ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নয় মাসে রেলে টা পড়ে ৭২৯ জনের মৃত্যু

মুঠোফোনের অপব্যবহারে অকালে ঝরছে প্রাণ, সংসার তছনছ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১২ নভেম্বর ২০১৬

মুঠোফোনের অপব্যবহারে অকালে ঝরছে প্রাণ, সংসার তছনছ

এমদাদুল হক তুহিন ॥ মুঠোফোন ছাড়া এক মুহূর্ত কি চলে! আজকের জীবনে মুঠোফোন গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। জীবনের নানা ঘটনায় ত্বরিত সমাধান এনে দেয় মুঠোফোন। কিন্তু সেই ফোনের অপব্যবহার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটায়। কখনও কখনও তছনছ করে দেয় সাজানো জীবন। গত নয় মাসে সারাদেশে রেললাইনের ওপর থেকে ৭২৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সংখ্যাটি আঁতকে ওঠার মতো। এদের সব কি আত্মহত্যা, পুলিশ বলছে না। এদের অনেকেই মুঠোফোনে কথা বলতে গিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে রেল রাস্তা ধরে চলতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়েছেন। উঠতি তরুণ-তরুণীরা যন্ত্রটি ব্যবহার করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খোশগল্পে মেতে থাকছে। রাতজেগে কথা বলায় বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ যোগ দিতে পারে না সকালের গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসেও। পরীক্ষায় নেতিবাচক ফল আসায় এদের অনেককে বাধ্য হয়ে দিতে হয় সেমিস্টার ড্রপ। দেশ বা দেশের বাইরে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধব সকলের খোঁজখবর নিতে হলে মুঠোফোনই সব থেকে ভাল মাধ্যম। এর বাইরেও ইন্টারনেটের দুনিয়া এখন চলে এসেছে মুঠোফোনে। চাইলেই দুনিয়াকে খুঁজে পাওয়া যায় সাড়ে পাঁচ ইঞ্চির ডিসপ্লেতে। ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে সর্বত্রই এর ব্যবহার যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে মুঠোফোনের অপব্যবহার। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মুঠোফোন থেকে বের হওয়া রেড্রিফ্রিকোয়েন্সির ফলে ব্রেন টিউমার হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে ওঠে। এমনকি হতে পারে ক্যান্সারও। যন্ত্রটি ব্যবহার করে মাত্রাতিরিক্ত কথা বলার কারণে অস্থিরতা, মনসংযোগ না থাকা, গুরুত্বপূর্ণ কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করতে না পারাসহ নানাবিধ সমস্যার শিকার হচ্ছে মানুষ। রেলপথে মৃত্যুর বড় কারণ কানে মুঠোফোন ॥ গত নয় মাসে সারাদেশে রেলপথ থেকে ৭২৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রেলওয়ে পুলিশ বলছে, অসতর্কতা, হত্যা ও আত্মহত্যার পাশাপাশি মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রেলপথ পার হওয়া এসব মৃত্যুর বড় কারণ। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত একটি থানা এলাকায় চলতি বছরের ৯ মাসে ২৩০টি লাশ উদ্ধার হয়। এদের মধ্যে ১০৬ জন মারা যায় মুঠেফোনে কথা বলতে বলতে রেলপথ পার হওয়ার সময়। তথ্য রেলওয়ে পুলিশের। চলতি বছরের ১৭ মে দুপুরে পূর্ব নাখালপাড়া থেকে পশ্চিম নাখালপাড়ায় যাচ্ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র ওবায়দুল্লাহ। তার কানে মুঠোফোন ও হাতে ছিল আইসক্রিম। ট্রেন কাছাকাছি চলে এলে আশপাশের লোকজন চিৎকার করে তাকে সরে যেতে বলে। কিন্তু কথায় তিনি এতটাই মগ্ন ছিলেন যে, কিছুই শুনতে পাননি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান তিনি। সেদিনকার ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছিলেন এমন তথ্য। একই রকম ঘটনা ঘটেছে আইনজীবী সালাহ উদ্দীন ফটিকের ক্ষেত্রে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর কানে মুঠোফোন ধরে তিনি মালিবাগ রেলগেটে রেললাইন পার হচ্ছিলেন। রেললাইন পার হওয়ার আগেই ট্রেন চলে আসে। মুহূর্তেই ট্রেনে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। রেলওয়ে থানার এক কর্মকর্তা বলেন, রেলগেটে থাকা রেলকর্মীরা প্রতিবন্ধক বারও নামিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরও তিনি রেললাইন পার হতে যান। কানে মুঠোফোন থাকায় তিনি ট্রেনের শব্দ শুনতে পাননি। কেবল মুঠোফোনে কথা বলার কারণে অহরহ ঘটছে এমন দুর্ঘটনা। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কানে মুঠোফোন থাকায় অনেক সময় দ্রুতগতির ট্রেনের শব্দ শোনা যায় না। তাই মুহূর্তেই ট্রেনে কাটা পড়ে চিরতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে অনেকে। রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সচেতনতার অভাবে দিন দিন এ ঘটনা বাড়ছে। রাজধানীর মহাখালী ও খিলক্ষেতে ট্রেনে কাটা পড়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কুড়িল বিশ^রোড এলাকায় রেললাইন বাঁকা হওয়ায় ট্রেন এলেও দেখা যায় না। আর বনানী থেকে কাওরানবাজার পর্যন্ত রেললাইনের পাশে গড়ে উঠেছে বস্তি। মহাখালী থেকে নাখালপাড়ায় যাওয়া-আসার পথে এ এলাকার বাসিন্দাদের কেউ কেউ রেললাইনকে পথ হিসেবে ব্যবহার করেন। আবার নাখালপাড়া রেলগেট থেকে তেজগাঁও রেলস্টেশন পর্যন্ত রেললাইনের পাশ ধরে গড়ে উঠেছে অবৈধ কাঁচাবাজার। এছাড়া রয়েছে বেশ কয়েকটি অবৈধ রেলক্রসিং। সরেজমিন মহাখালী রেলগেট এলাকায় দেখা গেছে, রেলপথ ধরে হাঁটছে কয়েক শ’ মানুষ। রেলগেটের নিরাপত্তা বার ফেলার পরও দৌড়ে পার হচ্ছেন অনেকেই। কেউ কেউ মোটরসাইকেল চালিয়েও যাচ্ছেন এপাশ থেকে ওপাশে। মহাখালী রেলগেটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, সপ্তাহখানেক আগে রেলগেটের উত্তর পাশে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন একজন। মানুষকে নিষেধ করলেও তারা তা মানেন না। বরং কথা বলতে বলতেই রেললাইন ধরে হেঁটে যান। একই স্থানে কর্তব্যরত নূর মোল্লা বলেন, রেলগেটের বার পড়ে যাওয়ার পরও এক শ্রেণীর মানুষ দৌড়ে তা ক্রস করেন। আবার এদের কারও কারও কানে থাকে মুঠোফোনও। তিনি জানান, রেললাইন ধরে কথা বলতে বলতে মানুষ পার হয়, ডাকলেও শোনে না। অনেক সময় নিষেধ করলে খারাপ ব্যবহার করে। এমন অসচেতনতার কারণেই ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। মুহূর্তেই বিনষ্ট হচ্ছে কোন একটি পরিবারের সাজানো স্বপ্ন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই। মুঠোফোনে কথা বলায় সড়ক দুর্ঘটনা ॥ চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যাত্রাবাহী ইউনিক পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে ম্যাজিক গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে মা-মেয়েসহ পাঁচজন নিহত হয়। ওই ঘটনায় শিশুসহ আরও ৯ জন আহত হয়। ওই ঘটনায় পুলিশের কাছে বাসের যাত্রীদের অভিযোগ, মুঠোফোনে চালক কথা বলার কারণেই এ দুর্ঘটনা। একই ভাবে মাধবকু- জলপ্রপাত থেকে বনভোজন শেষে ফেরার পথে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি বাস ছিটকে পড়ে পাশের মাঠে। এতে সাত শিক্ষার্থীসহ দুই শিক্ষক আহত হন। এ ঘটনায় এক শিক্ষক সাধারণ ডায়েরি করলেও চালককে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। আইনের প্রয়োগ না থাকায় নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলন্ত গাড়িতেই মুঠোফোন ব্যবহার করছে চালকরা। ফলে মহাসড়কে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। এভাবে নিমিষেই নিঃশেষ হচ্ছে তাজা প্রাণ। সেই সঙ্গে বিনষ্ট হচ্ছে কোন কোন পরিবারের আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পারাপার ॥ ফার্মগেটের আল রাজী হাসপাতালের কয়েক শ’ গজ দূরেই দুটি ফুট ওভারব্রিজ। রাস্তা পারাপারে এখানে কোন জেব্রাক্রসিং নেই। সিগন্যাল পড়ামাত্রই মূল সিগন্যাল পয়েন্টের কাছ দিয়ে এখানে শত শত মানুষ রাস্তা পার হন। দুর্ঘটনার প্রবল শঙ্কা সত্ত্বেও অনেককে কানে মুঠোফোন ধরে রাস্তা পার হতে দেখা যায়। কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছিলেন এমন একজন তালুকদার হোসেন। তিনি ফার্মগেটের ফার্মভিউ মার্কেটে ব্যবসা করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ কল ছিল। বিষয়টি খেয়াল ছিল না। অসচেতনতার কারণে এমন হয়েছে। ভবিষ্যতে আর হবে না।’ মহাখালী রেলক্রসিংয়ের এপার থেকে ওপারে যাচ্ছিলেন তিতুমীর কলেজের ছাত্র সুমন মাহমুদ। তিনিও মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। বিষয়টি দৃষ্টিতে আনলে তিনি বলেন, ‘সাধারণত এমন হয় না। বেখেয়ালে হয়েছে।’ বৃহস্পতিবার শাহবাগেও দেখা গেছে একই চিত্র। নারী-পুরুষের একটি অংশ রাস্তা পার হওয়ার সময় মুঠোফোনে কথা বলছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সচেতন থাকার চেষ্টা করি। হটাৎ গুরুত্বপূর্ণ কল চলে আসায় ধরতে হয়েছে।’ রাতজেগে কথা বলা ॥ সদ্য প্রেমে পড়া কিশোর-কিশোরীও রাতজেগে মেতে ওঠে মুঠোফোনের আলাপনে। মুঠোফোন ব্যবহার করে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাতভর কথা বলে প্রেমিক-প্রেমিকার সঙ্গে। ফলে এতে তারা সকালের গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসও মিস করে। এরই পরিণতিতে পরীক্ষায় আসে নেতিবাচক ফল। কোন কোন ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে তাদের দিতে হয় সেমিস্টার ড্রপ। আবার মুঠোফোন ব্যবহাকারীদের বড় অংশটি এখন ফেসবুকের আসক্তিতে। ফুটপাথ ধরে হাঁটার সময় তাদের চোখ থাকে এ্যানড্রয়েডের স্ক্রিনে। চলতে থাকে আঙ্গুল। আর এভাবে হাঁটতে গিয়ে চলতি পথে তারা প্রায়ই হোঁচট খেয়ে বসে। আবার কোন ক্ষেত্রে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েও বসে। মুঠোফোনের অপব্যবহার সম্পর্কে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তরুণ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘দিনের বেলায় ঘুমানো, ক্লাস মিস করা, রেজাল্ট খারাপ, সেমিস্টার ড্রপ- এর বেশিরভাগই হয় নতুন প্রেমের ক্ষেত্রে। সারারাত জেগে মুঠোফোনে কথা বলার প্রভাবেই এমনটা হয়ে থাকে।’ জামাল পায়েল নামের এক যুবক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মুঠোফোনে মাত্রাতিরিক্ত কথা বলায় প্রচ- মাথাব্যথা হয়। এর প্রভাবে অল্পতেই মেজাজ খারাপ হয়।’ অন্যদিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনালাপে মেতে থাকায় দেশ অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একমাত্র টেলিটক বাদে বাকি সব মোবাইল অপারেটর বিদেশী। মুঠোফোন ব্যবহারে কোম্পানিগুলোর যে আয় হচ্ছে তার সবটাই বিদেশে চলে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি সূত্রে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। সামগ্রিক দিক বিবেচনায় তরুণ প্রজন্মকে মুঠোফোন ব্যবহারে আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন সমাজ সচেতন ব্যক্তিবর্গ।
×