ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

বাংলাদেশ কি শুধু বনপোড়া হরিণীর মতো চিৎকার করবে?

প্রকাশিত: ০৪:০০, ১৫ নভেম্বর ২০১৬

বাংলাদেশ কি শুধু বনপোড়া হরিণীর মতো চিৎকার করবে?

(গতকালের সম্পাদকীয় পাতার পর) মুসলমানদের ট্রাম্প আমেরিকায় ঢুকতে দেবেন না, এটি জেনেও একজন মুসলমান নারী হয়ে তিনি কীভাবে একথা বলেন? তিনি জানালেন, সেটি কথার কথা। প্রতিক্রিয়াশীলতার দৃষ্টিভঙ্গি দেখুন। খচ্চর জেনেও শ্বেতাঙ্গরা, মধ্যবিত্তরা তাকে ভোট দিয়েছে। আসলে লড়াইটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল শ্বেতাঙ্গ বনাম অশ্বেতাঙ্গ। বারাক ওবামা শ্বেতাঙ্গ নয়, তাকে ৮ বছর সহ্য করা গেছে আর নয়। স্বদেশ রায় যে লিখেছেন, কর্পোরেট রাজত্ব আর মার্কিনীরা চাইছে না সেটা কতটুকু ঠিক। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী দু’জনই কর্পোরেটের প্রতিনিধিত্ব করেন, শিক্ষিত উদারনৈতিকরা কর্পোরেটবিরোধী হতে পারেন যেমনÑ বার্নি স্যান্ডার্স, সেটিও একটি পর্যায় পর্যন্ত কিন্তু ট্রাম্পের ভোটাররা! এইসব বেকারকে চাকরি ও চিকিৎসার সংস্থান করেছেন ওবামা, ট্রাম্প তার বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু তাদের ভোটই পেয়েছেন ট্রাম্প। ট্রাম্প ককেশীয়দের চান, হিটলার যেমন চেয়েছিলেন আর্যদের। ব্রিটেনও প্রায় একই কারণে ইউনিয়ন ছেড়েছেÑ অভিবাসী। অভিবাসীদের একটি বড় অংশ মুসলমান। এদের আশ্রয় দিচ্ছে পাশ্চাত্য, মুসলমানরা নয়, কারণ, যত তত্ত্বই আওড়ান মানবিকতা দেখাতে পারেনি কোন মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্র। ইউরোপেও খ্রীস্টান শ্বেতাঙ্গ ‘বিপ্লব’ দেখা দেবে। এই বর্ণবাদ, ধর্মের প্রতি অন্ধতাÑ এসব কিছু আবার সারা বিশ্বে হয়ত নতুন এক ব্যবস্থা তৈরি করবে যার ভিত্তি হবে বর্ণ ও ধর্ম। এর প্রভাব পড়ছে আমাদের দেশে, ভারতে, পাকিস্তানে। এমন যদি হতো, ব্রিটেন-আমেরিকায় যা ঘটছে তা আমাদের স্পর্শ করত না। তা হলে ঠিকই ছিল। কিন্তু এর অভিঘাত তো পড়েছে, পড়বেই। হতাশা ও ক্লান্তি সে জন্যই। নাসিরনগরে যা ঘটল তাতে সরকার ও ১৪ দলের সম্মান একটুও বাড়েনি। উন্নয়ন এজেন্ডাও এ ঘটনায় চাপা পড়ে গেছে। এতবড় একটি পূজা হলো, কাউন্সিল হলো, কিছুই ঘটল না, তারপর হঠাৎ নাসিরনগরের ঘটনা। আওয়ামী লীগের বা এমপিদের কোন্দলের কারণে এটি ঘটছে বোঝা যায়। হেজাবিদের নীলনকশায় পা দিচ্ছে এই সব কোন্দলকারী। বদনাম হচ্ছে আওয়ামী লীগের। এসব ঘটনা সরকারের ওপর আস্থা সৃষ্টি করে না। বিচার-শাস্তি হলেও খানিকটা ক্ষোভ থেকে যায় মনের ভেতরে এবং অবশ্যই কখনও না কখনও তার প্রকাশ ঘটবে এবং ঘটলে কী হতে পারে ট্রাম্পের নির্বাচন তার প্রমাণ। বারাক ওবামার সময় শ্রমিকদের মান উন্নয়ন হয়েছে, অর্থনীতিরও; বিন লাদেনকে ধরা হয়েছে কিন্তু ডেমোক্র্যাটদের আত্মতৃপ্তি, বিভিন্ন স্ক্যান্ডালে হিলারির জড়িয়ে পড়াÑ এসবের প্রতিক্রিয়া হয়েছে যা আত্মতৃপ্ত ডেমোক্র্যাটরা বুঝতে পারেনি। অর্থাৎ, উন্নয়নই সবকিছু নয়। আওয়ামী লীগের যে কোন কার্যক্রম শুরু বা প্রতিশ্রুতি কার্যকর করার বিষয়টি চমৎকার এবং প্রশংসনীয় কিন্তু ফিনিশিং-এ সব গোলমাল করে ফেলা হয় এবং সব অর্জন বারাক ওবামার কালের মতো বৃথা হয়ে যায়। কাউন্সিলের আগে যত রটনা ছিল সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ, অনেকে আশা করছিলেন এবং আশঙ্কাও যে, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য ও তাদের বন্ধুরা গুরুত্বপূর্ণ পদ পাবেন। পেলে, সারাদেশে হৈহুল্লোড় শুরু হয়ে যেত এবং তাদের পচিয়ে ফেলা হতো। খালেদার ক্ষেত্রে যেটি হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা সে দিকে পা দেননি। সমালোচনার সব পথ বন্ধ। এত সুন্দর কাউন্সিল হলো, সমস্যা ছাড়া নতুনরা এলেন, প্রশংসা যখন উপচে পড়ছে তখন প্রেসিডিয়াম ও সম্পাদক পদে এমন কয়েকজনের নাম এলো এবং পত্র-পত্রিকায় তাদের সম্পর্কে যা লেখা হলো তাতে হঠাৎ সবাই থমকে গেলেন। অবশ্য, পত্র-পত্রিকায় না লিখলেও তাদের কীর্তিকলাপ কারও অজানা নয়। এরকম দু’চারজন না নিলে কিছু আসে যেত না। কিন্তু বার্তা গেল, আওয়ামী লীগ একেও অ্যাকোমেডেট করে। তখন নেতাদের ‘কঠোর হুঁশিয়ারি’তে কেউ কর্ণপাত করে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থাটা হয়েছে তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার গল্পের মতো। তার আমলে বাংলাদেশের যা অর্জন তা গত ৪০ বছরে হয়নি; এবং সে সব অর্জন দৃশ্যমান। একেকটি অর্জনে যখন তিনি নন্দিত হচ্ছেন তখনই এমন ঘটনা ঘটছে যে আবার বাঁশে ওঠার মকশো করতে হয়। কিন্তু দু’বছরে বিভিন্ন ঘটনা এবং এখন নাসিরনগরের ঘটনাটি এরকম উদাহরণ। এখন মিডিয়ার প্রথম খবর নাসিরনগর। এরপর গোবিন্দগঞ্জ। শেখ হাসিনার আমলে কি এমন ঘটনা প্রত্যাশিত? পুলিশ যেখানে যায় সেখানে তার সহযোগী বাহিনীর মতো কিছু তরুণ থাকে। এরা কারা? এ সব প্রশ্ন কি ধমক দিলে থেমে যাবে? এক সপ্তাহ হলো গোবিন্দগঞ্জের মানুষজন ঘর ছাড়া ও অভুক্ত। সেখানে ডিসি-কমিশনার কি আঙ্গুল চুষছেন? স্থানীয় সংসদ সদস্য? স্থানীয় দলপতিরা? সবাই কি এই প্রান্তিক মানুষদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ? এসবের দায়-দায়িত্ব কিন্তু পড়ে দল ও সরকারের ওপর এবং প্রধানমন্ত্রীর ওপর। তিনি গোবিন্দগঞ্জে দল পাঠাতে বলেছেন কিন্তু দলের অন্য নেতাদের এবং সম্পাদকদের অপেক্ষা করতে হলো তার নির্দেশের জন্য। সবাই নিশ্চিত যে এসব ঘটনা যাতে না ঘটে তা দেখার জন্য প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের রাখা হয়েছে। তাদের ওপর কখনও দায় চাপে না। জনমত সোচ্চার হলে তাদের বদলি করা হয়। বদলি কোন শাস্তি নয়। তাদের পদাবনতি বা বিচারের মুখোমুখি করা হলে দৃশ্যপট বদলে যাবে। এ কথা বলার নিশ্চয়ই কারণ আছে। সরকারের যে আমলাতন্ত্র, যার ওপর মানুষের চেয়ে বিশ্বাস ও নির্ভরতা সরকারের বেশি, সে আমলাতন্ত্রের মৌল চরিত্র পাকিস্তান আমলের মতোই। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে যারা আছেন বা যারা দলীয় নেতা সেটি তারা বুঝবেন না। তার ওপর, এখন তো মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ এলে আমলারা কেঁদে ফেলেন। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীরা হয়ত তাতেই খুশি। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা প্রায় প্রতিটি আমলা মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট কোন বিষয় এলেই তা আটকে দেন। এবং তাদের কোন বিচার হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্মারকের সোনা চুরির বিচার কি সরকার করতে পেরেছে? মোটেই না সে সাহসই হয়নি। দেশের সম্পদ বা জমি চাহিবামাত্র সামরিক বা বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে যত সহজে দেয়া যায় সেটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে বা বীরাঙ্গনা পরিবারকে দেয়া যায় না। আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সমঝোতা করার ঝোঁকটা বেশি। যে কারণে, অন্তর্ভুক্তকরণের নামে জামায়াত থেকে আদর্শবিরোধী প্রচুর মানুষকে আওয়ামী লীগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। হেজাবিদের জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ভালবাসা যতটুকু তা তার পক্ষের মানুষজনের প্রতি তেমন আছে কিনা সন্দেহ। আওয়ামী লীগে একটি থিয়োরি আছে, পুরস্কৃত করে বিরোধীদের দলে টানার চেষ্টা। এটা যে কী বিশাল মূর্খতা বলার নয়। আর এর ফল আওয়ামী লীগকে পেতে হয়। অবশ্য, অন্যভাবেও বিষয়টি দেখা যেতে পারে। উদারবাদ বা লিবারালিজম অন্তর্ভুক্তিকরণ পছন্দ করে, সে কারণে, অনেকে এর সুযোগ নেয় এবং উদারবাদকে প্রতিক্রিয়ায় রূপান্তর করে। প্রতিক্রিয়া কিন্তু সে প্রশ্রয় দেয় না। বিএনপি জামায়াত আমলে, প্রচুর মানুষ পাঁচ বছর তাদের বাড়িঘরে যেতে পারেনি, আওয়ামী লীগ আমলে, বিএনপিমনা অনেকে স্থানীয় সরকারে অধিষ্ঠান করছেন। বিএনপি-জামায়াত আমলে আওয়ামী ব্যবসায়ী ছাড়া কাউকে ছাড় দেয়নি। তুর্কির জামায়াত প্রেসিডেন্ট ব্যর্থ ক্যুর পর প্রায় লাখখানেক মানুষকে বরখাস্ত করেছেন, পত্র-পত্রিকা বন্ধ করেছেন। একমাত্র মিসরে একটি পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ায় মিসরী জামায়াতীরা ঠা-া হয়েছে। নাসিরনগরের মতো প্রায় প্রতিটি ঘটনায় হেজাবিরা যুক্ত। কিন্তু কখনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে হাইব্রিড আওয়ামীরাও যুক্ত। ২০০১ সালে যে সহিংসতা হয়েছিল তা নিয়ে মামলা হয়েছে, সরকার শাহাবুদ্দীন চুপ্পুকে দিয়ে তদন্ত কমিটি করেছে, কমিটির রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। সরকার আজ পাঁচ বছরেও সে রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। ঐ রিপোর্ট প্রকাশিত হলে প্রতিদিন বিএনপির মু-ুপাত করতে হতো না। এমনকি মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন নাসিরনগর গিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে পারতেন না। আমাদের এমবেডেড সাংবাদিকদের কারও সাহস হয়নি হাফিজউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করার যে, ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত হাফিজউদ্দিন যে তা-ব চালিয়েছেন তার জবাব কী? যে সব মামলা হয়েছিল সেগুলোর নিষ্পত্তি হয়নি। যে সব আমলা এসবের জন্য দায়ী ছিল তাদের বিরাট অংশের কোন কিছুই হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে সব মন্ত্রণালয়ে ঐসব আমলার পোস্টিং হয়েছে এবং হচ্ছে। আরও পরে ১/১১-এর কারও বিচার হয়নি। উচ্চ আদালত অনেক পরামর্শ দেন বটে, কিন্তু ১/১১ এ যারা জুডিশিয়ারি সম্মানহানি করেছে কখনও তাদের সরায়নি প্রমোশন দেয়া ছাড়া। জুডিশিয়ারিতে যদি স্বচ্ছতা আনতে হয় তা হলে ১/১১-তে যারা নির্দেশিত হয়ে রায় দিয়েছে, তাদের ব্যাপারে কেন প্রধান বিচারপতি কিছু বলেন না বা ব্যবস্থা নেন না? তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী বিচারের আর দরকার নেই। এটি তো তার এখতিয়ারে পড়ে না, এটির এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বা আমাদের মতো আম-জনতার। এর ফল কী হয় তা বলি। ওবামার আমলে উদারনীতির ধারক হিসেবে অনেক রিপাবলিকানকে পদ দেয়া হয়েছে। তার একজন কর্মী যিনি রিপাবলিকান এবং রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের অধীনে চাকরি করেছেন। মিডিয়াও তার কর্মদক্ষতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশংসায় মত্ত। তিনি ঠিক সময়ে তীরটি ছুড়লেন। হিলারির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে হিলারির পক্ষে যে টেম্পো উঠেছিল তা নস্যাত করে দিলেন। কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে বা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যে সব নতুন মুক্তিযুদ্ধপ্রেমীকে প্রমোশন দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে তারা কি প্রধানমন্ত্রীর বা সরকারের অসাম্প্রদায়িকতা বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোন সিদ্ধান্তে রাজি হবেনÑ না বাধা দেবেন? যিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি কি রাজাকারদের বিচার চাইবেন? পাগল এবং আওয়ামী লীগের ডানপন্থায় বিশ্বাসী নেতারা ছাড়া এটি কেউ সঠিক বলবেন না। আরও আছে, জামায়াত নিষিদ্ধ করার দাবি আওয়ামী লীগ থেকেও উঠেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও করেছেন। আইনমন্ত্রী বলেছেন, আইন প্রস্তুত কিন্তু দেখা যাচ্ছে কেবিনেট প্রস্তুত না। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াফতের দাবি উঠেছে। আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠও তাতে একমত। আইনও তৈরি কিন্তু কেবিনেট তৈরি না। এতে এক ধরনের অনাস্থা সৃষ্টি হয় ভিকটিমদের মধ্যে যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক। আর যারা আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলতে চায় তাদের কাছে বার্তা যায়Ñ ব্রাদার চালিয়ে যাও। কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়া হবে। তবে চালিয়ে যাও। এ কথা বলার কারণ কী? রামু থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এ ধরনের যত ঘটনা ঘটছে, সব ক্ষেত্রে বলা হয়েছে তদন্ত হচ্ছে, গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু স্ট্যাটিসটিকস নিয়ে বলুনতো ঠিক কয়টা ঘটনার বিচার হয়েছে। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের সন্ত্রাস দমন আইন/দ্রুত বিচার আইনে বিচার করলে এবং গুরুতর শাস্তি হলে এ ধরনের ঘটনা হ্রাস পেত। এ মন্তব্যের কারণ কী? নাসিরনগরের ঘটনার পরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে যা কালের কণ্ঠ ছাড়া আর অন্য কোন সংবাদপত্রে আসেনি। ফরিদপুর ও সাটুরিয়ায় প্রতিমা ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। ফেসবুকে কাবা শরীফের বিকৃতায়নেরও ঘটনা ঘটেছে। এখানে একটি প্রশ্ন জাগে। ফেসবুকে এসব বিকৃতায়ন কেন খালি প্রান্তিক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ফেসবুকে থাকে? মুসলমানের নয়? যেখানে হিন্দুরা ভীত থাকে সারাক্ষণ [মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের/বিএনপির নেতা ছাড়া] তাদের মধ্যে একেবারে যারা প্রান্তিক তাদের ফেসবুকে এসব থাকবে? বাংলাদেশের পুলিশ ছাড়া দক্ষ ও শিক্ষিত কোন পুলিশ ফোর্স তা বিশ্বাস করবে কিনা সন্দেহ। এবং তখন তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে সে নির্দোষ প্রমাণিত হয়। কিন্তু তার যা গেছে তাতো ফেরত আসে না, পুলিশ বা আমলার তো কিছু হয় না যারা এরকম কথায় কথায় গ্রেফতার করে। একটি কথা আমরা বার বার বলে আসছি কিন্তু সরকারী রাজতীতিবিদরা মনে করেন, আমরা রাজনীতি বুঝি না। যেন, যারা রাজনীতি করছেন তাদের বয়স আমাদের থেকে বেশি বা শিক্ষা দীক্ষা বুদ্ধি মত্তায় বেশি। দেশকে মর্যাদায় নিতে পারে অর্থনৈতিক উন্নয়ন যা শেখ হাসিনা করেছেন। কিন্তু সে উন্নয়নকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য এবং ভিত্তি মজবুত করার জন্য দরকার সে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি যা প্রধানমন্ত্রীর আছে। এবং এ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে শিক্ষা সংস্কৃতির সমান উন্নয়নের সঙ্গে। আমরা যে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি তার কারণ ঐ দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থাৎ অর্থনৈতিক জিডিপি বৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষা সংস্কৃতির জিডিপি বৃদ্ধি করতে হবে। সরকার বলবে, পাসের হার ও জিপিএ ৫-এর সংখ্যা বেড়েছে। উত্তম, তা হলে, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ৩ থেকে ৫% মাত্র পাস করছে কেন? একমুখী শিক্ষা না হোক পাঁচমুখী শিক্ষা তো হতে পারে। সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিত পাশ্চাত্য পোশাক পরিহিত স্পেশালিস্ট নিদান কেন, মাদ্রাসার বইয়ে অমুসলিম নাম থাকতে পারবে না, সেখানে ছেলেমেয়েদের হিজাব ও পাজামা পরাতে হবে, জীবনানন্দ দাশসহ কোন হিন্দু কবির কবিতা থাকবে না তখনতো সরকার নিশ্চুপ থাকে। তার মানে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র কথার কথা। মাদ্রাসাদের খুশি রাখতে হবে, হেফাজতিদের খুশি রাখতে হবে, অর্থবানদের খুশি রাখতে হবে, সেনাবাহিনীকে খুশি রাখতে হবে, সেক্রেটারিয়েটের আমলাদের খুশি রাখতে হবে, পুলিশকে খুশি রাখতে হবে, র‌্যাবকে খুশি রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যারা আছে তাদের খুশি না রাখলেও চলবে, সুলতানা কামালদের মানবাধিকার নিয়ে কথাবার্তায় কান দেয়া যাবে না, বুদ্ধিজীবীরা আবার কী? সুলতানা কামাল যতই চিৎকার করুন তিনি তো ভোট আওয়ামী লীগকেই দেবেন, বিএনপিকে নয়। অন্যরাও তাই। ভুলটা হচ্ছে এখানেই। মানুষ এখন বড় সচেতন হয়ে উঠছে তাও শেখ হাসিনার শাসনামলের নানা অর্জনের কারণে। হিলারি যে হারলেন তার একটি কারণ, স্যান্ডার্সের অনেক সমর্থক ভোটকেন্দ্রে যাননি। হিসপানিক ল্যাটিনো এমনকি আফ্রিকান-আমেরিকানরাও অনেকে ভোটকেন্দ্রে যাননি, অন্তত যে সব রাজ্যে যাওয়ার দরকার ছিল। তারা ডেমোক্র্যাটদের সমর্থক। কিন্তু নানা ঘটনায় ক্ষুব্ধ, হতাশ। তারা এ মতে পৌঁছেছেন যা হবার হবে, সামগ্রিকভাবে বিষয়টি দেখেননি। এবং যা হবার হলে যে তিনিও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সে কথা তার মনে হয়নি। ট্রাম্পের সমর্থকদের মনে হয়েছে যে যা বলুক ট্রাম্পকেই আমার চাই, সে খচ্চর হলেও আমার খচ্চর। তাদের খচ্চর নিয়ে তারা রেসে জিতেছে। ঘোড়া নিয়েও ওবামা পারেননি। ২০১৯ সালে যারা ভোট দেবে তাদের একটি অংশ শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উন্নয়ন কালে বড় হয়েছে। তাদের আগের প্রজন্মও এই উন্নয়নে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। একটা সময় এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংখ্যাগরিষ্ঠকে অবাক করবে না। মনে হবে এটি তো স্বাভাবিক ছিলই। আমাদের কাছে যা অর্জন মনে হয়েছে তা তাদের কাছে অর্জন মনে হবে না। উন্নত দেশের মানুষজনকে কি মনে করে তাদের দেশের অর্জন হয়েছে। সেটি স্বাভাবিকই মনে হয়। কিন্তু মানুষের মনে থাকে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত অপমান। ছাত্রলীগের যে ছেলেটি অন্য একটি ছাত্রকে চড় মারল বা শিক্ষককে অপমান করল, চড় খাওয়া তরুণ এবং তার বন্ধুরা সেটি মনে রাখে এবং দায় চাপায় ছাত্রলীগের ওপর। যুবলীগের যে ছেলেটি চাঁদাবাজির বা টেন্ডারবাজির নিয়ন্ত্রক তাকে ব্যবসায়ীরা মনে রাখে। অর্থনৈতিক ক্ষতি কেউ কখনও মেনে নেয় না। উপজেলায় বা জেলায় সংখ্যা হিসেবে মনোনীত এমপি যাদের এখন হাইব্রিড বলা হয় বা তার নতুন বলয়কে ঘেন্না করবে যারা বহুদিন ধরে দল করে আসছে। সিলেট থেকে গত রাতে আমাকে একজন ফোন করে জানালেন একটি জেলায় তার বাবা আওয়ামী লীগের একজন প্রতিষ্ঠাতা, তারা পুরো পরিবার আওয়ামী লীগার, কিন্তু কখনও তাদের ‘মূল্যায়ন’ করা হয়নি। নতুন যিনি এসেছেন তার ও তার অনুচরদের কারণে তারা এখন নিষ্ক্রিয় এবং ভোটে তাদের ইচ্ছা নেই। আমাদেরও কি ভাল লাগে যখন দেখি প্রধানমন্ত্রীর বিপদকালে যারা বিদেশ চলে গিয়েছিলেন, তার পক্ষে দাঁড়াননি, তিনি ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাদের গাড়িতে পতাকা, কেউ উপাচার্য। কেউ চেয়ারম্যান বা বড় ব্যবসায়ী। এখানে লেনদেন বা চাওয়া পাওয়ার ব্যাপার নয়। এক ধরনের অবিচার লুকিয়ে আছে। এটি কেউ পছন্দ করে না কিন্তু সামগ্রিকতার খাতিরে সেটা মেনে নেয়। হিন্দুদের মনে হয়, বিএনপি আমলে যা ছিল এখনও তাই আছে, পার্থক্যটা কী? সবচেয়ে ভাল ভোট কেন্দ্রে না যাওয়া। গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের হেনস্থা করছে, পত্রিকার খবর অনুযায়ী স্থানীয় সাংসদ। ওবায়দুল কাদেরের হুঙ্কার সত্ত্বেও তো তারা দিব্যি আছেন। তখন এই হুঙ্কার হাস্যরসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই বেদনা, দুঃখবোধ থেকেই যায়। কারণ, বিপদ যখন আসবে, তখন এরা আবার বিদেশ চলে যাবেন। শোনা যায় অধিকাংশের বাড়িঘর নির্মাণ হয়েছে। এখন সুসময়, তারা আছেন, যেন প্রবাসে ছুটি কাটাচ্ছেন, বিপদে তারা বাড়ি ফিরে যাবেন। যে বাড়ি মালয়েশিয়া, ইউরোপ বা আমেরিকায়। ২০১৯ সালে এই যে বেদনাহত মানুষজন ভোট দিতে না গেলে কী হবে? বিরোধীদের সঙ্গে ভোটের পার্থক্য কয়েক পার্সেন্ট। এই কয়েক পার্সেন্টের জন্যই লড়াই। এই কয়েক পার্সেন্ট আওয়ামী লীগে না গেলে বিপর্যয় হবে। নেতাদের ক্ষতি হবে না। ক্ষতি হবে আমাদের মতো মানুষজনের। নেতারা তো তখন প্রবাসে। এটি অসত্য কোন ধারণা নয়। আরও ক্ষতি হবে এ দেশের, যে দেশের জন্য অকাতরে মানুষ শুধু প্রাণ দেয়নি, এখনও দিচ্ছে ও নির্যাতিত হচ্ছে। উন্নয়ন এজেন্ডার সঙ্গে এই এজেন্ডাগুলোকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। শেখ হাসিনা বলেছেন, উন্নয়নে শান্তি দরকার। সেটাতো আমরাও বিশ্বাস করি। গণতন্ত্রের ভিত্তিতো অসাম্প্রদায়িকতা। কিন্তু এটি রক্ষার দায়িত্ব শুধু সিভিল সমাজের? রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব কি তাহলে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ? অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার উপায় নেই। সামগ্রিক দৃশ্যপটে উন্নয়নেকে গুরুত্ব দিতে হবে, সঙ্গে উন্নয়ন ধরে রাখার জন্য নিজের দৃষ্টিভঙ্গিও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেমন ১৯৭১-এর পর কী ছিল দেশের অবস্থা, খালেদা-নিজামী দেশটাকে কী করেছিল সে পটভূমি বা ইতিহাস জানলে স্পষ্ট হবে শেখ হাসিনার গুরুত্ব কী? ইতিহাস না জানলে, শিক্ষা সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে না উঠলে সে দৃষ্টিভঙ্গি তো বদল হবে না। আপনারা কতজন দেশে ঘুরে বেড়ান জানি না। সারাদেশে ইসলামীকরণ কীভাবে হচ্ছে তা তৃণমূলে না গেলে বোঝা যাবে না। মন্দির ভাঙ্গা শুধু রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্যই নয়, ইসলামীকরণও যুক্ত। এই ধর্মীয়করণ কি উন্নয়নের সঙ্গে খাপ খায়? সরকারের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নীতির কারণ তাকে সহায়তা করছে। দৃষ্টিভঙ্গি বা মানস জগতে পরিবর্তনটা হয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির মাধ্যমে। কম্বোডিয়ার গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া [এখন কম্বোডিয়া নথি সংগ্রহ কেন্দ্রের নির্বাহী] ইয়ুক দাং বলেছেন, ‘অ ঝড়পরবঃু পধহহড়ঃ শহড়ি রঃংবষভ রভ রঃ ফড়বং হড়ঃ যধাব ধহ ধপপঁৎধঃব সবসড়ৎু ড়ভ রঃং ড়হি যরংঃড়ৎু.’ এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর কোন এজেন্ডা কি আছে সরকার বা সরকারী দলের? এই অসীম আত্মতৃপ্তি গোকুলে একজন ট্রাম্পের সৃষ্টি করছে। আমরা তো তা চাই না। আমরা তো চাই শেখ হাসিনা বেঁচে বর্তে থেকে নেতৃত্ব দিন। আমরা না চাইলেই কি গোকুলে ট্রাম্প হবে না?’ অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে? বাংলাদেশ কি সবসময় বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তচিৎকার করবে? (সমাপ্ত)
×