ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের রক্ষাকবচ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৩ নভেম্বর ২০১৬

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের রক্ষাকবচ

প্রথমে ৩০ অক্টোবর এবং দ্বিতীয়বার তিন নবেম্বর দিবাগত রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় কয়েকটি গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ও বাড়িঘরে উপর্যুপরি আগুন দেয়া এবং লুটপাট চালানো হয়েছে। তাতে ডজনের অধিক মন্দির এবং নিরপরাধ হিন্দু পরিবারের শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে। অসহায় মানুষের আর্তনাদে সমস্ত বাংলাদেশ কেঁপে উঠেছে। ঘটনার বৃত্তান্তে এটা পরিষ্কার যে, শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ার জন্যই তাদের ওপর এমন বর্বরতা চালানো হয়েছে। এদের কেউ কোন অপরাধ করেনি। রসরাজ নামের একজন জেলে সম্প্রদায়ের যুবকের ফেসবুক এ্যাকাউন্টে একটি আপত্তিকর ছবি প্রকাশিত হওয়ার সূত্র ধরে এলাকার পুরো সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালানো কোন সভ্য দেশে চলতে পারে না। তারপর এটা এখন সবাই জানেন, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে রসরাজের এ্যাকাউন্টে এমন ছবি তার অজান্তেই অন্য কেউ ট্যাগ করে দিতে পারে। আগেই রসরাজকে আটক করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই রসরাজ নিজে এই কাজ করেছে, তার পরেও কি একজন রসরাজের অপরাধের জন্য পুরো হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালানো যায়? তাই যদি হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠেÑ একজন মুসলমান কেউ অপরাধ করলে পুরো মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর কি আক্রমণ চালানো হবে? ঘটনার বৃত্তান্ত মিডিয়ায় যেভাবে এসেছে তা সত্য হলে স্থানীয় প্রশাসনের চরম ব্যর্থতাই শুধু নয়, সূক্ষ্ম কোন বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তারা জড়িত কিনা তাও খতিয়ে দেখা দরকার। জানা যায়, ইউএনও এবং থানার ওসি আক্রমণকারীদের পক্ষে আয়োজিত সমাবেশে উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য দেন। এটা শোনার পর আমার মনে হয়েছে গায়ে চিমটি কেটে দেখি আমি কি হুঁশে আছি, নাকি অন্য কিছু। এটা তো দেখেছি পাকিস্তান আমলে। গত শতকের পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে প্রলয় কা- ঘটে গেছে তাতে জামায়াত-শিবিরসহ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বড় পক্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল কর্মকর্তারা আজও প্রশাসনের সর্বত্র অত্যন্ত দাপটের সঙ্গেই বিরাজমান রয়েছেন। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের রায়ের সময় এ ব্যাপারে ট্রাইব্যুনাল সরকারের জন্য সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেন। দেশের যে কোন প্রান্তে সামান্য একটা স্ফুলিঙ্গ কি রকম লঙ্কাকা- ঘটাতে পারে তার সাম্প্রতিক উদাহরণ আরব বসন্ত বা আরব উত্থান। তিউনিসিয়ার একজন সবজি বিক্রেতা সরকারের পুলিশের অত্যাচারে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। তারই জের ধরে তিউনিসিয়া, মিসর, ইয়েমেন, লিবিয়াসহ সমগ্র আরব বিশ্বে যে ভয়ঙ্কর লঙ্কাকা- ঘটেছে তা এখন সারা বিশ্বের জন্য ঘুম হারাম করে দিয়েছে। নাসিরনগরের ঘটনাও অবশ্যই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ। কারণ, দেখা গেল নাসিরনগরের ঘটনার পর পরই প্রায় একই সঙ্গে নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও, নেত্রকোনাসহ দেশের অন্যান্য জায়গাতেও মন্দিরের প্রতিমা ভাঙ্গা হয় এবং ঘরবাড়িতে আগুন দেয়ার চেষ্টা হয়। নাসিরনগরে রসরাজের ফেসবুকে আপত্তিকর ছবি ট্যাগ করার খবর প্রকাশিত হওয়ার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরে আক্রমণের ঘটনা ঘটে। মাইকিং হয়, সমাবেশ হয়, দূর গ্রাম থেকে দলবেঁধে লোক আসে। সুতরাং যথেষ্ট সময় প্রশাসনের হাতে থাকার পরেও কেন তা-ব ঠেকানো গেল না তার জন্য শুধু উপজেলা-থানা পর্যায়ের নয়, জেলা ও তার উর্ধতন কর্তৃপক্ষকেও জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত এবং শুধু প্রত্যাহার নয়, ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। প্রশাসনের মধ্যে ভাই-বন্ধু করা মানেই হলো রাষ্ট্রযন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়া। মনে রাখতে হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের রক্ষাকবচ। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সে যে-ই হোক না কেন, কাউকে কোন রকম ছাড় দেয়া যাবে না। বড় ক্ষতি হওয়ার আগে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা প্রয়োজন। পাকিস্তান সময়ের কথা বাদ দিলাম। স্বাধীনতার পরেও অপ্রত্যাশিতভাবে হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত কমে গেছে। অনেকেই দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বলতে যা বোঝায় তা আর থাকবে না। ২০১২ সালে কক্সবাজারে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে একই রকম অভিযোগ ওঠে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমনটা জানা যায়নি। প্রত্যাহার ও বদলি কোন শাস্তি নয়। এটা নিয়মিত ব্যাপার। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা এবং উত্তেজনা সৃষ্টিতে সহায়তা করার অভিযোগে আওয়ামী লীগের তিনজন ইউনিয়ন সভাপতিকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। স্থানীয় এমপি ও মন্ত্রী ছায়েদুল হকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের কথা শোনা যাচ্ছে। অভিযোগ সত্য হলে তা বাংলাদেশের জন্য অশনি সঙ্কেত। বুঝতে হবে আদর্শের দীক্ষা তাদের কাছে পৌঁছায়নি। বঙ্গবন্ধুকে তারা কেবল মুখে ধারণ করে, বুকে নয়। বঙ্গবন্ধুকে যারা বুকে ধারণ করে তারা এ কাজ করতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রকৃতপক্ষেই বঙ্গবন্ধুর আকাক্সক্ষা অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র রাষ্ট্রের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করছেন এবং অনেকটা সফলও হয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষও মনে করে মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শন অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ফিরিয়ে আনার একমাত্র অবলম্বন আওয়ামী লীগ ও এর নেত্রী শেখ হাসিনা। অন্য কোন বিকল্প নেই। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের তো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য দল বেঁধে বুক চিতিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা। সেখানে তারা যদি জামায়াত এবং তার সঙ্গে মুসলিম লীগের প্রতিকৃতি বিএনপির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তি ও চক্রান্তকারীদের পাতা ফাঁদে পা দেয় তাহলে সেটা তো সর্বনাশের কথা। শেখ হাসিনাকে যারা ক্ষমতায় দেখতে চায় না, তারা সকলে সম্মিলিতভাবে বহুমুখী তৎপরতার সঙ্গে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে কৌশলী ভূমিকায় নেমেছে যাতে ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক নষ্ট হয়, দূরত্বের সৃষ্টি হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধিয়ে হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা গেলে চক্রান্তকারীদের লক্ষ্য অর্জন অনেক সহজ হয়ে যায়। নাসিরনগরের ঘটনার পর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবর্তক, সমর্থক ও ধারক-বাহকদের ক্রোকোডাইলস টিয়ারস বা কুমিরের কান্না দেখে কেউ যেন বিভ্রান্ত না হন। এরা তো তারাই, যারা পঁচাত্তরের পর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে হিন্দুশূন্য করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো ইসলামিক রাষ্ট্র ঘোষণার জন্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে খুনীদের মধ্যে অন্যতম মেজর ডালিম বাংলাদেশ বেতার থেকে বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিকান অব বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা দেয় (বাংলাদেশ, অ্যা লেগেসি অব ব্লাড, এ্যান্থনী মাসকারেনহ্যাস, পৃ.-৭৭)। সুতরাং ১৫ আগস্টের মূল ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশকে যে আরেকটি পাকিস্তান স্টাইলের রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিল তা কিন্তু খুনীরা একেবারে প্রথমেই ঘোষণা দিয়ে দেয়। আরেকজন বাঙালী, নাম মাহমুদ আলী, বাড়ি সুনামগঞ্জ। তিনি একাত্তর সালে পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্যকরী সদস্য ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে ইউরোপ আমেরিকা সফর করেন। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের আগেই পাকিস্তানে পালিয়ে যান। এহেন মাহমুদ আলী পাকিস্তানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর দূত হিসেবে ১৫ আগস্টের পর পরই বিশেষ মিশন নিয়ে লন্ডনে হাজির হন এবং বাংলাদেশের খুনী ও সদ্য ক্ষমতায় আসা সামরিক-বেসামরিক অধিকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। মাসকারেনহ্যাসের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে মাহমুদ আলী বলেন, ‘ও ধিহঃ ৎবঁহরভরপধঃরড়হ ড়ভ চধশরংঃধহ, ঃযরং ইধহমষধফবংয ঃযরহম সঁংঃ নব ভরহরংযবফ রিঃয.’ (প্রাগুপ্ত-পৃ.-৮৬)। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে ৭ নবেম্বরের ঘটনার প্রধান সুবিধাভোগী হিসেবে জেনারেল জিয়াউর রহমান এক সময়ে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। সেই ক্ষমতা বলে রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতাসহ মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছু তিনি বাহাত্তরের সংবিধান থেকে বাতিল করে দেন। নিশ্চিত করেন যাতে আগত প্রজন্ম জানতে না পারে একাত্তরের পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যাসহ ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, একাত্তরে পরাজিত ও নিষিদ্ধ জামায়াত মুসলিম লীগসহ সব ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তিকে পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ কের দেন, পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন বাতিল না করা সত্ত্বেও গোলাম আযমকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেন এবং এই মেজর ডালিম, যে ১৫ আগস্টের সকালে বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণা দেন তাকেসহ বঙ্গবন্ধুর সব খুনীকে দায়মুক্তি প্রদানসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি দেন। জিয়াউর রহমানের এসব কর্মের উদ্দেশ্য কি ছিল? কোন জনমত ছাড়া, নির্বাচন ব্যতিরেকে, পার্লামেন্ট ব্যতীত শুধু সামরিক আদেশ ও একক ক্ষমতা বলে তিনি এসব কর্ম কেন করলেন? তিনি তো কোন জননেতা ছিলেন না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে বিএনপির প্রবল বিরুদ্ধাচরণ, বিচার সম্পর্কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অবস্থান, ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে জামায়াত-বিএনপির ক্যাডার বাহিনী কর্তৃক হিন্দু নিধন অভিযান, ২০১৩, ’১৪ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন ও জ্বালাও পোড়াও এবং জিয়াউর রহমানের উপরোক্ত অবৈধ কর্মকা- কি একই সূত্রে গাঁথা নয়? শুধু সময় এবং কর্মের ধরন ও কৌশলের মধ্যে পার্থক্য ছাড়া এগুলোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। ২০০১ সালের নির্বাচনের অব্যবহিত পর জামায়াত-বিএনপির ক্যাডার বাহিনীর পক্ষ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে নির্যাতন নেমে আসে তা বর্ণনাতীত। ২০০৩ সালের ২৩ নবেম্বর বিশ্বখ্যাত দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকার হেডলাইন ছিল- ‘ইধহমষধফবংয ৎবষরমরড়ঁং সরহড়ৎরঃরবং, ংধভব ড়হষু রহ ফবঢ়ধৎঃঁৎব খড়ঁহমঁ.’। সুতরাং ২০১৬ সালে এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে যা ঘটেছে তা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ১৯৭৫ সালের পর জামায়াতসহ যেসব সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান ঘটেছে তারা এখনও পূর্বের অবস্থানে অটুট আছেন। তাদের নীতি, আদর্শ এবং দৃষ্টিভঙ্গির কোন পরিবর্তন হয়নি। তাই সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে প্রতিহত করতে না পারলে ২৩ বছরের সংগ্রাম এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি তা এক সময়ে আর থাকবে না। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×