ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু তহবিলের ১ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড ফেরত গেছে ব্রিটেনে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১২ নভেম্বর ২০১৬

জলবায়ু তহবিলের ১ কোটি ৩০  লাখ পাউন্ড ফেরত গেছে ব্রিটেনে

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশে আসা ১ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড গত এক বছরে যুক্তরাজ্যে ফেরত গেছে। উক্ত খাতে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কীভাবে বিতরণ এবং ব্যয় করা হবে তার পদ্ধতি নিয়ে টানাপড়েনের জের হিসেবে এ ঘটনা ঘটে। টানাপড়েনের কারণে ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স ফান্ড’ ২০১৭ সালের জুনে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দাতারা। এজন্য যুক্তরাজ্য সরকারকে দায়ী করে দুজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, সরাসরি না দিয়ে ওই অর্থ বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশকে দেয়াটা ছিল ব্রিটেনের ভুল সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি, তা অনুধাবন করতে ব্রিটিশ সরকার ব্যর্থ হয়েছে। প্যারিস চুক্তির পর মরক্কোতে প্রথম জলবায়ু সম্মেলন সামনে রেখে এ খবর জানা গেল। খবর দ্য গার্ডিয়ানের। বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে জলবায়ু খাতে তিন বছরে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা নেয়া হবে কি না সে সিদ্ধান্ত সরকার জানায়নি। বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রীরাও বলে আসছেন, জলবায়ু ইস্যুতে ঋণ নয়, বাংলাদেশের সহায়তা প্রাপ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু তহবিলে অর্থায়নের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ড দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় যুক্তরাজ্য। কিন্তু দেশটির আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ডিএফআইডি সিদ্ধান্ত নেয়, সহায়তার অর্থ সরাসরি বাংলাদেশ সরকারকে না দিয়ে ‘মাল্টি ডোনার বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স ফান্ডের’ অংশ হিসেবে বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে তা দেয়া হবে। বাংলাদেশ সরকার ডিএফআইডির ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। বিশ্ব ব্যাংক এর মধ্যে জড়ালে গাদা গাদা শর্ত দিয়ে অর্থ ছাড়ের বিষয়টি কঠিন করে তুলবে- এই আশঙ্কায় প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ওই তহবিল নিতে আপত্তির কথা জানালেও পরে রাজি হয়। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের ভিজিটিং ফেলো জোসেফ হ্যানলনকে উদ্ধৃত করে গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ গড়পরতার চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। কিন্তু ডিএফআইডি ও অন্য ঋণদাতারা বাংলাদেশীদের ‘ভিকটিম’ হিসেবে দেখিয়ে বলতে চাইছে, ‘তারাই বেশি বোঝে’। বাংলাদেশের ওপর আস্থা রাখতে যে তারা ব্যর্থ হয়েছে, ফেরত যাওয়া অর্থই তার প্রমাণ। “বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের সমস্যা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশীরা অনেক অভিজ্ঞ। বাংলাদেশের প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীরা জনবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যে পর্যায়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তা অসাধারণ। তারা জলাবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে ২০ বছর পিছিয়ে দিয়েছেন। জলবায়ু আলোচনায় তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্র, ডিএফআইডি আর অন্য দাতারা বলেই যাচ্ছে- ‘আমরা তোমাদের চেয়ে বেশি বুঝি’। প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা ‘বাংলাদেশ কনফ্রন্টস ক্লাইমেট চেঞ্জ’ নামের একটি বইয়ের সহলেখক জোসেফ হ্যানলন। বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী আর সাধারণ মানুষ ভূমির উচ্চতা বাড়িয়ে, ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর হার কমিয়ে এনে কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি সামাল দিচ্ছে- তার বিবরণ ওই বইয়ে তুলে ধরেছেন তিনি। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক সালিমুল হক গার্ডিয়ানকে বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে আলাদা তহবিল তৈরি করাটা ছিল দাতাদের ভুল সিদ্ধান্ত। কেন বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে ওই টাকার ব্যবস্থাপনা হবে- তার প্রতিবাদে ঢাকার রাস্তায় বিক্ষোভ হওয়ার কথাও বলেন তিনি। বাংলাদেশ সরকার যেখানে ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড’ নামে একটি নিজস্ব জলবায়ু তহবিল পরিচালনা করছে, সেখানে অর্থ না যুগিয়ে দাতাদের আলাদা তহবিল করার সিদ্ধান্তেরও সমালোচনা করেন সালিমুল হক। “এটা এ রকম, তারা যেন বলছে যে, ‘আমরা তোমাদের বিশ্বাস করি না এবং তোমাদের টাকাও দিচ্ছি না।’ শুরুতেই এটা একটা বাজে সঙ্কেত। “তাদের বলা উচিত ছিল- ‘আমি সরকারের ওপর ভরসা রেখে টাকা দিলাম, কিন্তু অবশ্যই এর পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন হবে’।” হক জানান, কোন কোন প্রকল্পে অর্থ যাবে তা নিয়েও সরকারের সঙ্গে দাতাদের মতের মিল হয়নি। গার্ডিয়ান আরও লিখেছে, গত বছর ডিএফআইডির বার্ষিক পর্যালোচনায় বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রকল্পের ‘চ্যালেঞ্জ ও টানাপড়েনের বিষয়গুলো’ তুলে ধরা হয়। এরপর বিশ্ব ব্যাংক ও অন্য দাতারা ২০১৭ সালের জুন থেকে রেজিলিয়েন্স ফান্ডের কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। ১২৫ মিলিয়ন পাউন্ড নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই ফান্ডের আকার এক সময় বাড়িয়ে ১৮৮ মিলিয়ন ডলার করা হয়। ডিএফআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ তহবিল কোন মডেলে চলবে তা নিয়ে বিশ্ব ব্যাংক ও অন্য দাতাদের বোঝাপড়ার অভাবের কারণেই অর্থ ছাড়ের ধীরগতি ও টানাপড়েন তৈরি হয়। বাংলাদেশ সরকারের ‘কমিটমেন্টের অভাবকেও’ অর্থ ছাড় বিলম্বিত হওয়ার জন্য দায়ী করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। সেই সঙ্গে বলা হয়েছে, ‘দুর্নীতির ঝুঁকি’ আর এক বছর আগের রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা। ডিএফআইডির একজন মুখপাত্র গার্ডিয়ানকে বলেন, ওই ফান্ড বন্ধ হয়ে গেলেও যুক্তরাজ্যের সহায়তায় কোন ঘাটতি হবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতিতেও ব্যত্যয় হবে না। ওই তহবিলের আওতায় ইতোমধ্েয যেসব প্রকল্প শুরু হয়েছে, নির্ধারিত তারিখ পর্যন্ত সেগুলো চলমান থাকবে। লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে গার্ডিয়নে বলা হয়েছে, বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলার পর বাংলাদেশ পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের অর্থায়ন ফিরিয়ে দেয়ায় টানাপড়েন তৈরি হয়েছিল। “তাছাড়া কিছু ইস্যুতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনড় ছিলেন। তার বক্তব্য ছিল, জলবায়ু তহবিলের অর্থের ক্ষেত্রে কোন ধরনের শর্ত চলবে না। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, এ বিষয়ে কেবল সহায়তা পাওয়ার জন্যই আমাদের চুক্তি করা উচিত।” বিশ্ব ব্যাংকও এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স ফান্ড বন্ধের সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। “যে অর্থ ফেরত গেছে তা ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে খরচ করা সম্ভব নয়। ওই অর্থ দাতাদের ফেরত দেয়া হয়েছে, কারণ তারা অন্য কাজে তা ব্যবহার করতে চায়। অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার কাজটি ইতোমধ্যে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।” বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স ফান্ডের ম্যানেজমেন্ট কমিটিতে সভাপতিত্ব করেছে বাংলাদেশ। যেসব সিদ্ধান্ত সেখানে হয়েছে তা দাতারা তা এককভাবে নেয়নি। বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত যে সব প্রকল্প নির্দিষ্ট কিছু মানদ- পূরণ করতে পেরেছে, কেবল সেগুলোই চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। যেসব প্রকল্প প্রস্তাব ম্যানেজমেন্ট কমিটির কাছে সুগঠিত মনে হয়নি, সেগুলো অনুমোদন পায়নি। “একটি পর্যালোচনার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দাতারা ও ব্যাংক এই ট্রাস্টিশিপ আর এগিয়ে না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে,” বলা হয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের বিবৃতিতে।
×