ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এফ এম শাহীন

এ লজ্জা কোথায় রাখি! ॥ অভিমত

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৩ নভেম্বর ২০১৬

এ লজ্জা কোথায় রাখি! ॥ অভিমত

আমি ফটোগ্রাফার নই। ছবিটা কখন তুলেছি বুঝিনি। নাসিরনগর থেকে ফিরে ছবিগুলোর দিকে নজর পড়ল। কয়েকটা ভাঙ্গা মন্দির আর ফালি ফালি করে কাটা ঘরের বেড়াগুলোর চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করেছিলাম। সেখানকার অসহায় ভয়ার্ত মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িকদের তা-বলীলা ছবি তুলে বা লিখে বর্ণনা করা সম্ভব নয়! সম্ভব নয়, তাদের মধ্যে যে আতঙ্ক কাজ করছে- তার বর্ণনা করা। এই শিশুটির মনের মধ্যে যে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তার বর্ণনা দেয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। মানবিক বোধ না থাকলে তা অনুভব সাধ্যও নয়। নাসিরনগরের ভয়াবহতা নিয়ে আগের রাতে কথা বলছিলাম আমরা ক’জন। উদ্বেগ আর ক্ষোভ ঝরছিল সবার বক্তব্যেই। যাই হোক, সেই আলোচনার একপর্যায়ে শ্রদ্ধেয় কানিজ আপা বললেন, আমরা একটা টিম যেতে পারি না? তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম, পরদিন সকালে নাসিরনগর যাব আমরা। আপা আমাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। তিনিও যাবেন আমাদের সঙ্গে। আরও উৎসাহিত হলাম আমরা। সিদ্ধান্ত হলো, সকাল ৭টায় ঢাকা থেকে যাত্রা করব। এখন প্রশ্ন, গিয়ে কি হবে? কি-ই বা করতে পারি আমরা? প্রশ্নটি মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সবাই মিলে অসহায় নির্যাতিত মানুষগুলোর যন্ত্রণা কিছুটা শেয়ার তো করতে পারব। আতঙ্ক ও ভয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবার জন্য তাদের সাহস দেয়ার কিছুটা চেষ্টা তো করতে পারব। তারা অন্তত জানুক, তাদের পাশে কিছু মানুষ আছে, অনেকেই আছে- যারা তাদের বেদনা বোঝে, অনুভব করে। তারা জানুক, তাদের অসহায়ত্ব আরও মানুষকে দগ্ধ করে। নিজেদের মনের গ্লানি কিছুটা অন্তত প্রশমিত করতে পারব তাতে। বিরূপ আবহাওয়া উপেক্ষা করে সকাল ৮টায় যাত্রা শুরু করতে পারলাম আমরা। দুপুর ২টা নাগাদ পৌঁছলাম হরিণবেড়া গ্রামে। প্রতিটি বাড়িতে ঘুরলাম। বর্ণনাতীত সেই দৃশ্য। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, নমঃশূদ্রপাড়া, দত্তপাড়া, কাশিপাড়া, সেনপাড়ায় আক্রমণের আগের দিন মাইকিং করা হয়েছে। রসরাজের শাস্তির দাবিতে পরদিন সকালে সমাবেশে উপস্থিত হতে আহ্বান জানানো হয়েছে। ঘোষণা মোতাবেক সমাবেশে উপস্থিত হয়েছে ছেলে-বুড়ো, মধ্যবয়স্ক, স্থানীয় ও বহিরাগতরা। আক্রমণের ঠিক ২ ঘণ্টা আগে কয়েকজন মহিলাকে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে দেখেছেন অনেকে। তখনও কেউ জানে না তাদের উদ্দেশ্য। কিছু সময় পরেই সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণ শুরু হয়। পাড়ায় পাড়ায় দিগি¦দিক ছুটতে থাকে আতঙ্কগ্রস্ত নারী ও শিশু। অনেক পুরুষ আঘাতে বিক্ষত হয়ে পড়ে কাতরাতে থাকে প্রাণের ভিটার ওপর। সে মুহূর্তে স্থানীয় প্রশাসন এমন পৈশাচিক আক্রমণ প্রতিরোধে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে, তা অনুমান করা যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ ও একেকটি ভয়ার্ত মুখ দেখে। আমরা নাসিরনগরে আক্রমণের শিকার নমঃশূদ্রপাড়ার তা-ব দেখতে দেখতে কাশিপাড়ার অমূল্য দাসের বাড়িতে ঢুকলাম। ঘরের সব কিছু এলোমেলো, হারমোনিয়ামটা পড়ে আছে মাঝখানে, ঘরের আসবাবপত্র ভেঙ্গেচুরে একাকার! আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন ৬৫ বছর বয়সী শঙ্কা আর আতঙ্কগ্রস্ত একজন অসহায় মানুষ। তার চোখে বেশিক্ষণ চোখ রাখা সম্ভব হয়নি তবুও সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করে গেলাম কিছুক্ষণ। জড়িয়ে ধরে অমূল্য দাস একটি কথাই বললেন, ‘বাবা আমরা কোথায় যাব?’ ঘরের মাঝে তার এবং বঙ্গবন্ধুর দুটি ছবি বাঁধানো ছিল। ‘বাবা জান, বঙ্গবন্ধুর ছবিটি মাটিতে ফেলে পাড়ানো হয়েছে’ বলতে বলতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অমূল্য দাসের। পরনের জামা কাপড় পর্যন্ত রেখে যায়নি তারা, একটা পুরনো গামছা পরে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ঘর থেকে লুট করা হয়েছে বেডসিট থেকে শুরু করে মূল্যবান সব কিছ। ঘরে রান্না করা খাবার ফেলে দেয়া হয়েছিল। ঘরের বেড়া দা দিয়ে কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে। যে ক্ষতগুলো বলে দিচ্ছে অসাম্প্রদায়িক নয়, এ এক অচেনা নতুন বাংলাদেশ! শিশুর ছবিটি আমাকে বড় অপরাধী করে দেয়। পবিত্র ধর্মের নামে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা এদেশে এর আগেও বার বার ঘটেছে। প্রতিবারই আমরা বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছি, চিৎকার করে গলা ফাটিয়েছি। কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের ঘটনাগুলোর যথাযথ তদন্ত ও বিচার হতে দেখা যায়নি। এই বিচারহীনতারই সর্বশেষ পরিণতি আজকের নাসিরনগর। শিক্ষা নিতে পারেনি সমাজ, প্রশাসন এমনকি রাষ্ট্র। আর এরই নির্মম ও মর্মন্তুদ শিকার মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী ৩০ লাখ মানুষের রক্তে পাওয়া আমার বাংলাদেশ। সেসব শহীদের তালিকায় উজ্জ্বল হয়ে আছে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের দেশপ্রেমিক পূর্ব সূরিদের নাম। নাসিরনগর নামটি আজ সারাদেশে, এমনকি দেশের বাইরেও ব্যাপকভাবে আলোচিত। সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর টিআরপি বাড়ানোর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে নাসিরনগর। কিন্তু ৮০ ঊর্ধ বয়সী মালা রানী সূত্রধর ও অমূল্য দাসদের কান্নার রং কোন্ মিডিয়ায় প্রকাশিত হবে? আমাদের দেখে মালা রানী সূত্রধর কান্না আর বিলাপে বলছিলেন ‘কেমনে বাঁচুম আমরা? পুলাপান নিয়া ক্যামনে বাঁচুম? ঘরের প্রতিটি আসবাব ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে!’ লুট করা হয়েছে টাকা পয়সা থেকে শুরু করে গহনা, টেলিভিশন, আসবাবপত্রসহ ঘরে মূল্যবান সব জিনিসপত্রও। তাদের ভিতরের দগদগে ক্ষত দেখানোর মতো কোন মাধ্যম যে আজও আবিষ্কৃত হয়নি। এমন অসহায় মানুষদের মর্মন্তুদ যন্ত্রণা আমাদের অভিশপ্ত করবে নিঃসন্দেহে। অপরাজনীতির এই আত্মঘাতী খেলা একদিন সকলকেই আক্রান্ত করবে। আর সেজন্য তৈরি থাকতে হবে আমাদের। শুধু নাসিরনগর নয়, এমন অনেক নাসিরনগর আজকে বাংলাদেশের মানচিত্রে তৈরি হতে পারে। কলঙ্কিত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পর পাকিস্তানী আমলে এদেশের হিন্দুদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর ধর্মনিরপেক্ষ, সহিষ্ণু বাংলাদেশ থেকে কেন স্থানীয় হিন্দুরা আপন ভিটেমাটি ছেড়ে দেশত্যাগ করে যাচ্ছেনÑ এই প্রশ্নটি কি আমরা নিজদের করেছি? ’৭১ সালে যেখানে এদেশে ২৩ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ ছিল, সেখানে ৪৫ বছরে সেই সংখ্যা কি করে ৮ শতাংশে নেমে এল? তার জন্য কারা দায়ী? বার বার কেবল চিহ্নিত প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে দায়ী করে আসছি আমরা। কিন্তু প্রগতিশীলতার মুখোশ পরে যারা এমন পরিস্থিতির ক্ষেত্র তৈরি করে যাচ্ছেন, তাদের চিহ্নিত করাটা এখন সময়ের দাবি। শুধু সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের জন্যই নয়; নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই জরুরী। আমাদের শৈশবে ঈদ, দুর্গাপূজা বা চড়কপূজার আনন্দে কোন পার্থক্য ছিল না। এমন এক চিরায়ত বাঙালী সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠা । হিন্দু ধর্মাবলম্বী যে সব ছোট ভাই বা বোন আমাকে ভালোবাসে, বিশ্বাস করে তাদের চোখের দিকে তাকাতে গিয়ে আজকে বড় লজ্জা হচ্ছে আমার। এই লজ্জা শুধু আমার একার নয়, এই লজ্জা যারা মানবতার কথা বলি, প্রগতিশীলতার কথা বলি, অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলি তাদের সকলের। এখনও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের দামে কেনা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ একদিন এই সাম্প্রদায়িকতার বিষমুক্ত হবে, সমস্ত ক্ষতচিহ্ন একদিন মুছে যাবে। এমন দিন নিশ্চয়ই আসবে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই জাতির পিতার স্বপ্নকে বাস্তবতায় পরিণত করবে। নিশ্চয়ই এই দেশ হবে মানুষের দেশ। লেখক : সংগঠক, গণজাগরণ মঞ্চ ভসংযধযরহ৭১@মসধরষ.পড়স
×