ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদ

শাহবাগে বিক্ষোভ অবরোধ তীব্র যানজট

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১২ নভেম্বর ২০১৬

শাহবাগে বিক্ষোভ অবরোধ তীব্র যানজট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রাজধানী ঢাকার শাহবাগে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যা সাতটার দিকে বিক্ষোভকারীরা রাস্তা থেকে অবরোধ তুলে নেন। বিক্ষোভকারীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হকের অপসারণসহ ছয় দফা দাবি জানায়। এছাড়া বিক্ষোভকারীরা মন্ত্রীর কুশপুতুল পুড়িয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষোভের কারণে শাহবাগসহ আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভকারীরা আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষোভকারীরা নাসিরনগরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর ও মন্দির এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণসহ আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানান। যদিও ইতোপূর্বে ২০১৩ সালে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক হামলায় দেশের বিভিন্ন জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের শত শত বাড়িঘর, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে দিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সেসব বাড়িঘর, মন্দির এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে দেয়। পাশাপাশি সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তাও দেয়া হয়। পুরো এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করতে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। রাস্তা থেকে অবরোধ তুলে নিতে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় অনুরোধ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের আলাপ আলোচনা চলছে। সন্ধ্যা সাতটার দিকে বিক্ষোভের অংশ হিসেবে মোমবাতি জ্বালানোর পর পরই বিক্ষোভকারীরা অবরোধ তুলে নেন বলে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার জানান। বিক্ষোভ সাময়িকভাবে না স্থায়ীভাবে তুলে নিয়েছেন তা স্পষ্ট করেননি বিক্ষোভকারী ও তাদের নেতৃবৃন্দ। শুক্রবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা মিছিলটি বের করেন। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ও দোয়েল চত্বর হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব ঘুরে মিছিলকারীরা শাহবাগে অবস্থান নেন। তখন দুপুর বারোটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সচেতন হিন্দু শিক্ষার্থীবৃন্দ, সাধারণ হিন্দু শিক্ষার্থীবৃন্দ, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, রমনা কালীমন্দির ও আনন্দময়ী আশ্রম পরিচালনা পরিষদ’সহ কয়েকটি সংগঠনের ব্যানারে অন্তত পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী শাহবাগে জড়ো হয়। তারা দুপুর বারোটা নাগাদ শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। রাস্তা অবরোধের পাশাপাশি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে পরবর্তীতে নানা শ্রেণী পেশার মানুষ যোগদান করে। নানা শ্রেণী পেশার মানুষ বিক্ষোভ কর্মসূচীতেও অংশ নেয়। বিক্ষোভে সড়ক বন্ধ থাকায় শাহবাগ হয়ে কোন দিকেই যানবাহন চলাচল করতে পারেনি সন্ধ্যা পর্যন্ত। আশপাশের সব সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভকারীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হকের অপসারণ দাবি করেন। তাঁর কুশপুতুল পুড়িয়ে বিক্ষোভ দেখান। শিক্ষার্থীরা ‘হিন্দু হয়ে জন্মানোই কি আমাদের অপরাধ?, দেশত্যাগই কি আমাদের একমাত্র পথ?, হিন্দু জাতির অপমান মানি না, মানব না, নাসিরনগরে হামলা কেন জবাব চাই’ লেখা প্লেকার্ড প্রর্দশন করে। পরবর্তীতে সময় যত গড়াতে থাকে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে সকাল থেকে জাতীয় জাদুঘরের সামনে কর্মসূচীতে থাকা কয়েকটি সংগঠনও শাহবাগে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক প্রিয়াংকা বোস কান্তা সমাবেশে বলেন, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ বলা হলেও, এই অবরোধ তা প্রমাণ করে না। এ ব্যাপারে সরকারের জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান তিনি। মানিক রক্ষিত নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সনাতন ধর্মের মানুষদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছিলেন আজও তা হয়নি। এখনও সনাতন ধর্মের মানুষের উপর নির্যাতন চলছে, এটা দুঃখজনক। হামলাকারীদের বিচার না হওয়ায় মৌলবাদী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ফের হামলা করার সাহস পাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন এই শিক্ষার্থী। বিক্ষোভ-সমাবেশ থেকে নাসিরনগরে হামলার ঘটনায় মন্ত্রী ছায়েদুল হকের অপসারণ ও তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ ছয় দফা দাবি জানানো হয়। দাবি গুলো হচ্ছে, নাসিরনগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলায় শিকার সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ও ধর্মীয় উপাসনালয় আবার নির্মাণের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান, ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান, হামলার উস্কানিদাতা, মদদদাতা এবং হামলাকারীদের বিচারের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করা। নাসিরনগরে হামলার ঘটনার পর থেকে ছয়টি হিন্দু পরিবারের খোঁজ মিলছে না দাবি করে এই শিক্ষার্থী বলেন, বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়ে দেশান্তরী হয়েছে এমন পরিবারগুলোকে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। একটি সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীন সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করতে হবে। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে ক্ষমতাসীন সরকারের আমলেই বিএনপি-জামায়াত-শিবির-জঙ্গী ও স্বাধীনতাবিরোধীরা জোটবদ্ধ হয়ে সারাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের ক্ষতিগ্রস্তদের একটি তালিকা করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বিজিবিকে ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এদিকে শাহবাগ মোড় দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় ছুটির দিনেও প্রেসক্লাব থেকে মৎস্য ভবন হয়ে রূপসী বাংলার মোড়, কাঁটাবন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতরে যানজট সৃষ্টি হয়। অনেক বাস নির্ধারিত রুটে যেতে না পারায় রূপসী বাংলা মোড়, কাকরাইল মসজিদ, কাঁটাবন, নীলক্ষেত মোড় হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে চলাচল করতে বাধ্য হয়। ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার জনকণ্ঠকে বলেন, ইস্যুটি খুবই স্পর্শকাতর। তাই এ ইস্যুতে বিক্ষোভকারীদের বিষয়ে খুবই সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা যেসব সংগঠনের ব্যানারে বিক্ষোভ করছেন, সেসব সংগঠনের প্রধানদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। এজন্য চারদিকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতেই সেখানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা রাস্তার মোড়ে বসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করায় চারদিকের সব রাস্তা বন্ধ রয়েছে। এতে করে পাশেই থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী ও তাদের কাছে যাতায়াতকারীদের জরুরী কাজকর্ম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যা খুবই অমানবিক। বিক্ষোভকারীদের কাছে এমন অমানবিক বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। বিক্ষোভের অংশ হিসেবে মোমবাতি জ্বালানোর পর পরই কর্মসূচী শেষ করে সবাই চলে যান। এরপরই যানযাহন চলাচলসহ ওই এলাকার সার্বিক কর্মকা- স্বাভাবিক হয়ে আসে।
×