ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জীবিতকে মৃত দেখিয়ে জমি রেজিস্ট্রি

ভিটেমাটি হারাচ্ছে মানুষ ॥ মংলায় জালিয়াত চক্র

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৩ নভেম্বর ২০১৬

ভিটেমাটি হারাচ্ছে মানুষ ॥ মংলায় জালিয়াত চক্র

নিজস্ব সংবাদদাতা, মংলা, ১২ নবেম্বর ॥ বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের দিগরাজ শেলাবুনিয়া গ্রামের ফুল কুমারী ওরফে ফুলমালা। নিঃসন্তান এ বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়। স্বামী হরষিত মোড়ল মারা গেছেন ৩০ বছর আগে। আর স্বামীর মৃত্যুর পরই কপাল পোড়ে তার। সহায়-সম্পত্তি বলতে যা কিছু ছিল তাও খুইয়েছেন প্রতারক চক্রের কবলে পড়ে। এ চক্রটি জীবিত ফুলমালাকে মৃত দেখিয়ে ওয়ারিশ দাবি নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে শেষ সম্বল জমিটুকু। আপনজন বলতে কেউ নেই তার। দেখভাল ও চিকিৎসাবিহীন ওই বৃদ্ধার রাত কাটে এখন অন্যের বাড়ির বারান্দায়। শুধু ফুলমালা নয়, স্বামী রতন মোড়লের মৃত্যুর পর একই চক্রের খপ্পড়ে পড়েছেন বৃদ্ধা সাবিত্রী। তাকেও মৃত দেখিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই শেষ সম্বল ভিটামাটি বিক্রি করা হয়েছে ভূমি আগ্রাসী কোম্পানির কাছে। ভাই ব্রাজেন ম-লের বাড়িতে আশ্রিত এ বৃদ্ধা হাউ-মাউ করে কাঁদলেন। কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন, আমি শ্মশান থেকে ফিরে আইছি ! একই গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক অভিনাষ চন্দ্র রায় তার পৈত্রিক সম্পতি নিয়ে চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। প্রতারক দালাল চক্র কেড়ে নিতে চাইছে তার ভিটামাটি। কোম্পানির কাছে জমি বিক্রির জন্য তাকে অব্যাহত হুমকি ধামকি ও চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। তার মতো আরও অনেকেই এমন চাপের মুখে রয়েছে। আবার বসত ভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন কেউ কেউ । মংলা বন্দর শিল্প এলাকা ঘিরে এখানে গড়ে উঠছে নিত্যনতুন উৎপাদনমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান। আর সেই সঙ্গে বাড়ছে জমির দালাল ও প্রতারক চক্রের তৎপরতা। দিগরাজ ও বুড়িডাঙ্গা কেন্দ্রিক কয়েকটি দালাল চক্র জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ চক্রের অপতৎপরতায় একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা, অপর দিকে জমির প্রকৃত মালিকরা সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসছে। দিগরাজ শেলাবুনিয়া ও বিদ্যারবাওন এলাকায় অনুসন্ধানে উঠে আসে ভূমিখেকো দালাল চক্রের অপকর্মের অজানা বিচিত্র তথ্য। স্থানীয়রা জানান, শেলাবুনিয়া গ্রামের মৃত দ্বারিকনাথ রায় মোড়লের দুই ছেলে রতন রায় মোড়ল ও ধীরেন্দ্রনাথ রায় মোড়ল। রতন রায় মোড়ল মারা গেলে তার স্ত্রী সাবিত্রী রায় স্বামীর ওয়ারিশসূত্রে এক একর জমিতে স্বত্ববান হন। এদিকে দ্বারিকনাথ রায় মোড়লের ভাই হরষিত রায় মোড়ল মারা গেলে তার স্ত্রী ফুল কুমারী ওরফে ফুলমালা ওয়ারিশ সূত্রে এক একর ২৬ শতাংশ জমির স্বত্ব¡বান। এই দুই নারী নিঃসন্তান। এ অবস্থায় মৃত রতন রায় মোড়লের ভাই ধীরেন্দ্রনাথ রায় মোড়ল লোভের বশবর্তী হয়ে তার বিধবা বৌদির জমি প্রতারণার মাধ্যমে নিজ নামে নামজারি করিয়ে নেন এবং কাকিকে মৃত দেখিয়ে জাল কাগজপত্র তৈরি করেন। তিনি ওই দুই বিধবা নারীর দুই একর ২৬ শতাংশসহ মোট তিন দশমিক ২৮৩১ শতাংশ জমি গত ১ জুন ঢাকার বেঙ্গল এলপিজি লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানের কাছে এক কোটি এক লাখ ১৮ হাজার টাকা মূল্যে (দলিলের বর্ণনা অনুযায়ী) কবলা দলিল করে বিক্রি করে দেন। জীবিত দু’বৃদ্ধাকে মৃত দেখিয়ে জমি আত্মসাত প্রসঙ্গে ধীরেন্দ্র নাথ রায় ওরফে মোড়ল জানান, আমি আমার সম্পত্তি বিক্রি করেছি, অন্য কারও সম্পত্তি নয়। তিনি আরও বলেন, আমি মূর্খ, দলিল যারা লিখেছে তারাই জানে সবকিছু। তবে জীবিত দু’বৃদ্ধার ভরণপোষণ দিচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি। জীবিতদের মৃত দেখিয়ে ওয়ারিশ সূত্রে জমি বিক্রির প্রসঙ্গে বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নিখিল চন্দ্র রায় জানান, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোন ওয়ারিশ সার্টিফিকেট দেয়া হয়নি। তবে নিজের এলাকায় একাধিক দালাল ও প্রতারক চক্রের তৎপরতা নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বর্তমানে এলাকার প্রকৃত জমির মালিকরা নানাভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। জীবিত দু’বিধবা নারীকে মৃত দেখিয়ে যিনি দলিল লিখেছেন, সেই লেখক বিকাশ চন্দ্র ম-ল জানান, কাগজপত্র সঠিক থাকায় তিনি দলিল লিখেছেন এবং রেজিস্ট্রার সম্পন্ন করেন। সাব- রেজিস্ট্রার অঞ্জু দাস মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন বলে জানায় অফিস সহকারী। জালিয়াতির কাগজপত্রে জমি ক্রয় করেছে যে কোম্পানি সেই কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধি রেজাউল করিম জানান, কে মারা গেছে, আর কে বেঁচে আছে তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। কাগজপত্র সঠিক থাকায় বৈধ মালিকের কাছ থেকে জমি ক্রয় করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই করেই সাব রেজিস্ট্রার দলিল সম্পন্ন করেছেন বলে জানান তিনি। শোলবুনিয়া গ্রামে উঠতেই চোখে পড়ে পরিত্যক্ত বাড়ির উঠানে সাঁটানো বায়না সূত্রের মালিকানার সাইনবোর্ড। একই বাড়িতে গাছের সঙ্গে বেঙ্গল এল,পি,জি লিঃ কোম্পানির সাইনবোর্ড সাঁটানো। এ গ্রামের বাসিন্দা সুরঞ্জন মোড়ল জানালেন, মৃত গবিন্দ মহলদারের ছেলে মানষ মহলদার সাইনবোর্ড সাঁটানো জমির প্রকৃত মালিক। কিন্তু জমি বিক্রির দালালখ্যাত নীলকমল গাইন জালিয়াতির মাধ্যমে ১০ কাঠা জমির মালিকানা সূত্রে বায়নাচুক্তি করেছে সহযোগী দালাল সজল দাসের সঙ্গে। আর এ বায়নাচুক্তির কারণে তিনি কোম্পানির সাইনবোর্ড টানিয়েছেন। এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে কথা হয় মানষ মহলদারের সঙ্গে। তিনি জানান, লেখাপড়ার কারণে মা নমিতা মহলদারকে নিয়ে বর্তমানে খুলনায় বসবাস করছেন। তার অভিযোগ, ভুয়া কাগজপত্রে তার পৈত্রিক সম্পতি আত্মসাত করেছে নীলকমল গাইন চক্র। এ চক্রটি প্রভাবশালী হওয়ায় মুখ খোলার সাহস নেই তার পরিবারের। গ্রামের নদীর পাড়ের ভাঙ্গন কবলিত রাস্তায় হাঁটতেই একাধিক কোম্পনির সাইনবোর্ড দেখা যায়। কোথাও কোথাও সাইনবোর্ড দেখা মেলে ফসলি জমিতে, বসত বাড়িতে, বৈদ্যুতিক খুঁটি এবং নদীর চরে। সাংবাদিকদের উপস্থিতি শুনে ছুটে আসেন গ্রামের অসংখ্য নারী পুরুষ। তারা জানালেন সংঘবদ্ধ দালাল ও প্রতারক চক্রের উত্থানের নেপথ্যের কথা। বন্দর সংলগ্ন শিল্প এলাকাকে ঘিরে গড়ে উঠছে জমি বেচাকেনার একাধিক দালাল চক্র। এর মধ্যে শোলাবুনিয়া গ্রামে নীলকমল গাইন, শ্রীনিবাস বায়, সজল দাস, সুজয় বালা, বিষ্ণু বৈরাগী ও দুর্গা বালা, নির্মল রায় দালাল চক্র গং প্রভাবশালী। গ্রামের সনজিৎ রায়, সুজন রায়, কিশোরী শীল জানান, এ চক্রের সদস্যরা এলাকায় দাপট নিয়ে চলে। সাধারণ মানুষের জমিজমা জালিয়াতির মাধ্যমে বেচাকেনা করে থাকে তারা। বড় বড় কোম্পানি এ চক্রের মাধ্যমে কেনে জমি। আর এ জমির দালালি করেই রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছে দালাল চক্রের সদস্যরা। তাদের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হয়ে ভিটামাটি হারিয়েছে গ্রামের অনেকে। আবার অনেক জমির মালিককে হুমকি ধামকিসহ চাপ প্রয়োগ করা হয়। অভিনাষ চন্দ্র রায় জানান, দালাল চক্রটি রাতারাতি জমিজমার কাগজপত্র বদলে দিতে পারে। তারা চাপ প্রয়োগে কোম্পানির কাছে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করে। তাদের কথা মতো জমি বিক্রি না করলে জমির রেকর্ড, পরচা পরিবর্তন হয়ে যায়। ফলে বসত ভিটার জমিও থাকে না। তবে জমি বেচা-কেনায় জালিয়াতির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন নীলকমল গাইন। তার দাবি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া জমি বেচা কেনা সম্ভব নয়। আর এ পর্যন্ত যত জমি বেচাকেনা হয়েছে সব ক্ষেত্রেই বৈধতা রয়েছে। জালিয়াত এ চক্রের সঙ্গে সাব-রেজিস্ট্রার, ভূমি অফিসের কর্মচারীসহ ও ভূমি জরিপ কাজে নিয়োজিতরা জড়িত বলে জানা গেছে। জমির দালাল ও প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য তালুকদার আব্দুল খালেক এবং জেলা পুলিশ সুপারের দফতরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন বলে জানান ক্ষতিগ্রস্তরা।
×