ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শচীন দেব বর্মণ উৎসব শুরু

আমার পরাণে প্রেমের বিন্দু তুমিই শুধু তুমি...

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১২ নভেম্বর ২০১৬

আমার পরাণে প্রেমের বিন্দু তুমিই  শুধু তুমি...

মোরসালিন মিজান ॥ শচীন দেব বর্মণের গান! শুধুই শচীন দেব বর্মণের! সেই কবে কোন কালের কথা সুর। তবু ভেতরে বাজে। মনে কেমন দোলা দিয়ে যায়। সুযোগটি তাই হাতছাড়া করেননি ভক্ত অনুরাগীরা। প্রবীণদের মনে ফাগুন লেগেছিল। নবীনরাও বুঁদ হয়েছিল গানে। নাচও ছিল দারুণ উপভোগ্য। এভাবে প্রথম দিনেই বেশ জমে ওঠে শচীন দেব বর্মণ সঙ্গীত উৎসব ও নৃত্য সন্ধ্যা। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় উৎসবের আয়োজন করেছে সাংস্কৃতিক সংগঠন বহ্নিশিখা। জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে শুক্রবার উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। নাতিদীর্ঘ আলোচনা পর্ব শেষে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। মঞ্চে আসেন বহ্নিশিখার শিল্পীরা। সম্মেলক কণ্ঠে প্রথবারের মতো হেসে খেলে উঠেন শচীন দেব। দুটি খুব বিখ্যাত গান গেয়ে শোনান শিল্পীরা। প্রথমটি ছিলÑ ‘বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে-গীতিতে-/হৃদয়ে দিয়েছ দোলা/রঙ্গেতে রাঙ্গিয়া রাঙ্গাইলে মোরে/একি তব হরি খেলা?’ এমন চিরচেনা সুর শুনে কেউ আর নীরবে বসে থাকতে পারেন? শ্রোতারাও গুণগুণ করে গাইতে থাকেনÑ আমার পরাণে প্রেমের বিন্দু/তুমিই শুধু তুমি...। ‘ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা পান খাইয়া যাও মাঝি’ গানটিও উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে দেয় মিলনায়তনে। শচীন দেব বর্মণের গানের অনুরাগী শ্রোতা অসংখ্য। কিন্তু তার গান যতেœর সঙ্গে কণ্ঠে তোলার মতো শিল্পী খুব বেশি নেই। তবে এদিন অনেকেই চেষ্টা করেছেন। সুন্দর গেয়েছেন মামুন জাহিদ খান, তানসেন রহমান ও আবিদা রহমান সেতু। একক সঙ্গীত পরিবেশন করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন তারা। এদিন আরও গেয়েছেন কলকাতার শিল্পী দোলা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গীত পরিবার থেকেই ওঠে আসা। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়েছেন। লোকসঙ্গীত করেন। বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী ঝুমুর গান নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। এদিন শোনালেন শচীন দেব বর্মণের গান। গায়কীটা বেশ। স্বতন্ত্র একটি ঢং। মনে হয় না, নতুন গাইছেন। তবে প্রথম দিনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পরিবেশনা ছিল ‘নবনালন্দা’র। কলকাতার বেশ নাম করা প্রতিষ্ঠান। পঞ্চাশ বছর ধরে সঙ্গীত নৃত্য ইত্যাদির শিক্ষা দিচ্ছে। এদিন শিল্পীদের পারফর্মেন্সও সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। চমৎকার একটি নৃত্যগীতি আলেখ্য পরিবেশন করে ভারতের এই দল। শচীন দেব বর্মণের বেশ কয়েকটি বিখ্যাত গানের অংশবিশেষ নিয়ে মালা গাঁথেন তারা। ‘নিশিতে যাইও ফুল বনে রে ভ্রমরা’, ‘রঙিলা রঙিলা রঙিলা রে’, ‘তাকদুম তাকদুম বাজে’ গানগুলো একত্রিত করে একটি কম্পোজিশন দাঁড় করান। যুক্ত হয় ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠ। এর সঙ্গে মঞ্চে নাচেন একদল শিল্পী। প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা দলে ছিলেন। আলো ছড়ান দেবলীনা কুমার, দীপ্তাংশু পাল, গার্গি নিয়োগীর মতো স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পীরা। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছিল ইমন চক্রবর্তী, এরিনা মুখার্জী, শীর্ষ রয়, সৌমিক পাল প্রমুখের কণ্ঠ। সব মিলিয়ে বেশ কাটে সময়টা। পরিবেশনা শেষে কথা হয় দলের অন্যতম সদস্য মৌসুমী ঘোষের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মূল পরিবেশনাটি ছিল দেড় ঘণ্টার মতো। এখানে অনেকটা ছোট করা হয়েছে। এরপরও শচীন দেব বর্মণের মতো শিল্পীকে স্মরণ করতে পারার সুযোগ পেয়ে তারা খুশি বলে জানান। এর আগে উৎসবের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন শচীন দেব বর্মণ সঙ্গীত ও নৃত্য উৎসব উদযাপন পর্ষদের আহ্বায়ক গোলাম কুদ্দুছ। প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আমি নিজে শচীন দেব বর্মণের অন্ধ ভক্ত। আজ থেকে নয়, একেবারে ছোটবেলা থেকে। শচীন কর্তার গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। আর যত বড় হয়েছি ততই আবিষ্কার করেছি তার গানের কথা ও সুরের বৈচিত্র্য। মহান শিল্পী ভারতের বোম্বে গিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু এই যে বাংলার গ্রাম, গ্রামীণ জীবন থেকে ওঠে আসা সুর তিনি কোনদিন ভুলেননি। নিজের কলেজ জীবনের স্মৃতিচারণ করে বিশিষ্ট এই সংস্কৃতিজন বলেন, একটি হিন্দি সিনেমা তখন মুক্তি পেয়েছে। ওই সিনেমার একটি গান সবার মুখে মুখে। গানটির সুরকার ছিলেন শচীন দেব। তাকে আজ স্মরণ করা হচ্ছে। স্মরণ করার মধ্য দিয়ে আমরা নিজের সংস্কৃতির কাছে, বাঙালীত্বের কাছে, জন্মের উৎসের কাছে ফিরে যাই। কুমিল্লায় শচীন দেব বর্মণের পৈত্রিক ভিটা বহুকাল দখলে ছিল। সেই বাড়ির বড় একটি অংশ দখলমুক্ত করা হয়েছে। এখন সংস্কার কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাকিটুকু উদ্ধার করে সেখানে জাদুঘর নির্মাণ করা হবে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, সঙ্গীতের মধ্য দিয়েই বিকশিত হয়েছে শচীন দেব বর্মণের জীবন। বাংলার সুর তাল লয় নিয়েই ভারতে পাড়ি জমান তিনি। খুব একটা কথা বলতেন না। গানে গানে বলার চেষ্টা করতেন। চলচ্চিত্রের গানের মাধ্যমে গোটা ভারত বর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। শৈশবের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, যৌবনের প্রেম ভালবাসা এমনকি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিল তার গান। শচীন দেব বর্মণ বাঙালীর অনুপ্রেরণার উৎস উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ কারণে মৃত্যুর ৪১ বছর পরও আমরা তাকে স্মরণ করি। ফকির আলমগীর বলেন, শচীন কর্তার গানের সুর এত স্বতন্ত্র যে, শুনলেই চেনা যায়। লোকায়ত গানের সুরকে আশ্রয় করেই আধুনিক আঙ্গিকের গান করেছিলেন তিনি। আজ শনিবার উৎসবের দ্বিতীয় দিনটিও বেশ উপভোগ্য হবে। আজ একক সঙ্গীত পরিবেশন করবেনÑ জনপ্রিয় শিল্পী সুবীর নন্দী, কিরণ চন্দ্র রায়, সুজিত মুস্তাফা, বাবু রহমান, চন্দনা মজুমদার, রুপালি চম্পক, পাপিয়া, সন্দিপন প্রমুখ। ভারতের ত্রিপুরার শিল্পীদের মধ্যে থাকবেন রাকেশ দেব বর্মণ, তনুজা দেব বর্মণ ও সুব্রত দেবনাথ। নৃত্য পরিবেশন করবে স্পন্দন ও বহ্নিশিখা। রবিবার সন্ধ্যায় সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সৌমিত্র ড্যান্স গ্রুপ পরিবেশন করবে বীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সহজপাঠ’ ও সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’। একই দিন নৃত্য পরিবেশন করবে ভারতের বহরমপুরের ‘কলাক্ষেত্র।’
×