেন তদন্ত সংস্থার সহকারী পরিচালক মোঃ শাহজাহান কবির। ৪০ জনের জবানবন্দী শুনে ৮৯ পৃষ্ঠার নথি সংগ্রহ করে চার ভলিউমে ২৫০ পৃষ্ঠার এই তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে এ মামলায় মোট ২৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে বলে হান্নান খান জানান। তদন্ত সংস্থা বলছে, আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুল ও মোঃ আব্দুল মতিন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে পালিয়ে বড়লেখায় এসে তারা হানাদার বাহিনীর কাছে আতœসমর্পণ করে এবং রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। চলতি বছর ২ মার্চ গ্রেফতার হওয়ার আগে আব্দুল আজিজ বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। আর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে জড়িত মতিন এখনও পলাতক বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। আরেক আসামি আব্দুল মান্নান ওরফে মনাই ১৯৭১ সালে জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন বলে তদন্ত সংস্থার ভাষ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বড়লেখা থানা শান্তি কমিটির সদস্য হন এবং রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। চলতি বছর ২ মার্চ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করে। তদন্ত সংস্থা তাদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ এনেছেন। এর মধ্যে প্রথম অভিযোগে রয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৯ মে আসামিরা মৌলবীবাজার জেলার বড়লেখা থানার ঘোলসা গ্রাম থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) নেতা হরেন্দ্র লাল দাস ওরফে হরিদাসসহ মতিলাল দাস, নগেন্দ্র কুমার দাস এবং শ্রীনিবাস দাসকে অপহরণ করেন। তিন দিন বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতনের পর জুরি বাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে হরেন্দ্র লাল দাস ওরফে হরিদাসসহ মতিলাল দাস, নগেন্দ্র কুমার দাসকে হত্যা করে। শ্রীনিবাস দাস কোনক্রমে প্রাণে বেঁচে যান এবং দুদিন পর বাড়ি ফিরে আসেন। দ্বিতীয় অভিযোগে রয়েছে, ১৯৭১ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে, আসামিরা বড়লেখা থানার বিওসি কেছরিগুল গ্রাম থেকে সাফিয়া খাতুন ও আবদুল খালেককে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আসামিরা সাফিয়া খাতুনকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পরে শাহবাজপুর রাজাকার ক্যাম্প ও বড়লেখা সিও অফিসে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়েও সাফিয়া খাতুনকে ধর্ষণ করা হয়। ৬ ডিসেম্বর বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা সাফিয়া খাতুনকে সিও অফিসের বাংকার থেকে উদ্ধার করে। তৃতীয় অভিযোগ, ১৯৭১ সালের ১৩ নবেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার পাখিয়ালা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মঈন কমান্ডারের বাড়িতে হামলা করে বাড়ির মালামাল লুটপাট করে। রাজাকাররা মঈনের বাবা বছির উদ্দিন, নেছার আলী, ভাই আইয়ুব আলী ও ভাতিজা হারিছ আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতন করে। ৬ ডিসেম্বর বড়লেখা হানাদার মুক্ত হলে তারা মুক্তি পান। চতুর্থ অভিযোগে রয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৪ নবেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার হিনাই নগর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মস্তকিন কমান্ডারের বাড়িতে হামলা করে। মস্তকিনকে না পেয়ে তার ভাই মতছিন আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে তারা। নির্যাতনের ফলে মতছিন আলীর পা ভেঙ্গে যায়। আসামিরা মস্তকিন ও মতছিন আলীর বাড়ির মালামাল লুট করে তিনটি টিনের ঘর পুড়িয়ে দেয়। পঞ্চম অভিযোগে রয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৭ নবেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার ডিমাই বাজার থেকে মুক্তিযোদ্ধা মনির আলীকে আটক করে। তাকে সঙ্গে নিয়ে তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা হাবিব কমান্ডারকে আটক করার জন্য বাড়িতে হামলা করে তারা। সেখান থেকে আসামিরা মনির আলী ও তার স্ত্রী আফিয়া বেগমকে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে আসামিরা আফিয়া বেগমকে ধর্ষণ করে। হাবিব কমান্ডার ও মনির আলীর বাড়ির মালামালও লুট করা হয়। নোয়াখালীর ৫ রাজাকার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে নোয়াখালীর সুধারামপুরের পাঁচ রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের চতুর্থ সাক্ষী মোঃ আবুল কালাম জবানবন্দী প্রদান করেছেন। জবানবন্দীতে সাক্ষী বলেন, রাজাকার ও পাকিস্তানী আর্মিরা আমাদের বাড়িসহ আমাদের গ্রামের অন্যান্য বাড়ি ঘরে হত্যাকা-, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা আক্রমণ চালিয়ে আমাদের উঠানে জড়ো করা মানুষদের গুলি করে হত্যা করে। সাক্ষীর জবানবন্দী শেষে জেরা করার জন্য আজ মঙ্গলবার দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল -১ এ আদেশ প্রদান করেছেন। সাক্ষী তার জবানবন্দীতে বলেন, আমার নাম মোঃ আবুল কালাম, আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৬৫ বছর। আমার ঠিকানা-গ্রাম-সোনাপুর, থানা-সুধারাম, জেলা-নোয়াখালী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ২১ বছর। তখন আমি আমার বাড়ির পাশে চায়ের দোকানে কাজ করতাম। বর্তমানে আমি রিক্সা চালাই। ১৯৭১ সালের ১৫ জুন দুপুর আনুমানিক দুইটা আড়াইটার সময় আমি আমার বাড়িতে ছিলাম। এই সময় আমাদের প্রতিবেশী এক বৃদ্ধ মহিলা আমাদের বাড়িতে এসে আমাদের বলে যে, তোমরা বাড়ি থেকে চলে যাও, সোনাপুর প্রধান রাস্তায় পাকিস্তান আর্মি ও রাজাকাররা এসেছে। এর পর দেখি ২০/৩০ জন পাকিস্তান আর্মি ও রাজাকাররা আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছে। সাক্ষী বলেন, আমি তখন ভয়ে পালানোর জন্য উঠান থেকে পূর্ব দিকে দৌড় দিলে তারা আমাকেও গুলি করে। ঐ গুলি আমার বাম হাতের বাহুতে এবং বাম পাঁজরে লাগলে আমি গুরুতর জখম হই। (এ সময় এই সাক্ষী তার বাম বাহুতে এবং বাম পাঁজরে গুলির আঘাতজনিত জখমের চিহ্ন ট্রাইব্যুনালকে দেখান)। একাত্তরের ১৫ জুন নিহত শহীদদের স্মরণে আহমেদীয়া স্কুলের সামনে এবং মাইজদী শহীদ মিনারের পাশে স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়েছে।
×