ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহী বিভাগের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী

এদেশ সংখ্যালঘুর ওপর হামলা সমর্থন করে না

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৩ নভেম্বর ২০১৬

এদেশ সংখ্যালঘুর ওপর হামলা সমর্থন করে না

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সর্বত্র নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের আন্তরিকতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, এ দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ দেশে সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সর্বত্র নিরাপত্তা দিতে হবে। আর এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। এ ব্যাপারে প্রশাসনের পাশাপাশি দেশের সব জনগণকেও সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। শনিবার গণভবনে রাজশাহী বিভাগের জনগণের সঙ্গে আয়োজিত ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা শান্তিতে বিশ্বাস করি। জঙ্গীবাদ সন্ত্রাসকে আমরা কোনদিন প্রশ্রয় দেব না। এ দেশের মাটিতে কোন সন্ত্রাসী কর্মকা- হবে না। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। কারণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। জনগণ অতীতেও জ্বালা-পোড়াওয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, এবারও রুখে দাঁড়াবে। আন্দোলনের নামে মানুষ খুন ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়ে কোনদিন জনসমর্থন পাবে না। তিনি বলেন, বিগত দিনে বিএনপি-জামায়াত দেশে সন্ত্রাস জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করেছিল। রাজশাহী অঞ্চলে বাংলাভাই সৃষ্টি করেছিল। তাদের আমলেই দেশবাসী দেখেছিল মন্ত্রী-এমপিরা কিভাবে সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়েছে, মানুষের পা ওপরের দিকে বেঁধে মাথা নিচের দিকে রেখে ঝুলিয়ে রেখেছে। তারা ২০১৪ সালের আগে ও পরে দেশে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। আমরা দেশবাসীর সহায়তা চেয়েছিলাম। আপনারা সম্মলিতভাবে এ সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ করেছিলেন। এখনও আহ্বান করছিÑ আসুন সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাই, যাতে এ জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দিয়ে না উঠতে পারে। প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকায় প্রত্যেকের ওপর নজর রাখুন, সহযোগিতা করুন। কাউকে বিপথে যেতে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াতের চরিত্র কোনদিনও শোধরাবে না। আর এ সন্ত্রাসের পথ বেয়েই আজকে এসেছে নতুন উপসর্গ, ধর্মের নামে মানুষ হত্যা। রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলার জনগণের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী ও উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মতবিনিময়ের লক্ষ্যে এ ভিডিও কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। কনফারেন্সের সঙ্গে সময় মিলিয়ে ৮টি জেলার অন্তত ২ হাজার ৯শ’ ৮১টি স্থানে জঙ্গীবাদবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেসব সমাবেশে প্রজেক্টরের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শোনেন তারা। এসব সমাবেশের মধ্যে নাটোর, রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ, জয়পুরহাটের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। এসব সমাবেশে হাজার হাজার মানুষ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে শুনতে এবং কয়েকজন প্রশ্ন করারও সুযোগ পান। এ ভিডিও কনফারেন্সকে ঘিরে রাজশাহী বিভাগের মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। আগামীতে পর্যায়ক্রমে আরও সাত বিভাগে এভাবে মতবিনিময় সভা করবেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপির এক নেতার আন্দোলনের হুঁশিয়ারি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের এক নেতা বলেছেন, তারা নাকি আন্দোলনের তীর দেখিয়েছেন, নবেম্বরে আন্দোলন দেখাবেন। জনগণ অতীতেও জ্বালাও-পোড়াওয়ের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়িয়েছে, এবারও রুখে দাঁড়াবেন। জনগণ অতীতেও জ্বালাও-পোড়াওয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, এবারও রুখে দাঁড়াবে। আন্দোলনের নামে মানুষ খুন ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা কোনদিন জনসমর্থন পাবে ন। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে জনগণকে বলে দেন, প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকায় প্রত্যেকের ওপর নজর রাখবেন, কেউ বিপথে যায় কিনা খেয়াল রাখবেন। সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী সংখ্যালঘু নিরাপত্তার বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম। প্রত্যেক ধর্মের মূল বাণীও তাই। প্রত্যেক ধর্মের মানুষ তার ধর্ম পালন করতে পারবে, এটাই ইসলামের কথা; এটাই পবিত্র কোরানের কথা। আমরা এটাই মেনে চলি। তিনি বলেন, জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ ইসলামের পথ না। কাজেই এটাই চাইব, দেশের প্রত্যেকটা মসজিদে ইমাম সাহেবরা বা যারা জুমার নামাজের আগে খুতবা দেন, সেখানে আপনারা এ জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে নবী করিম (স) কী বলে গেছেন, কোরানে কী আছে, ইসলাম ধর্ম কী বলেÑ এ বিষয়গুলো মানুষকে আরও ভালভাবে জানান। যাতে এ ধরনের আত্মঘাতী পথে কেউ পা না বাড়ায়। বক্তৃতার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করেন এবং দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে এ দেশকে স্বাধীন করার কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যখন দেশকে গড়ছিলেন, দেশকে তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করছিলেন, ঠিক তখনই পরাজিত শক্তি চক্রান্ত করে তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে অন্ধকার নেমে আসে। তারপর ক্ষমতা দখলকারীরা লুটপাট শুরু করে। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এ সরকার উন্নয়ন-জনসেবার মধ্য দিয়ে জনগণকে বোঝাতে সমর্থ হয়, সরকার জনগণেরই সেবক। আওয়ামী লীগ তার উন্নয়নের ধারা এখনও অব্যাহত রেখেছে। তিনি বলেন, আজকে বিশ্ববাসী স্বীকার করেÑ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে অনেকে ঈর্ষান্বিত হয়। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি ৪৫ বছর হয়ে গেছে। আজকে যদি জাতির পিতা বেঁচে থাকতেন তাহলে এ বাংলাদেশ আরও বহু আগেই উন্নত হতে পারত। কিন্তু তাঁর সেই অসমাপ্ত কাজ আমাদের সম্পন্ন করতে হবে। মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষ উন্নত জীবন পাবে, সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংসতা ও পুড়িয়ে মানুষ হত্যার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ যখন উন্নয়ন-সমৃদ্ধির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন সেই পরাজিত শক্তি মানুষকে ভোট দেয়া থেকে বিরত রাখতে আন্দোলনের নামে হরতাল-অবরোধ করে সহিংসতা ও তা-ব চালায়। আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করে। তাদের (বিএনপি-জামায়াত জোট) সেই অবরোধ-হরতালের আগুনে ৫০৮ জন মানুষ দগ্ধ হয়েছেন, ৫৮২ স্কুল তারা আগুনে পুড়িয়েছে। সাধারণ মানুষকে পেট্রোলবোমার আগুনে মেরেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, নির্বাচনী অফিসারকেও তারা পুড়িয়ে মেরেছে। তারাই এ দেশের ছেলেমেয়েদের বিপথে নিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সরকারের কড়া অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, আমাদের দেশে এখন নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তা হলো ধর্মের নামে মানুষ হত্যা। এখন একটা শ্রেণী হয়েছে, তারা একদিকে ইসলামের নাম নিচ্ছে, আরেকদিকে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ চালাচ্ছে। আমাদের সরকার এ ধরনের সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ব্যাপারে কোন ছাড় নয়। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়, এটাই হলো বাস্তবতা। আমি আগে যে বিভাগের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি, সেখানেও বলেছি সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে আমাদের এক হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আপনাদেরও বলছি, জ্বালাও-পোড়াও-সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সকলকে মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী দেশের সব অভিভাবক, শিক্ষক ও সাধারণ জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, জ্বালাও-পোড়াও-সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ান। আমরা সব সময় চাই, আমাদের দেশে সম্প্রীতি বজায় থাকবে, দেশে উন্নতি হবে। আপনার ছেলে কোথায় কী করছে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকলে খোঁজ নিন। আপনার সন্তান যেন ভুল পথে না যায়, ভুল পথে গেলে তাকে সংশোধন করার দায়িত্ব নিন। মনে রাখবেন, দেশের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধাই হচ্ছে জঙ্গীবাদ। আমরা কোনভাবেই এক্ষেত্রে কোন ছাড় দেব না। দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা আগেই দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছি নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে গৃহহারা ও হতদরিদ্র মানুষের তালিকা তৈরি করতে। এখনও কুঁড়েঘরে কোন মানুষ থাকার খবর থাকলে আমাদের জানাবেন, দেশের একটি মানুষও ভূমিহীন থাকবে না। প্রত্যেকে ঘর তৈরি করে দেয়া হবে। ব্যক্তি উদ্যোগে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নিজ উদ্যোগে শিল্প-কলকারখানা স্থাপন করুন। তবে পরিবেশ যেন বজায় থাকে, সেজন্য পুকুর-ডোবা-নালা রাখতে হবে। গাছ লাগাতে হবে। ভিডিও কনফারেন্সে বক্তব্য দিতে গিয়ে বগুড়া সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাবেয়া খাতুন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়া ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ বলে উল্লেখ করে তিনি মেডিক্যালের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে নেয়ার অনুরোধ করেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী ভর্তি পরীক্ষার জটিলতা দূর করতে তার সরকারের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে বলেন, অনলাইনে যদি আমরা ঘরে বসে কেনাকাটা করতে পারি, তাহলে কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারব না? আমরা ভবিষ্যতে সব ভর্তি পরীক্ষাই অনলাইনে করার ব্যবস্থা করব। এর ফলে পরীক্ষার্থীরা স্থানীয় ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে পরীক্ষা দিতে পারবে। চাইলে বাসায় বসে তারা পরীক্ষা দিতে পারবে। এর ফলে সবার জন্য ভর্তি পরীক্ষা আরও সহজ হবে। গণভবনে অনুষ্ঠিত এই ভিডিও কনফারেন্স পরিচালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক কবির বিন আনোয়ার। এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামসহ সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা, শিক্ষক, জেলা প্রশাসক, কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ পান। প্রতিটি স্থানেই এই মতবিনিময় অনুষ্ঠান রীতিমতো সমাবেশে রূপ নেয়।
×