ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল হক নিয়োগী

আমিন ও পথিক

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১২ নভেম্বর ২০১৬

আমিন ও পথিক

আমিন থাকে পাহাড়ের কাছে। তারা দুই ভাই দুই বোন। মা-বাবা। সবাই মিলে ছয়জনের সংসার চলে কষ্টেসৃষ্টে। আমিনের বাবা একদিন শহরে চলে যায় কাজের খোঁজে। ফসল কাটা হলে প্রতিবছরই বাবা শহরে যায়। রিক্সা চালায়। আমিন আর ছোট ভাই স্কুলে লেখাপড়া করে। আমিন সেভেনে আর ভাইটি ফাইভে পড়ে। বোনেরা ছোট। এখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। একদিন আমিনের মা ঘরের সিঁড়িতে পড়ে যায়। পায়ে খুব ব্যথা পায়। ভাইবোনদের মধ্যে আমিনই বড়। সে স্কুলে গেছে। মা ব্যথায় মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে দেখে অন্য ভাইবোনেরা পাশে বসে কান্নাকাটি শুরু করে। বিকেলে আমিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখে মায়ের পায়ে ব্যথা। আমিন কী করবে ভাবতে পারছে না। ঘরে টাকাপয়সাও নেই যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। এই পাহাড়ী এলাকায় ডাক্তার পাওয়াও মুশকিল। সে মাকে জিজ্ঞেস করে, ঘরে টাকাপয়সা আছে, মা? তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। মা অনেক কষ্টে বলল, টাকা নেই রে বাপ। থাক, ওষুধ লাগবে না। এমনিতেই সেরে যাবে। আমিন বলল, তুমি পায়ে জলপট্টি দাও। আমি দেখি ব্যথার কোন ওষুধ আনতে পারি কিনা। আমি একটা কাপড় ভিজিয়ে জলপট্টি দেয়ার ব্যবস্থা করে। ছোট ভাইকে শিখিয়ে দেয়। তারপর সে দৌড়ে যায় পাড়ার নিতাই কাকার কাছে। নিতাই কাকার সব খুলে বলে। নিতাই আমিনের হাতে এক শ’ টাকা দিয়ে বলল, তুমি বাজার থেকে ওষুধ নিয়ে আস। এই অবেলায় কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। নিতাই এক শ’ টাকা নিয়েই দৌড়াতে শুরু করে। পাহাড় পেরিয়েই নদী। নদীর ওপারে বাজার। বাজারটি তিন মাইল দূরে। সন্ধ্যার আগে ডাক্তারকে পেতে হবে। গ্রামের বাজার, তাই সন্ধ্যার পর বাজারে কেউ থাকে না। আমিন খেয়া পার হয়ে এক সময় গিয়ে পৌঁছায় বাজারে। বাজারে হরেন্দ্র ডাক্তারের কাছে মায়ের পায়ের ব্যথার কথা বলে। হরেন্দ্র ডাক্তার বলল, পায়ের ব্যথার জন্য কী ওষুধ দেব বুঝতে পারছি না। একটা মলম দিলাম এটা মালিশ করে দেখ কমে কিনা। কাল সকালে সদরে নিয়ে যাবে। হাড় ভাঙলে ভাল চিকিৎসার দরকার। আমিন ওষুধ নিয়ে আবার দৌড়াতে শুরু করে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অন্ধকার। নির্জন পথ। ভয়ও পাচ্ছে। আরও ভয়, যদি খেয়া না পাওয়া যায় তাহলে বিপদের সীমা থাকবে না। নদীর কাছে এসে দেখে খেয়া নেই। হায় কপাল! কী করবে এখন? আমিন সাঁতরিয়ে নদী পার হয়। পলিথিন দিয়ে মুড়ে মলমের কৌটা বাঁচাতে পারলেও জামাকাপড় ভিজে সারা। নদীটা খুব বড় নয়। ছোট। পাহাড়ী নদী যেমন হয়। নদী পার হয়ে আমিন হাঁটতে থাকে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর ছোট একটা পাহাড়ের কাছে আসতেই দেখে একজন বৃদ্ধ লোক মাটিতে পড়ে আছে। সামনে একটা বড় পোটলা। লোকটির পাশে দাঁড়িয়ে আমিন ভাবল, লোকটি পড়ে গেল কেন? সে টেনে তুলল। বৃদ্ধ লোকটি বলল, বাবা, আমি তো রাতকানা। সন্ধ্যা হওয়ার পর চোখে দেখি না। তুমি কি আমাকে আমার বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারবে? না-হয় আজ আর বাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়। পথে না খেয়ে রাত কাটাতে হবে। আমি ডায়াবেটিসের রোগী। সুগার নেমে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু। আপনার বাড়ি কোথায়? আমার বাড়ি ওই যে বাশাইল গ্রামে। দক্ষিণের ছোট পাহাড়টার ওপারেই। সে তো অনেক দূর। সে আর কত দূর? ওই তো পাহাড়ের ওপারেই। আমি পারব না। আমাকে মায়ের ওষুধ নিয়ে এখনই যেতে হবে। মায়ের পায়ে ব্যথা। আপনাকে কীভাবে নিয়ে যাব? তারপর সন্ধ্যা হয়ে গেছে। লোকটি অবাক হয়ে বলল, তোমার মায়ের ব্যথা? সন্ধ্যা? আমার জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল? আমি যদি মারা যাই? আমিন চিন্তায় পড়ে যায়। ঠিকই তো, লোকটি যদি মারা যায়? এ যে মায়ের ব্যথার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি যে অন্ধকারে ভয় পাই। কিন্তু ভয়ের চেয়ে যে লোকটির জীবন বাঁচানো বড় কর্তব্য। আমিন বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত? লোকটি আমিনের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে। বৃদ্ধ লোকটিকে দেখে এক সময় আমিনের বড় মায়া হয়। মায়ায় তার বুক ভরে যায়। সে বলল, চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। বড় পোটলাটি আমিন মাথায় নেয়। বৃদ্ধকে হাতে ধরে বলে, আমার হাত ধরে হাঁটুন। বৃদ্ধ লোকটি আমিনের হাত ধরে হাঁটতে থাকে। পোটলাটি এত ভারি যে আমিনের বইতে জান বের হয়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে ওরা দক্ষিণের পাহাড়টি পার হয়। তারপর অনেক কষ্টে দুজনকে নিয়ে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরে গিয়ে ঢোকে। বৃদ্ধ লোকটি কুপিবাতি জ্বালায়। বৃদ্ধ লোকটি বলল, তোমার মায়ের জন্য কী ওষুধ এনেছ? আমিন কোমরের কোঁচর থেকে মলমটি বের করে দেখায়। বৃদ্ধ লোকটি মলমের কৌটাটা হাতে নিয়ে দূরে ছুড়ে মারে। আমিন ধমক দিয়ে বলল, এটা কী করলেন? আমার মায়ের ওষুধ ফেলে দিলেন? বৃদ্ধ লোকটি মুচকি হেসে বলল, ধমক দেবে না। মুরব্বিদের ধমকানো ঠিক না। কথাটি শেষ করে লোকটি ঘরের কোণ থেকে একটি কাঁচের বোতল বের করে বলল, তোমার মায়ের পায়ে এই তেলটা মালিশ করবে। ঠিক হয়ে যাবে। আমিন অবাক হয়ে লোকটিকে দেখে। ওর মনে হয় লোকটি রাতকানা নয়। ভয়ে সে আবার জড়সড় হয়ে বলল, আমি এখন যাব? লোকটি মুচকি হেসে বলল, অন্ধকারে কীভাবে যাবে? এই নাও টর্চ লাইটটা। তাড়াতাড়ি যাও। তুমি আমার বড় উপকার করলে। সৃষ্টিকর্তা তোমার ভাল করবেন। আর কাল দিনের বেলায় এসে টর্চটা দিয়ে যেও। আমিন টর্চ লাইট নিয়ে দৌড়াতে থাকে। আর ভাবতে থাকে লোকটি সম্পর্কে। শেষ পর্যন্ত সে বাড়ি যায়। মাকে সব ঘটনা খুলে বলে। মায়ের পায়ে তেল মালিশ করে দেয়। মা অনুভব করে, ব্যথাটা দ্রুত সেরে যাচ্ছে। মা বলল, বাবা আমিন, বৃদ্ধকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বড় ভাল কাজ করেছ। তোমার জন্য আজ আমার গর্ব হচ্ছে। মা আমিনকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আনন্দে মায়ের চোখের কোণ বেয়ে পানি নামে।
×