ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

একান্ত সাক্ষাতকারে অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর নাসরিন

সিলেবাসে যুদ্ধাপরাধ ও ’৭১-এর নারী নির্যাতন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১২ নভেম্বর ২০১৬

সিলেবাসে যুদ্ধাপরাধ ও ’৭১-এর নারী নির্যাতন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে

তৌহিদুর রহমান ॥ ভারতের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর নাসরিন জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ ঘটনাকে তারা বিশেষ বিবেচনায় নিয়েছেন। এছাড়া দুই বাংলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবন ও সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব সংখ্যাগুরু সমাজ ও রাষ্ট্রকেই নিতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে জনকণ্ঠকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা বলেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর নাসরিন একটি সেমিনারে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন স্টাডিজ প্রোগ্রামের আওতায় ‘বাংলায় উনিশ ও বিশ শতকের সংস্কৃতি ও জীবন’ শীর্ষক কোর্স রয়েছে। এই বাংলা অবিভক্ত বাংলা। ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হয়। তবে আমরা দুই বাংলারই জীবন সংস্কৃতি পড়াচ্ছি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ ও নারী নির্যাতনও পড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই পাঠ্যসূচীতে এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করার এই উদ্যোগ নেয়ার পেছনে কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০১১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পূর্তিতে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে ঢাকা থেকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, সাংবাদিক-গবেষক শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস গিয়েছিলেন। তারপর থেকেই এ বিষয়ে আমরা উদ্যোগে নিয়েছিলাম। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন পাঠ্যসূচী আমরা ইতোমধ্যেই রিভাইসড করছি। সেখানে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি এসেছে। মুক্তিযুদ্ধে নারীদের বিষয়টি এসেছে। সেখানে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নারী নির্যাতনই মূল ফোকাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কেননা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমাদের সিলেবাসে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের নারীদের বঙ্গবন্ধু যখন বীরাঙ্গনা বললেন, সেই শব্দের ব্যঞ্জনা ছিল খুব গভীর। তারা বিচার পাননি। গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে নারী-পুরুষ উভয়েই নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবে নির্যাতনের সময় নারীরা একটি পৃথক উপাদান হয়ে উঠেন, শুধুমাত্র তার শরীরের কারণে। তাই শত্রুপক্ষ নারীকে সে সময় একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কিভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেনস স্টাডিস প্রোগ্রামের সমন্বয়ক সৈয়দ তানভীর নাসরিন বলেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিচার খুবই আশাপ্রদ ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধের নির্যাতনের শিকার অনেক নারীই মারা গেছেন। অনেকেই হয়তো নির্যাতনের কথা প্রকাশ করেননি। তাদের ওপর যে অন্যায় হয়েছিল যুদ্ধাপরাধ বিচারের মধ্যে দিয়ে কিছুটা হলেও প্রতিকার পাবে। এই বিচারের প্রক্রিয়াকে আমি সমর্থন করি। কেননা এই বিচার ন্যয়কেই প্রতিষ্ঠা করবে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নারীরা একই ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হয় কি-না এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি দুই বাংলার মুসলিম নারীদের নিয়ে গবেষণা করেছি। বাংলাদেশে মুসলিম নারীরা সংখ্যাগুরু। আর পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম নারীরা সংখ্যালঘু। দুই বাংলার নারীদের সাধারণ বিষয়গুলো বাদ দিলেও অবস্থানগত কারণে ধর্মীয় সমাজ, পিতৃতান্ত্রিক প্রভাব ও রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। এক প্রশ্নের উত্তরে সৈয়দ তানভীর নাসরিন বলেন, ভারতের কেন্দ্রে যে সরকারই আসুক না কেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকবে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। কেননা দুই দেশের মধ্যেই একটি ঐতিহাসিক ধারা রয়েছে। কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরেও আমাদের মধ্যে আত্মিক যোগাযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষ কলকাতায় গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আবার ওপার বাংলা থেকে এখানে কেউ এসেও কোনভাবেই অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এটা হয়েছে ভাষা ও সংস্কৃতির কারণে। ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার মান কেমন জানতে চাইলে তানভীর নাসরিন বলেন, ঢাকা, জগন্নাথ ও জাহাঙ্গীরনগরের যথেষ্ট গবেষণা হয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক থিসিস খুবই উচ্চমানের। তবে একটি কথা বলতে চাই, বাংলার পাশাপাশি পিএইচডি থিসিস ইংরেজীতে হলে, আরও ভাল হবে। বিশ্বজনীন হতে পারবে। Ÿ্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ফেসবুক ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে লেখক ও গবেষক তানভীর নাসরিন বলেন, ফেসবুক বা সোস্যাল মিডিয়া যারা ব্যবহার করেন, এটা ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে তার জন্যও একটি শিক্ষার বিষয় হয়ে উঠে। অনেকেরই সে বিষয়ে শিক্ষা নেই। আবার ফেসবুকে ফটোশপ ব্যবহার করে মানুষকে বিপদে ফেলা, আপত্তিকর ছবি প্রকাশ করা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা। সেটাও কখনই কাম্য নয়। সেটাও শিক্ষার বিষয়। তিনি আরও বলেন, আবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে বিষয়টির কথা এখন উঠছে। যেকোন মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে হয়। যারা এদেশে সংখ্যালঘু বা যারা ওদেশে সংখ্যালঘু তাদের জীবন, তাদের সম্পদ, তাদের সম্মানও রক্ষা করা সংখ্যাগুরু সমাজের-রাষ্ট্রের ওপর প্রবলভাবে এসে পড়ে। এখানে যদি বাহ্মণবাড়িয়া বা নাসিরনগরে ঘটনা ঘটে। এখানে যদি ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান হয়। মনে রাখতে হবে সাম্প্রদায়িকতাও একটি বহতা নদী। এখানে যদি সম্প্রদায়িকতার ঢেউ বেশি হয়। প্লাবন বেশি হয়। তার সেই ঢেউ পশ্চিমবঙ্গেও আছড়ে পড়তে পারে। পশ্চিমবঙ্গের উভয় মৌলবাদই- সংখ্যাগুরুর মৌলবাদ, সংখ্যালঘুর মৌলবাদই আস্কারা পেতে পারে। আসলে মৌলবাদ কখনও একটি জায়গার মধ্যে আটকে থাকে না। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তিস্তার পানি সমস্যাটা আমি দেখেছি। আমি রাজশাহীতে গিয়েছি। এটা মোটেও কোন ছোটখাটো সমস্যা নয়। পানি সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে হবে। আমি আশাবাদী এই সমস্যার সমাধানও হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রত্যাশা আগামীতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে। দুই দেশের মানুষে মানুষে সম্পর্ক গভীর হবে। আমি এক আশাবাদী সকালের দিকে তাকিয়ে আছি, যেন দুই দেশেরই অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ হয়। কেননা হিন্দু ও মুসলমান মৌলবাদ দুটোই আমাদের কাছে সমান শত্রু।
×