কিছু বিলম্বে হলেও টনক নড়েছে সরকারের। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আওয়ামী লীগের ৫ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল গেছে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। উল্লেখ্য, ঘটনাটি ঘটেছে ৬ নবেম্বর রবিবার। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। গুলিবিদ্ধ হন ৪ সাঁওতাল। তাদের মধ্যে দু’জন সাঁওতাল নিহত হন। তবে তিনজন সাঁওতাল নিহত হওয়ার খবরও আছে। এই ঘটনায় ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে ৩৫০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ, যারা প্রধানত সাঁওতাল সম্প্রদায়ের।
এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, সাঁওতাল সম্প্রদায় একটি ক্ষুদ্র প্রান্তিক নৃ-গোষ্ঠী। প্রধানত প্রকৃতিপূজক, নিরীহ, নির্বিরোধী, শান্তিপ্রিয়। একদা শিকার তাদের প্রধান জীবন-জীবিকা হলেও পরবর্তীকালে তারা জড়িয়ে পড়ে কৃষি কাজে। প্রধানত উত্তরবঙ্গেই বিচ্ছিন্নভাবে তাদের বসবাস। তদুপরি সম্প্রদায়টি একেবারেই দরিদ্র ও ভূমিহীন। এ রকম অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় সাপমারা ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সভাপতি অর্থের বিনিময়ে সাঁওতালদের চিনিকলের জমিতে চালাঘর উঠিয়ে বসবাসের সুযোগ করে দেয়। অভিযোগ আছে, আবার উক্ত নেতার নেতৃত্বেই রবিবার চলে সাঁওতাল উচ্ছেদ অভিযান। জনকণ্ঠের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা যায়, চিনিকলের অধিগ্রহণকৃত জমিতে সাঁওতালদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বসতি স্থাপনে যিনি ভূমিকা রেখেছিলেন, উচ্ছেদেও তিনি পালন করেন অগ্রণী ভূমিকা। এক্ষেত্রে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সম্পৃক্ততার অভিযোগও আনা হয়েছে সাঁওতালদের পক্ষ থেকে। এক্ষেত্রে সাঁওতালদের ব্যবহার করা হয়েছে দাবার ঘুঁটি হিসেবে। সর্বশেষ, প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সব রকম সাহায্য-সহযোগিতা ও নিরাপত্তার আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে। যে বা যারা এই ঘটনার নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়েছেন, তদন্ত সাপেক্ষে তাদের আইনের আওতায় আনা বাঞ্ছনীয়।
পুলিশ ও সাঁওতালদের সংঘর্ষে ৯ পুলিশ তীরবিদ্ধ হলে আসামি ধরতে অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এরপরই। স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি, যাদের চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী বলে পরিচিতি রয়েছে, সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বাড়িঘর লুটপাট করে ও জ্বালিয়ে দেয়। প্রশাসন থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, তারা কোন উচ্ছেদ অভিযান চালায়নি। অতঃপর বাধ্য হয়ে গৃহহীন অসহায় সাঁওতাল পরিবারগুলো আশ্রয় নিয়েছে সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারসংলগ্ন সাঁওতাল পল্লীতে। স্থানীয় রাজনৈতিক সংগঠন ও প্রশাসন থেকে অদ্যাবধি কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় মাদারপুর ও জয়পুরপাড়ার সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। জীবন নির্বাহ হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত, অসহায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনাটির সঙ্গে গোবিন্দগঞ্জের ঘটনাটির সবিশেষ মিল লক্ষণীয়। দুটোতেই সরকারের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের প্রত্যক্ষ মদদ ও ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। আছে প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের নিষ্ক্রিয়তা ও সমর্থনের অভিযোগ। দুটো ঘটনাতেই হামলার শিকার অসহায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। বিশেষ করে জমি-জিরাত, ঘরবাড়ি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দখল ও লুটপাট। এতে করে যে দেশে-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তির সমূহ ক্ষতি হচ্ছে, সে কথা বলাই বাহুল্য। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সরেজমিন তদন্ত করেছেন। সেক্ষেত্রে ঘটনার পেছনে কারা, তা অনুসন্ধানে নিশ্চয়ই বেরিয়ে এসেছে। যে বা যারাই এর পেছনে জড়িত থাকুক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। তা না হলে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়াও আবশ্যক।
শীর্ষ সংবাদ: