ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৃত তথ্য সরকারের হাতে নেই, ডাটাবেজ তৈরির উদ্যোগ ;###;রোহিঙ্গারা এ হিসাবের বাইরে ;###;অবৈধ বিদেশী নাগরিকই ক্যামেরুন, পাকিস্তান, ফিলিপিন্স, নাইজিরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, লিবিয়া, আফগানিস্তান, সুদান, তাঞ্জানিয়া, উগান্ডা ও শ্রীলঙ্কার

দু’লাখ অবৈধ বিদেশী ॥ বাংলাদেশে বর্তমানে বাস করছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৪ নভেম্বর ২০১৬

দু’লাখ অবৈধ বিদেশী ॥ বাংলাদেশে বর্তমানে বাস করছে

তৌহিদুর রহমান ॥ জীবন ও জীবিকার তাগিদে বাংলাদেশের নাগরিকরা পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশে যেতে অনেকেই মৃত্যুর মুখোমুখিও হয়েছেন। আবার অনেকেই রয়েছেন কারাগারে। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশ থেকে বিদেশী নাগরিকরা বাংলাদেশেও পাড়ি জমাচ্ছেন। সে কারণে ধীরে ধীরে বাংলাদেশেও বিদেশী নাগরিক বাড়ছে। বর্তমানে প্রায় দুই লাখ অবৈধ বিদেশী নাগরিক বাংলাদেশে বসবাস করছেন। এসব অবৈধ বিদেশীর আয় করা অর্থ অবৈধভাবেই বিদেশে পাচার হচ্ছে। অবৈধ বিদেশী নাগরিকদের বিষয়ে ধীরে ধীরে কঠোর হচ্ছে সরকার। বাংলাদেশে বিদেশী নাগরিকদের শনাক্তের লক্ষ্যে একটি ডাটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এছাড়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের জন্য এখন ভিসা কড়াকড়ি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সম্প্রতি জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে অবস্থানকারী বৈধ বিদেশী নাগরিক এক লাখ ১১ হাজার ৫৭৫ জন। আর ৯১০ জন বিদেশী নাগরিকের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করা এসব বিদেশীর তালিকা পুলিশের বিশেষ শাখায় সংরক্ষিত আছে। এদের শনাক্ত করতে বিশেষ শাখাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযান অব্যাহত আছে। অবৈধভাবে চাকরিরত বিদেশীর সন্ধান পেলেও তাৎক্ষণিকভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়। কোন কোন বিদেশী নাগরিক এ দেশে এসেছিলেন তিন মাসের জন্য, তবে এক বছর হয়ে যাওয়ার পরও তারা ফেরত যাননি। আবার এ দেশে থাকার জন্য তারা যৌক্তিক কারণও দেখাতে পারেন না। সেক্ষেত্রে এসব বিদেশী নাগরিকদের তাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে সরকার। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে এসব বিদেশী নাগরিকদের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হয়। বাংলাদেশে অবৈধ বিদেশী নাগরিকের সংখ্যার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, এ সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। এর বাইরে আরও প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। এদিকে বিনিয়োগ বোর্ড, বেপজা ও এনজিও ব্যুরোর হিসাবে প্রায় ১৬ হাজার ৫শ’ বিদেশী বৈধভাবে কাজ করছেন। বিনিয়োগ বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে ১৪ হাজার বিদেশী নাগরিক বৈধভাবে কর্মরত রয়েছেন। আর বেপজার অনুমতি নিয়ে ২ হাজার বিদেশী কাজ করছেন। এনজিও ব্যুরো থেকে আরও ৫শ’ বিদেশী কাজ করছেন। ভারত, চীন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ডেনমার্ক এবং স্পেনের বিদেশী কর্মীরা বাংলাদেশে শিল্প এবং বাণিজ্যিক খাতে কর্মরত রয়েছেন। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অনেক নাগরিকই অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তবে আফ্রিকার এসব দেশের নাগরিকরা যেন সহজেই বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে ইতোমধ্যেই সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এসব দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য আগমনী ভিসার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আবার আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্ব এজতেমার সময় বাংলাদেশে আসেন অনেকে। এসব নাগরিক বাংলাদেশে এসে থেকে যান। আফ্রিকার অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের জীবনমান উন্নত হওয়ায় এসব দেশের নাগরিক বাংলাদেশকেই বেছে নেন। সে কারণে এসব দেশের নাগরিকদের দেখা মেলে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী অবৈধ বিদেশী নাগরিকদের মধ্যে অধিকাংশই ক্যামেরুন, পাকিস্তান, ফিলিপিন্স, নাইজিরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, লিবিয়া, আফগানিস্তান, সুদান, তাঞ্জানিয়া, উগান্ডা ও শ্রীলঙ্কার নাগরিক। ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও এসব বিদেশী অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস করছেন। এরই মধ্যে এদের অনেককেই ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নির্ধারিত সময়ের জন্য ভিসা নিয়ে বিদেশী এসব নাগরিক এখানে এলেও মেয়াদ শেষে তারা ফিরে যাচ্ছেন না। নতুন করে ভিসার জন্য আবেদনও করছেন না। আবার ঠিকানা পরিবর্তন করায় এসব বিদেশীকে খুঁজেও পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার প্রায় বিশ হাজার অবৈধ নাগরিক রয়েছেন। এসব নাগিরক দেশের বিভিন্ন পোশাক শিল্প-কারখানায় কাজ করছেন। অবৈধ বিদেশীরা বাংলাদেশের সরকারকে কোনরকম ভ্যাট বা কর দেন না। অথচ তারা সাধারণ নাগরিকের চেয়েও অধিক সুবিধা ভোগ করছেন। শুধু তাই নয়, এ দেশে অবৈধভাবে টাকা উপার্জন করে তারা নিজ দেশে পাঠাচ্ছেন। সাধারণত হুন্ডির মাধ্যমেই তারা নিজ নিজ দেশে অর্থ পাঠিয়ে থাকেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। গত বছর প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বিদেশী নাগরিকদের কর ফাঁকি ঠেকানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সে নির্দেশনা দেয়ার পর বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে ভিসা প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। আবার একই সঙ্গে একটি ডাটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বিদেশী নাগরিকদের কর্মসংস্থানের জন্য ওয়ার্ক পারমিট বাধ্যতামূলক। বেসরকারী খাতের কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান যদি কোন বিদেশী নাগরিককে নিয়োগ দিতে চায়, তাহলে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্ধারিত ফরমে আগেই আবেদন করতে হয়। এ আবেদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কর্তৃক স্বীকৃত দেশের নাগরিক, অনুমোদিত শিল্প-প্রতিষ্ঠান, ১৮ বছরের উর্ধে বয়স হতে হবে। যেসব কাজের জন্য স্থানীয় বিশেষজ্ঞ পাওয়া যায় না, সেসব কাজেই বিদেশীদের নিয়োগ দেয়া যাবে। এছাড়া সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাসহ বিদেশী কর্মচারীর সংখ্যা শতকরা ৫ ভাগের বেশি হতে পারবে না। একজন বিদেশী নাগরিকের নিয়োগ প্রাথমিকভাবে দুই বছরের জন্য বিবেচিত হবে। তবে পরবর্তীতে সন্তোষজনক হওয়ার ভিত্তিতে বাড়ানো হতে পারে। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ছাড়পত্র নিতে হবে। তবে ওয়ার্ক পারমিট নেয়ার ক্ষেত্রে এসব জটিলতায় যেতে পছন্দ করেন না বিদেশী নাগরিকরা। সে কারণে ভ্রমণ ভিসা নিয়েই বাংলাদেশে আসেন। তারপর এখানে চাকরি বা ব্যবসা বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্রমণ, ছাত্র ও ব্যবসায়িক ভিসা নিয়ে বিদেশীরা এ দেশে এসে প্রতারণাসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। ব্যবসায়িক ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে থাইল্যান্ডের তরুণীদের অনেকেই রাজধানীর অভিজাত এলাকার নামীদামী হোটেল, ম্যাসেজ পার্লার ও স্পা সেন্টারে কাজ করছেন। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও এখানে অবস্থান করায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন থাই তরুণীকে আটক করে থাইল্যান্ডে ফেরত পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি ক্যামেরুনের বেশ কয়েকজন নাগরিককে গ্রেফতার করে তাদের কাছ থেকে জাল ডলার ও ডলার তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এছাড়া পাকিস্তানের অবৈধ নাগরিকরা মাদক, অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত রয়েছেন। একই সঙ্গে জঙ্গীবাদ ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী কর্মকা-েও তাদের তৎপরতা রয়েছে। এভাবে বিভিন্ন সময়ে নানান দেশের বিদেশী নাগরিকরা অনেক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। বিদেশীদের গ্রেফতারের পর তাদের জন্য কোন অভিবাসন সেন্টার নেই। এছাড়া সরকারী আর্থিক কোন বরাদ্দ না থাকায় অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশী নাগরিকদের বিরুদ্ধে আটক অভিযান জোরদার করাও সম্ভব হচ্ছে না। অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাসকারী যেকোন বিদেশী নাগরিক মাত্র ছয় হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে ছাড়া পেতে পারেন। তারা ছাড়া পেয়ে নিজ নিজ দেশে গিয়ে আবারও এ দেশে আসার সুযোগ পান। এসব কারণে এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েও তেমন কোন সুফল পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে আগমনী ভিসার সুযোগ নিচ্ছেন বিদেশীরা। যেসব দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস নেই, সেসব দেশের নাগরিকরা বাংলাদেশে ত্রিশ দিনের আগমনী ভিসা (অন এ্যারাইভাল ভিসা) পেয়ে থাকেন। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই পরিপত্র অনুযায়ী যেসব দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস নেই, সেসব দেশের নাগরিকদের আগমনী ভিসা দেয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এ পরিপত্র অনুযায়ী শুধুমাত্র চারটি দেশের জন্য ভিসা প্রদানে কড়াকড়ি করা হয়েছে। এ চারটি দেশ হলোÑ ইরাক, আফগানিস্তান, সুদান ও আলজিরিয়া। সে অনুযায়ী এসব দেশ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে সহজেই বিদেশী নাগরিকরা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারছেন। আবার কারও আগমনী ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর প্রয়োজন হলে তারা বাড়াতেও পারেন। এসব কারণে অবৈধ বিদেশী বাড়ছে। বাংলাদেশে বিদেশীরা আসার পর তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার থেকে একটি নতুন নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। হোটেল-মোটেলে বিদেশীদের অবস্থান বিষয়ক সংক্রান্ত এ নীতিমালা অনুযায়ী বিদেশীদের সার্বিক পর্যবেক্ষণে রাখতে হোটেল, মোটেল ও রেস্টহাউজ এবং পুলিশ ও র‌্যাবকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য রাখতে হবে। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছেÑ হোটেল, মোটেল ও রেস্টহাউসে আগমনকারী বিদেশীর নাম, বাবার নাম, ঠিকানা, নিজ দেশের স্থায়ী ঠিকানা, চাকরি করলে তার বিস্তারিত তথ্য, ই-মেইল ঠিকানা ও ফোন নম্বর, জন্ম তারিখ, পাসপোর্টের ফটোকপি, ভ্রমণের উদ্দেশ্য, স্থানীয় গাইড বা কন্ট্রাক্ট ব্যক্তির নাম, ঠিকানা এবং স্থানীয় আমন্ত্রণকারীর পূর্ণ পরিচয় ও পাসপোর্ট নম্বর রাখতে হবে। কেউ এসব তথ্য না রাখলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোন বিদেশী অপরাধে জড়িত থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে আইনী ব্যবস্থা নিতে পারবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশী নাগরিকদের জন্য একটি ডাটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ডাটাবেজ তৈরির কাজও চলছে।
×