ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাথমিকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে হবে উৎপাদন কেন্দ্র

অবশেষে বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদনে সম্মত মেয়ররা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৪ নভেম্বর ২০১৬

অবশেষে বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদনে সম্মত মেয়ররা

রশিদ মামুন ॥ এক বছর চেষ্টার পর বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদনে সিটি মেয়ররা সম্মত হয়েছেন। এখন কোন প্রক্রিয়ায় বিদ্যুত উৎপাদন হবে তা নির্ধারণ করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে বর্জ্য বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য কেন্দ্র বসাতে চায় বিদ্যুত বিভাগ। ক্রেতা হিসেবে এখান থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুত বিভাগ ওই বিদ্যুত ক্রয় করে গ্রিডে সরবরাহ করবে। সূত্র বলছে প্রথমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বর্জ্য বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য চুক্তি করে। ওই প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার পর বিদ্যুত বিভাগ এককভাবে কেন্দ্র নির্মাণ করতে চাইলে বাদসাধে সিটি কর্পোরেশন। মেয়ররা গত বছরের ডিসেম্বরে এক বৈঠকে বিদ্যুত বিভাগের সঙ্গে এ ধরনের প্রকল্প করতে অসম্মতি জানায়। তারা এককভাবেই প্রকল্প করবে বলে বিদ্যুত বিভাগকে জানিয়ে দেয়। যদিও সরকারের টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-স্রেডা বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদনে সিটি মেয়রদের সম্মতি আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। সবশেষ গত সপ্তাহে এক বৈঠকে সিটি মেয়ররা এই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছেন। বৈঠকে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জের সিটি মেয়রার উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যুত বিভাগের তরফ থেকে বলা হয়েছে তিনটি মডেল অনুসরণ করে বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করার বিষয়ে সিটি মেয়রদের প্রস্তাব দিয়েছে বিদ্যুত বিভাগ। প্রথমটি সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে বিদ্যুত বিভাগ একটি যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠন করবে। এই কোম্পানি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করবে। কিন্তু এখানে সিটি কর্পোরেশন মূলধন বিনিয়োগ করতে পারবে না বলে জানিয়েছে। দ্বিতীয়টিতে সিটি কর্পোরেশন বর্জ্য সরবরাহ নিয়মিত রাখবে এমন আশ্বাসের ভিত্তিতে পিডিবি কেন্দ্র নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করবে। দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা আইপিপি মডেল অনুসরণ করে কেন্দ্র নির্মাণ করবে। তৃতীয়টি হচ্ছে সিটি কর্পোরেশন নিজেই কেন্দ্র নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করতে পারে। আইপিপি ভিত্তিতে কেন্দ্রটি নির্মাণ চূড়ান্ত হলে পিডিবি সর্বনিম্ন দরদাতার সঙ্গে বিদ্যুত ক্রয় চুক্তি করবে। স্রেডার সদস্য সিদ্দিক জোবায়ের এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, মেয়ররা বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদনে সম্মত হয়েছেন। এখন কোন মডেলে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। আমরা তিনটি মডেল তাদের সামনে উপস্থাপন করেছি। উন্নত দেশে সিটি কর্পোরেশন এ ধরনের প্রকল্পে বর্জ্য পরিশোধনের জন্য অর্থ দিয়ে থাকে। এ জন্য বিদ্যুতের দাম কম হয়। আমাদের এখানে সিটি কর্পোরেশন কোন অর্থ দেবে না। সঙ্গত কারণে দাম বেশি পড়বে। পিডিবি ভর্তুকি দিয়েই এখান থেকে বিদ্যুত কিনবে। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন সম্মত হলে তাদের বর্জ্য পরিষ্কারের জন্য আর অর্থ ব্যয় করতে হবে না। এছাড়া পরিবেশের কোন ক্ষতি হবে না। একই সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের কয়েক বছর পরপর বর্জ্য ফেলার জন্য নতুন জমিও কিনতে হবে না। যা এক ধরনের লাভ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, সিটি কর্পোরেশন বিদ্যুত বিক্রি থেকে কোন অর্থ পাবে না বলেই বর্জ্য সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করার বিপক্ষে ছিল। কিন্তু জার্মানিতে এ ধরনের বিদ্যুত কেন্দ্রে সিটি কর্পোরেশন বর্জ্য দেয়ার পাশাপাশি প্রতি টনে আরও ৫০ ইউরো দিয়ে থাকে। আমাদের এখানে সিটি কর্পোরেশনকে সেই অর্থ দিতে হবে না। ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুত কিনবে পিডিবি। সব শেষ উদ্যোগ হিসেবে দেখা যায় ইতালিয়ান কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট এনভায়রনমেন্ট ফিন্যান্স এসআরএলের সঙ্গে ২০১৩ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগে একটি চুক্তি হয়। ঢাকার বর্জ্য দিয়ে দৈনিক ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করার কথা ছিল কোম্পানিটির। পর্যায়ক্রমে তা বৃদ্ধি করে ১০০ মেগাওয়াট করার পরিকল্পনাও ছিল। ঢাকার বর্জ্যে আলোচিত সেই বিদ্যুত প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখেনি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ইতালিয়ান কোম্পানিটি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। কোম্পানিটির ব্যর্থতার কারণে ভেস্তে যায় প্রকল্পটি। অন্যদিকে রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে বর্জ্য বিদ্যুত উৎপাদনের আগ্রহ দেখায়। তবে এখনও ওই প্রকল্পরও কাজ শুরু করা যায়নি। ঢাকার দুই নগর অফিসের হিসাব বলছে দেড় কোটির বেশি মানুষের এই ঢাকাতেই প্রতিদিন অন্তত আট হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য তৈরি হয়। এর সঙ্গে রাজধানীর হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে আরও এক হাজার ৫০০ টন বর্জ্য যোগ হয়। উৎপাদিত বর্জ্যর মধ্যে আছে প্লাস্টিক, কাগজ, কাচ, ধাতু এবং জৈব বর্জ্য। অন্যদিকে ঢাকার পরেই একই এলাকায় বেশিসংখ্যক মানুষের বাস চট্টগ্রামে। বন্দরনগরীতে একসঙ্গে বসবাস করছেন ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ। এখানে প্রতিদিন উৎপাদিত হয় দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টন বর্জ্য। কেবল এই দুই মহানগরীতে প্রায় ১২ হাজার টন বর্জ্যর মধ্যে বেশিরভাই রান্নার উচ্ছিষ্ট পচনশীল; যা মিথেন উৎপাদন করতে সক্ষম। হিসাব বলছে, এই বর্জ্যরে পরিমাণ মোট বর্জ্যরে ৬০ শতাংশ। প্রতি এক মেগাওয়াট বিদ্যুত প্ল্যান্ট চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় ৪০ টন বর্জ্য। এই হিসেবে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের বর্জ্য দিয়ে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। এর বাইরে প্রত্যেক বিভাগীয় শহরের বর্জ্য দিয়ে স্থানীয়ভাবে ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হতে পারে। বর্জ্য ফেলার জন্য যেসব ল্যান্ডিং স্টেশন রয়েছে সেখানেই বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে। ফলে নতুন করে জমিরও দরকার নেই। এখানেই বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো নির্মাণ করা সম্ভব। এর আগে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে এ ধরনের প্রকল্পের অংশীদার করে নিলে বর্জ্যরে সরবরাহ দেয়ার বিষয়ে তাদের এক ধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে। একই সঙ্গে তারা মুনাফাও পাবে। ফলে তাদের আগ্রহ আরও বাড়বে। তবে এতেও সাড়া মেলেনি সিটি মেয়রদের। তারা বলছে বিদ্যুত বিভাগ যে তিনটি মডেল দাঁড় করছে আলোচনার ভিত্তিতে তার একটি গ্রহণ করবেন তারা।
×