ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে ঢোল বাঁশির ব্যান্ড পার্টি

ডিজিটাল কীবোর্ড ড্রামসেট এখন আনন্দের অনুষঙ্গ

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৩ নভেম্বর ২০১৬

ডিজিটাল কীবোর্ড ড্রামসেট এখন আনন্দের অনুষঙ্গ

সমুদ্র হক ॥ ব্যান্ড পার্টি এখন শুধু অভিজাত শ্রেণীর আনন্দ অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গ নয়। সেদিনের ঢোল আর বাঁশির ব্যান্ড আজ মিউজিক কীবোর্ডে ডিজিটালাইজড হয়েছে। ঢোলের জায়গায় এসেছে নানা ধরনের ড্রাম সেট। যে অনুষ্ঠানে যে ধরনের গানের সুর দরকার সেই মিউজিক বাজানো হয়। সুর হৃদয়ে দোলা দিলেই হলো। ব্যান্ডের তালে হাত-পা এমনিতেই নাচানাচি শুরু করে দেয়। সুরের জাগতিক জাদুকরি মূর্ছনায় ছেলে বুড়ো সকলেই নেচে ওঠে। বিশ্বের সকল আধুনিক সঙ্গীতে ও ব্যান্ডে যে ড্রাম সেট ব্যবহার করা হয় তার সুতিকাগার এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতির প্রাচীনতম বাদ্যযন্ত্র ঢোল থেকেই বিশ্বের নানা সঙ্গীতের উৎপত্তি। বাংলাদেশের ঢোলকে নিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় উপমহাদেশের বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মন যে গান গেয়েছেন তা চিরন্তনের খাতায় উঠেছে। গানটি হলো ‘তাকডুম তাকডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’। গানেই এই কথা বলে দেয় সঙ্গীতের মূলধারার ঢোল বাংলাদেশেরই সৃষ্টি। ফার্সী ‘দহ’ শব্দ থেকেই ঢোল শব্দের উৎপত্তি। অনেকে মনে করেন এই উপমহাদেশে ঢোলের উদ্ভাবন করেন ওস্তাদ আমীর খসরু। রূপাতীত ধারবাহিকতায় এসেছে ব্যান্ড। ঢোল থেকেই শুরু ব্যান্ডের। বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় পাওয়া রক এ্যান্ড রোল ও জ্যাজ ব্যান্ডে বেস টোল স্লামারে তিন ধরনের ড্রামের সঙ্গে সিম্বেল ও হাইহেডে ড্রামের বাদ্য বিন্যাস করা হয়। বাদ্য বিন্যাসের এই ধারা সাত সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশেও এসেছে। প্রতিটি ড্রামের ধারণা ও ধরন এসেছে আদি ঢোল থেকে। দেশের প্রতিটি জেলায় (কোন কোন উপজেলায়) নিকট অতীতে কোন অনুষ্ঠানে শুধু ঢুলি সম্প্রদায় কোন অনুষ্ঠানে ছন্দের তালে ঢোল বাজিয়ে উৎসবকে মাতিয়ে তুলত। বাংলাদেশে অন্তজ শ্রেণীর সম্প্রদায় ঢুলি নামে পরিচিত। এই শ্রেণীটির আধুনিকায়ন প্রাইভেট ব্যান্ড পার্টি। একটা সময় সিনেমা হলে কোন ভাল ছবি প্রদর্শিত হলে শহরের পথে রিক্সায় ঢোল বাজিয়ে সিনেমার লিফলেট ছড়ানো হতো। পুরান ঢাকায় ঐতিহ্যের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে এক্কাগাড়িতে (দুই ঘোড়ায় বা চার ঘোড়ায় চালিত গাড়ি) ঢোল বাজিয়ে বর কনের বাড়িতে যেত। কনের বাড়ির লোকজন একই ধরনের গাড়িতে চড়ে ফিরতি ভোজের বৌভাতে (পুরনো নাম রুসমত) বরের বাড়িতে যেত। পুরান ঢাকায় পঞ্চাশের দশকের শেষভাগ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা চালু ছিল। ষাটের দশকের মধ্যভাগে পুরান ঢাকায় বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে প্রাইভেট ব্যান্ড পার্টির বিস্তার লাভ করে। দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর দেশের বড় শহরগুলোতে প্রাইভেট ব্যান্ড পার্টি গঠন হতে থাকে। তখন প্রাইভেট ব্যান্ড পার্টি ছিল ঢোল খোল বাঁশি চকচকি দিয়ে সাজানো। একই সময়ে পপ সঙ্গীতের ধারা শুরু হলে সঙ্গীতের ব্যান্ড শিল্পী গোষ্ঠীর আবির্ভাব হতে থাকে। ঢোলের বদলে চলে আসে ড্রাম সেট কঙ্গো ইলেকট্রিক গিটার। এদিকে বিশ্বব্যাপী সঙ্গীতের আধুনিকতায় প্রবেশ করে ইলেকট্রনিক মিউজিক্যাল কীবোর্ড। রোলান্ড ও ক্যাসিও কোম্পানি এমন ডিজিটাল ইলেকট্রনিক ডিভাইস কীবোর্ডে সংযুক্ত করে দেয়। যার হার্ডডিস্কে বাঁশি লিড গিটার বেস গিটার সেতার ও বেহালাসহ পৃথিবীর যে কোন ধরনের বাদ্যযন্ত্রের মিউজিক ও রিদ্ম সেট করে বাজনো যায়। বর্তমানের স্টেজ শোগুলোতে এই ইলেকট্রনিক মিউজিক্যাল কীবোর্ড ব্যবহার হচ্ছে। এর ধাক্কা গিয়ে পড়েছে প্রাইভেট ব্যান্ড পার্টিগুলোতে। তারাও ছোট এক ধরনের ইলেকট্রনিক কীবোর্ড ব্যবহার করছে। জাপান ও চীনের তৈরি এই ছোট কংগ্ কীবোর্ডগুলো ব্যাটারিতেও চলে। ব্যান্ড পার্টির লোকজন ছোট বড় ড্রাম সেটের সঙ্গে সহজে বহনযোগ কীবোর্ড নিয়ে শহর ও গ্রামের যে কোন অনুষ্ঠানে যেতে পারে। প্রাইভেট এই ব্যান্ড পার্টি ভর বছর ডাকের অপেক্ষায় থাকে। শহরে প্রায় প্রতিটি র‌্যালি, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, কোন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, বিশ্ব নৃত্য দিবস, মৎস্য দিবস, সমবায় দিবসসহ নানা দিবসের র‌্যালিতে ব্যান্ড পার্টি না হলেই নয়। পৌষ মেলা, পিঠা মেলা, বৈশাখী মেলাসহ নানা মেলা, ক্রিকেট, ফুটবল খেলার অনুষ্ঠানে ব্যান্ডের ব্যবহার বেড়েছে। সামাজিক কোন অনুষ্ঠান বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠানে ব্যান্ড বাজিয়ে আনন্দের মুহূর্তগুলো স্মরণীয় করে রাখার প্রবণতা শুরু হয়েছে। এই প্রবণতা গ্রাম পর্যায়েও গিয়ে পৌঁছেছে। শহরে ও গ্রামের অনুষ্ঠানে কোন্ গানের সুর বাজবে তাও এখন নির্ধারণ করে দেয়া হয়ে। গ্রামের বেশিরভাগ বিয়ের অনুষ্ঠানে ‘মালকাবানুর দ্যাশেতে বিয়ের বাদ্যি বাজা বাজেরে’ বাজনো হয়। শহরের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে সাধারণত ডিজিটাল সাউন্ড স্পীকারে গান বাজানো হয়। বরের আগমনে হলুদের অনুষ্ঠানে ব্যান্ড পার্টি ভাড়া নেয়া হয়। বগুড়ার প্রাইভেট একটি ব্যান্ড পার্টির মালিক বললেন, সাধারণত ৬ থেকে ৮ সদস্য নিয়ে একটি ব্যান্ড পার্টি গঠন করা হয়। বিয়ে শাদীর বিয়েতে চুক্তি করে বাজানো হয়। দুই দিনের বাজনায় ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা নেয়া হয়। কোন র‌্যালিতে বাজনোর জন্য নেয়া হয় ২ থেকে ৫ হাজার টাকা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পূজা ও তাদের কোন অনুষ্ঠানে ব্যান্ড ভাড়া নেয়। ব্যান্ডের শিল্পীদের রয়েছে বিশেষ ধরনের পোশাক। আগে শিল্পীরা ঢোল খোল বাঁশি বাজাত। বর্তমানে কীবোর্ডে সুর তোলা শিখে তা বাজানো হয়। এই বাদ্যযন্ত্র এখন বাজারেই পাওয়া যায়। সাধারণত অগ্রহায়ণ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ব্যান্ড পার্টির শিল্পীদের মৌসুম। এরপর তারা কৃষি কাজসহ নানা পেশায় জড়িয়ে থাকে। যখন কোন অনুষ্ঠানের ডাক পড়ে তখন এই শিল্পীদের ডেকে আনা হয়। দেশের প্রাইভেট ব্যান্ডপার্টিগুলো এভাবেই এগিয়ে চলেছে। দিনে দিনে বেড়েছে ব্যান্ডের কদর। আগে যা ছিল অভিজাতের অনুষ্ঠানের প্রতীক বর্তমান তা সাধারণে ছড়িয়ে পড়েছে। কে না চায় ব্যান্ডের সুরকে স্মরণীয় করে রাখতে...।
×