ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১৪ নভেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

কর্মজীবনের প্রথম অধ্যায় আমি আমার স্মৃতিকথার প্রথম খ- শেষ করেছি জীবনের প্রথম বাইশটি বছরের কথা বিবৃত করে। ১৯৫৫ সালে আমি শিক্ষাজীবনের শেষ পরীক্ষা এমএ দিই ৫ থেকে ১৫ অক্টোবরে। তারপর চাকরি পাবার জন্য কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা দিই ১৪ নবেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তারপর এক ধরনের কর্মজীবন শুরু করি। তবে অপেক্ষায় থাকি কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিসে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান অর্থাৎ সিএসপি ক্যাডারে যোগ দেয়ার আকাক্সক্ষায়। ১৯৫৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আমি সেই সার্ভিসে যোগ দেয়ার জন্য সলিমুল্লাহ হল ত্যাগ করি এবং ১২ সেপ্টেম্বর লাহোরে সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে যোগ দিই। এই একাডেমি ছিল একটি পুরনো প্রাসাদ, যার নাম ছিল রেসিডেন্সি বিল্ডিং। এই স্থাপনায় আমাদের মোট একুশজনের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা যেমন ছিল, তেমনি খেলাধুলার জন্য টেনিস কোর্ট, অন্যান্য মাঠ এবং ঘোড়া চড়ার একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও ছিল। তাছাড়া এই স্থাপনার দুটো অংশ ছিল একাডেমির পরিচালক ও তার ডেপুটির জন্য দুইটি উন্নতমানের বাড়ি। এখানে উন্নতমানের খাবার এলাকা অথবা বাগানে পার্টি করারও ভাল সুযোগ ছিল। একাডেমিতে অবস্থান করতেন সপরিবারে পরিচালক ও সহকারী পরিচালক। আমাদের সময় পরিচালক ছিলেন একজন প্রাক্তন আইসিএস কর্মকর্তা জিওফ্রে বার্জেস এবং তার ডেপুটি ছিলেন প্রথমে পূর্ব বাংলার প্রশাসনিক সার্ভিসের সদস্য আবুল মাসুদ সায়িদ এবং কিছুদিন পরে সায়িদ সাহেবের বদলি হলে তার জায়গায় এলেন ফয়েজুদ্দিন আহমাদ। বলতেই হবে একাডেমিতে ছিল আমাদের কড়া রুটিনে পরিচালিত জীবন, যেখানে ছুটির দিন ছিল রোববার। ভোর সকালে উঠতে হতো ঘোড়া চড়ার প্রশিক্ষণ নিতে। হাবিলদার যেমন ছিল গম্ভীর তেমন ছিল ভাল প্রশিক্ষক। তার সহকারী চানান খান ছিল খুব চটপটে ও সর্বদা সাহায্য করতে এবং সাহস যোগাতে ব্যস্ত। আমি শৈশবে সামান্য ঘোড়ায় চড়েছিÑ গোয়ালাবাজার থেকে নানাবাড়ি যাওয়া -আসাতে। তাই ঘোড়া চড়তে কোন জড়তা ছিল না এবং সম্ভবত আমাদের দলে আমি অতি উৎকৃষ্ট ঘোড়াচালক ছিলাম। আমার নিয়মিত ঘোড়া ছিল সবচেয়ে দুর্বিনীত ‘বিউটি’, যার বদনাম ছিলÑ সে কামড়ায়। আমাকে হাবিলদার পলো খেলার জন্য মনোনীত করে; কিন্তু অতিবৃষ্টির কারণে পলো খেলার প্রশিক্ষণ মাত্র ১-২ দিনে সম্ভব হয়। আমি চাকরি জীবনেও ঘোড়া চড়ার সুযোগ নিই। বাগেরহাটের ফকিরহাট থানার কর্মকর্তা একটি ভাল ঘোড়ার মালিক ছিলেন। এই ঘোড়াটি আমি ওই এলাকায় গেলেই চড়তাম। সবচেয়ে আনন্দ পাই বুয়েনেস এয়ারেসে ১৯৭৮ সালে ঞঈউঈ কনফারেন্সের সময় এক রোববারে প্রেসিডেন্ট গালটিয়েরির কান্ট্রি হাউসে মধ্যাহ্নভোজের আসরে প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘোড়ায় চড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানেও ঘোড়া চড়ার সুযোগ পাই রাওয়ালপিন্ডি বিভাগে যখন সপ্তাখানেকের প্রশিক্ষণে যাই। সেখানে তখন পিন্ডিগেভে একটি সামরিক এক্সারসাইজ চলছিল এবং সেখানে আমরা ছিলাম জিওসি জেনারেল আজম খানের অতিথি। ওখানে আমি একদিন এক ঘোড়ায় চড়লাম। ঘোড়াটি ছিল পঙ্খীরাজ। সে নিমিষে দ্রুত ক্ষেপে গেল এবং তাকে বেশ কষ্ট করে অনেক সময় নিয়ে বশে আনতে সক্ষম হই। ঐ একটিবারই অপরিচিত ঘোড়ার পিঠে বসে আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম। একাডেমির পরিচালক জিওফ্রে বার্জেস ছিলেন একজন প্রাক্তন আইসিএস কর্মকর্তা। তিনি ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি পাকিস্তানে সিন্ধু প্রদেশে কিছুদিন চাকরি করে অবসরে যান। তিনি প্রায়ই ভোর সকালে ঘোড়া চড়তে আসতেন এবং কারা ফাঁকি দিচ্ছে তাদের ডেকে সাবধান করে দিতেন। তার নির্দেশনায় আমরা সারাদিন টাই পরে থাকতাম এবং প্রতি সপ্তায় এক রাতে আহারের জন্য ফর্মাল কাপড় পরতামÑ হয় ডিনার জ্যাকেট, না হয় কালো শেরওয়ানি। আমরা যখন কোন শিক্ষাভ্রমণে যেতাম তখন আমাদের লিখিত প্রতিবেদন তার কাছে দিতে হতো। আমরা যখন পূর্ব পাকিস্তানে তিন মাসের মতো জেলায় কাজ করতাম তখনও আমাদের প্রতি পনেরো দিনে তার কাছে আমাদের কাজকর্মের প্রতিবেদন পাঠাতে হতো। তিনি সযতেœ সেগুলো পড়ে, এখানে-সেখানে মন্তব্য করে সেগুলো আমাদের ফেরত পাঠাতেন। তাকে আমরা মাস্টারমশাই ভাবতাম, তবে তিনি যে আমাদের যথোপযুক্ত দায়িত্বশীল প্রশাসক হিসেবে গড়ে তুলতে ব্রত ছিলেন তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ ছিল না। মিসেস বার্জেসও সেই সকাল থেকে তার স্বামীকে সঙ্গ দিতেন। ডেপুটি পরিচালক আবুল মাসুদ সায়িদ সম্ভবত ১৯৪৪ সালের বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ছিলেন সিলেটের মুরারীচাঁদ কলেজের প্রথম মুসলমান অধ্যক্ষ খান বাহাদুর আবু সায়িদ আবদুল্লাহ্্র কনিষ্ঠ ছেলে। তার বড় দুই ভাই আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্্ এবং আবু সায়িদ আব্দুল্লাহ দু’জনাই ছিলেন ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের (ওচঝ) সদস্য। আবুল মাসুদ বাংলাদেশ সরকারে সম্ভবত অতিরিক্ত সচিব হিসেবে সত্তরের দশকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি বেশ ভাল টেনিস খেলতেন এবং তার স্ত্রী ছিলেন একজন শৌখিন সুরুচিসম্পন্ন মহিলা। তার সঙ্গে আমার একটি সুবিধা ছিল যে, আমরা সিলেটীতে কথা বলতে পারতাম। তারা ছিলেন কলকাতার মানুষ, তবে সিলেটে তার শৈশব ও কৈশোর কাটে। ফয়েজ আহমদ ছিলেন ১৯৪৮ সালের পূর্ব বাংলা সিভিল সার্ভিসের সদস্য এবং একজন দক্ষ কর্মকর্তা। আইন-কানুন এবং জেলা প্রশাসন সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল খুব স্বচ্ছ। তবে সম্ভবত তিনি তেমন কেতাদুরস্ত ছিলেন না বলে অবহেলিত হতেন। জীবনে তিনি সাফল্যের মুখ দেখেন। পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারে কিছুদিন চাকরি করেন। বাংলাদেশে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। শুরুতেই বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসন বিভাগে প্রথমে অতিরিক্ত সচিব ও পরে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একাডেমিতে আমাদের পড়ার বিষয় ছিল মূলত আইন। পাকিস্তান পেনাল কোড, এভিডেন্স আইন, ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড, সিভিল আইন কোড ছাড়াও বিশেষভাবে পড়তে হতো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভূমি প্রশাসন এবং বিভিন্ন আইন। গ্রেট ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থান ও উন্নয়নের ইতিহাস ছিল আর একটি বিষয়। ইসলামিয়াত এবং বাংলা বা উর্দু ছিল আরও দুটি বিষয়। জনপ্রশাসন এবং বিশেষ করে পাকিস্তানের জনপ্রশাসন ব্যবস্থা ও তার সংস্কার ছিল অন্য একটি বিষয়। এতে জেলা প্রশাসন ছিল অন্যতম উপাদান। একাডেমিতে আমাদের পরীক্ষা দিতে হতো ৫০০ নম্বরের জন্য একবার। পূর্ব পাকিস্তানে তিন মাস প্রশিক্ষণের পর বিদেশে পাড়ি দেয়ার আগে দিতে হতো ১০০০ নম্বরের আরেকটি পরীক্ষা। সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় মোট ছিল ৩০০ মৌখিক পরীক্ষাসহ ১১০০ নম্বর । এতে পাওয়া নম্বর এবং পরবর্তী ১৫০০ নম্বরের মধ্যে প্রাপ্ত নম্বর মিলে আমাদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হতো। তাতে সুপিরিয়র সার্ভিসে আমাদের সঙ্গে প্রথম হন কাজী ফজলুর রহমান, তিনি তার অবস্থান ধরে রাখেন। আমাদের সঙ্গে সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন সৈয়দ শাহেদ হোসেন ও তৃতীয় হয়েছিলেন মুজিবুর রহমান খান এবং চতুর্থ ছিলেন আমাদের পূর্ববর্তী বছরের সফল প্রার্থী আবুল কাসেম গোলাম রাব্বানি। তারা সবাই তাদের জ্যেষ্ঠতা হারিয়ে ফেলেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে কাজী ফজলুর রহমানের পরে আসেন সালাহউদ্দিন আহমদ এবং তারপর স্থান পাই আমি। একাডেমিতে পরিচালক ও সহকারী পরিচালক ছাড়া একজন আইনজ্ঞ ছিলেন নিয়মিত প্রশিক্ষক। আমাদের উর্দু পড়াতেন সুফী তাবাসসুম নামের একজন কবি ও সাহিত্যিক। তিনি একান্তই ছিলেন একজন লাহোরবাসী এবং একদিন আমাদের লাহোরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। দর্শনীয় সব এলাকাÑ লাহোর দুর্গ, শালিমার বাগান, লরেন্স গার্ডেন দেখিয়ে অবশেষে আমাদের নিয়ে যান হীরামন্ডিতে। হীরামন্ডি ছিল লাহোরের প্রসিদ্ধ বেশ্যাপল্লী এবং সেখানে সুফী সাহেব ছিলেন অত্যন্ত সম্মানী ব্যক্তি। কারণ তিনি তাদের বিপদে-আপদে সহায়তা দিতেন। আরেকজন খ-কালীন প্রশিক্ষক ছিলেন পার্সি আইনজ্ঞ পার্সি মাখন লাল। তিনি দেওয়ানি আইনে পারদর্শী ছিলেন এবং সব সময়ই খোশমেজাজে হাসি-মস্করাসহ কঠিন আইন পড়াতেন। পুরনো আইসিএস অনেকেই বক্তৃতা দিতে আসতেন। তবে প্রশাসকদের বাইরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত আইনজ্ঞ বা চিন্তাবিদ সবিশেষ আহূত হতেন না। লাহোর সরকারী কলেজ, ফোরম্যান ক্রিশ্চিয়ান কলেজ বা উন্নত বিদ্যালয় এইচিসন কলেজের সঙ্গে আমাদের একাডেমির তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। আমার আত্মীয় বিচারপতি আকরমের দুই ছেলে ও এক মেয়েই আমাকে ওইসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করে। এইচিসন কলেজে দু’চারজন বাঙালী ছাত্রকে মাধ্যমিক পর্যায়ে দেখা পেয়ে বেশ আশ্চর্যই হয়ে যাই। ফোরম্যান ক্রিশ্চিয়ান কলেজে গেলাম একজন বাঙালী তুখোড় ছাত্র তৈয়বুদ্দিন মাহতাবের আমন্ত্রণে। তৈয়ব মাহতাব ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন। কিন্তু কয়েক বছর পরেই পদত্যাগ করে বোস্টনে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধকালে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় এবং জুন মাসে তিনি কলকাতায় যান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র দফতরে কর্মরত থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার পর আবার বোস্টনে ফিরে যান। অধুনা তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আর নেই। সম্ভবত তিনি এখন পশ্চিম আমেরিকার কোন রাজ্যে আছেন। তৈয়বুদ্দিনের পিতা মাহতাবুদ্দিন আহমদ বিভাগ পূর্বকালের বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের জাঁদরেল কর্মকর্তা ছিলেন এবং পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্ম সচিব হিসেবে অবসরে যান সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম দশকে। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রথম গেলাম জীবনের বাইশটি বসন্ত পেরিয়ে এবং সেখানে থাকলাম মোট আট মাস। লাহোরের বাইরে যাওয়া হলো যৎসামান্যÑ ৪-৫ দিনের জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে। তখন রাওয়ালপিন্ডি ছিল সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতে একটি গুরুত্বপুর্ণ শহর, দেশের রাজধানী নয়। এছাড়া পেশওয়ার এবং আফগান সীমান্তে লান্ডি কোটালে যাওয়া হলো। সম্ভবত ২-৩ দিন থাকি ট্রাইবাল এলাকা ওয়াজিরিস্তানে। ট্রাইবাল এলাকায় তাদের রীতিনীতি এবং আচার-আচরণের মতোই সমাজ চলত। যেমন প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি মানুষ সব সময় অস্ত্র হাতে ঘোরাফেরা করত। সেখানে মানহানির জন্য যার মানহানি হলো সে যথাযথ প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হতো। যে বেশি খেতে পারত সে তত বেশি সম্মান পেত। এই স্বল্প সময়ের পরিচিতির সুযোগ নিয়ে একটি এলাকা সম্বন্ধে মন্তব্য করা বোধ হয় সমীচীন নয়। তবু বলব কয়েকটি ধারণা বেশ স্পষ্ট গড়ে উঠল এবং পরবর্তীকালে যখন পশ্চিম পাকিস্তানে করাচী ও রাওয়ালপিন্ডিতে প্রায় পাঁচ বছর কাটাই সেই ধারণাগুলোই তখন আরও দৃঢ় হয়। জনসাধারণ মোটামুটিভাবে কর্তাব্যক্তিদের খুব সমীহ করে এবং সরকারী কর্মকর্তারা হলেন নমস্য ব্যক্তি, তাদের সবাই মান্য করে। এদিক দিয়ে আমাদের দেশের জনসাধারণ অনেক বেশি অগ্রসর ছিল, কর্তার প্রতি তাদের আনুগত্য এদেশে ছিল যৌক্তিক, তত ভৃত্যসম নয়। আর ট্রাইবাল এলাকাটি মোটামুটি মধ্যযুগীয় কায়দায়ই চলত এবং তারা তাদের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা (তা যতই মান্ধাতার আমলের হোক না কেন) বজায় রেখেই চলত। ব্যক্তিগত জীবনে পশ্চিম পাকিস্তানে ধর্মকর্মের প্রভাব ছিল অতি সামান্য। ধর্মীয় রুটিন নিয়েও তেমন মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু ধর্ম নিয়ে ছিল জেহাদী মনোভাব, এক ধরনের রোমান্টিক উগ্রতা। তুলনামূলকভাবে সারা সমাজে ছিল সাংস্কৃতিক দৈন্য এবং সুরুচির অভাব। সমাজে সামন্তবাদের প্রভাব ছিল গভীর ও সুদূরপ্রসারী। সেখানে গণতন্ত্রের কোন পরিবেশই ছিল না। কর্তার হুকুম ও প্রভাবে সমাজ চলত। ১৯৫৭ সাল রাজনৈতিক বিবেচনায় ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। আমরা জানি যে, ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকার দুটিই ছিল আওয়ামী লীগের সরকার। ১৯৫৭ সালের শুরুতেই আওয়ামী লীগে ভাঙ্গন আসল। ফেব্রুয়ারি মাসের ৭ এবং ৮ তারিখে কাগমারিতে হয় আওয়ামী লীগের বার্ষিক সম্মেলন, যেখানে ৮৯৬ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলনেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতভেদ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু এই মতানৈক্য নিরসনের জন্য সচেষ্ট হন এবং আওয়ামী লীগের বহু নির্বাচনী অঙ্গীকার দ্রুত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়। আওয়ামী লীগ ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা করে ছুটির ব্যবস্থা নিল। শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু করল এবং শহীদ পরিবারকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিল। ১৯৫৭ সালের ১৪ মার্চে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের আইন পাস হলো। মহাচীনের নেতৃত্ব পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের দৃঢ়করণের শক্ত ইঙ্গিত দিল। প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ঢাকায় এলেন ১৪ মার্চে এবং জনগণ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তাকে সংবর্ধনা জানালো। মওলানা ভাসানী কিন্তু তার মতানৈক্য বজায় রেখে ১৭ মার্চে আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ এবং সদস্যপদে ইস্তফা দিলেন। কিছুদিন পরেই মওলানা ভাসানী নতুন একটি দল গঠনের উদ্যোগ নিলেন। ১৮ এবং ১৯ মে তিনি বগুড়ায় একটি গণতান্ত্রিক মঞ্চের পক্ষে সম্মেলন ডাকলেন। বঙ্গবন্ধু তখনই আওয়ামী লীগের ভিত্তি দৃঢ় করা এবং মওলানা ভাসানীর নতুন দল গঠনের উদ্যোগকে সামলে নেয়ার উদ্দেশ্যে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা থেকে ৩১ মে পদত্যাগ করলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগ দলটিকে তৃণমূল স্তর থেকে শক্তভাবে সংগঠিত করা। আওয়ামী লীগের ভাঙ্গন অবশ্যি তিনি রোধ করতে পারলেন না। ২ জুন অনেক নিবেদিত আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতা পদত্যাগ করলেন। এই পদত্যাগকারীদের মধ্যে ছিলেন অলি আহাদ, ইয়ার মোহাম্মদ, আবদুস সামাদ, পীর হাবিবুর রহমান, দবির উদ্দিন আহমদ এবং সেলিনা বানুর মতো জাতীয় এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। বঙ্গবন্ধু ১৩ এবং ১৪ আগস্টে আবার আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ডাকলেন এবং এই কাউন্সিলেই পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের নাম হলো ‘বাংলা’। মাসখানেকের মধ্যেই মওলানা ভাসানী বগুড়াতে ডেমোক্র্যাটিক ওয়ার্কিং কনফারেন্স আহ্বান করলেন এবং সেই সম্মেলনে তাকে সভাপতি করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানিকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠিত হলো। পূর্ব পাকিস্তানে এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হলেন মওলানা ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক হলেন সিলেটের মাহমুদ আলী, যিনি অসমে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বেই মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মওলানা ভাসানীর ন্যাপ পশ্চিম পাকিস্তানেও যথেষ্ট সমর্থক পেল। সেখানে সীমান্তের ড. খান সাহেব আবদুল গফুর হলেন সভাপতি এবং পাঞ্জাবের বিশিষ্ট আইনজীবী মাহমুদ আলী কসুরী হলেন সাধারণ সম্পাদক। এতদিন পরে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, ন্যাপ পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি অস্থিতিশীল করে তোলে এবং সামরিক শাসনের প্রবর্তনের ক্ষেত্র সহজ করে দেয়। আওয়ামী লীগে ইতোমধ্যেই বিভক্তি হয়েছিল, সেখানে ন্যাপ এসে আওয়ামী লীগের শক্তিকে আরও খর্ব করে দিল। প্রায় বাধ্য হয়ে ১৯৫৭ সালের ১১ অক্টোবর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করলেন। এরপর থেকে পাকিস্তানে স্থিতিশীল মন্ত্রিসভা প্রতিষ্ঠার সুযোগই বিদায় হয়ে গেল। মুম্বাই-এর আই আই চ-ীগড় ক’দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেন, তারপর এলেন পাঞ্জাবের ফিরোজ খান নূন। এই অস্থিতিশীলতা চলতেই থাকল। এরই চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলো। চলবে...
×