ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৌশল শাখার অসহযোগিতা

আমনুরা বাইপাস রেলপথ নির্মাণে ধীরগতি

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ১২ নভেম্বর ২০১৬

আমনুরা বাইপাস রেলপথ নির্মাণে ধীরগতি

ডি. এম. তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ রাজধানী ঢাকা মহানগরকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ নগরীর সঙ্গে সরাসরি রেলপথে সংযোগের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নিলেও পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রকৌশল শাখা অসহযোগিতা করায় তা এখন ভেস্তে যাবার পথে। এটি এই অঞ্চলে প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুত প্রকল্প। কিন্তু সড়ক পরিবহন সমিতি চাচ্ছে না প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হোক। তাই যত ধরনের বাগড়া দেবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রেল প্রকৌশলকে পকেটে পুরে। তারা প্রথমেই হাত করার চেষ্টা করেছে উত্তরাঞ্চল রেলের প্রকৌশল বিভাগকে। এ জন্য অঘোষিত কোটি টাকার বাজেট নিয়ে তারা মাঠে রয়েছে। কারণ চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী কোচের সংখ্যা রাত-দিন মিলিয়ে অর্ধ শতাধিক। তাদের ধারণা সরাসরি রেলপথ চালু হলে সড়ক পরিবহনের বাস সার্ভিস ব্যাহত হবে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কেন্দ্রীয় ট্রাক সমিতি। কারণ আম ও টমেটো মৌসুমে প্রতিদিন রাজধানী ও চট্টলামুখী শতাধিক ট্রাক আম ও টমেটো নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়ে। ট্রাক সমিতির ধারণা সরাসরি রেল যোগাযোগ চালু হলে তাদের ব্যবসা মাঠে মারা যাবে। কারণ প্রতিটি ঢাকাগামী ট্রেনের সঙ্গে একাধিক আমের ও টমেটোর বগি থাকলে দ্রুত আম ও টমেটো পৌঁছে যাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। পাশাপাশি রেল বিভাগ শুধু আম ও টমেটো পরিবহনে বিশেষ মালগাড়ি দিনে (এক থেকে দুইবার চালু) হলে আম ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নেবে পরিবহন ট্রাক থেকে। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে পরিবহন খরচ চার ভাগের এক ভাগে নেমে আসবে। পাশাপাশি বরেন্দ্রর টমেটোও ট্রাকের বদলে ট্রেনে যাবে। তাই ট্রাক সমিতি ঢাকা কোচ মালিক সমিতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কয়েক কোটি টাকার বাজেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত আমনুরা জংশনে নির্মাণাধীন বাইপাস রেলপথ ভ-ুল করতে চাচ্ছে। যার কারণে আমনুরা জংশনের নির্মাণাধীন বাইপাস রেলপথ নির্মাণে কোন গতি নেই। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে রেলপথের মাধ্যমে সংযোগের জন্য আমনুরা জংশনের কাছে বাইপাস রেলপথ নির্মাণের নির্দেশ দেন রেলের প্রকৌশল বিভাগকে। এর জন্য প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিক ২৩ কোটি টাকার বরাদ্দ দিয়ে ছয় মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন। কাজটি তদারকিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের এমপি আব্দুল ওদুদকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে দ্রুত কাজ বুঝে নেয়ার মৌখিক ক্ষমতা দেন। আমনুরা বাইপাস রেলপথ নির্মাণে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান প্রকৌশলী তড়িঘড়ি একদল প্রতিনিধি নিয়ে ছুটে আসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে। দুই বছর আগের কথা। ঘোষণা করেন শীঘ্রই টেন্ডার করার কথা। শীঘ্রই কাজ শেষ করে আন্তঃনগর ট্রেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ছেড়ে ঢাকা পৌঁছতে পারে। এরপর থেকে প্রকল্পটি বানচালে মাঠে নামে কোমর বেঁধে ঢাকা কোচ ও ট্রাক সমিতি যৌথভাবে। যার কারণে রেল বিভাগ টেন্ডার যথাসময়ে না করে দীর্ঘসূত্রতার পথ ধরে। শেষ পর্যন্ত দেরিতে হলে টেন্ডার শেষে ওয়ার্ক ওয়ার্ডার দিলেও কাজ শেষ হচ্ছে না। রেলের বাইপাস নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ প্রকৌশল বিভাগ তাদের সহযোগিতা করছে না। অথচ রেল প্রকৌশল তড়িঘড়ি ২৩ কোটি টাকা উঠিয়ে নিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। সরকারকে বোঝাবার চেষ্টা করছে তারা দ্রুত কাজ শেষ করার মানসেই বরাদ্দ টাকা উঠিয়ে নিয়েছে। অনেকের অভিযোগ উঠিয়ে নেয়া টাকার সুদ ব্যাংক থেকে উঠিয়ে কে বা কারা নিজেদের পকেটে পুরছে। এক কথায় প্রকল্পটি ঘোষণার দিন থেকেই রেলের প্রকৌশল শাখা আর্থিক লাভবান হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের জনসাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণে আমনুরা জংশনের বাইপাস রেলপথ নির্মাণে তেমন কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। সরেজমিনে প্রথমেই নজরে আসে বাইপাস নির্মাণে কোন গতি নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আমনুরা জংশনে প্রবেশের অনেক আগেই সিগন্যালের কাছাকাছি ভাবুক ও চুনিয়াকান্দর মৌজার কাছে বাইপাসটির কাজ শুরু করা হয়েছে। এটি ২.৭ কিলো অতিক্রম করে রাজশাহীগামী রেলপথের সঙ্গে গিয়ে মিলবে। এর মধ্যে পৌনে দুই কিলো মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে সাববেশের (বালু ও খোয়া মিশ্রণ) কাজ। তবে পাথর খোয়া ব্যবহার না করে খুবই নিম্নমানের ইটের খোয়া ব্যবহারের জন্য জমা করে রাখা হয়েছে। এ ধরনের নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় রেল চলাচলের সময় দেবে যেতে পারে। আবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ-আমনুরা রেলপথের চুনিয়া কান্দর সংযোগের কাছে একটি কালভার্ট নির্মাণ এখনও হয়নি। কাজ শুরুর কোন প্রস্তুতি নেই। আবার বাইপাস রেলপথ নির্মাণের জন্য রাজশাহীগামী রেলপথের সঙ্গে সংযোগের প্রায় এক কিলোর কাজ এখনও শুরুই হয়নি। আমনুরা-গোদাগাড়ী পাকা সড়কটি অতিক্রম করে রাজশাহীগামী রেলপথে সংযোগ হবে। কিন্তু কাজে একেবারে গতি নেই। ঠিকাদারের কর্মচারী সফিকুল ইসলাম জানান, তারা দ্রুত কাজ সারার চেষ্টা করছেন। তিনি জানান, সদর আসনের এমপি আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস চাচ্ছেন আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার। তিনি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে এসে থাকেন। কিন্তু কাজে গতি না থাকায় তার বেঁধে দেয়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে কিনা, তা কেউ বলতে পারে না। প্রকল্পের কাজ দেখাশোনার জন্য মশিহুর রহমান নামের রেল প্রকৌশলী দায়িত্বে থাকলেও তিনি সপ্তাহে একদিনও না আসার অভিযোগ রয়েছে। তাই বলা চলে প্রকল্প এলাকা খুবই অরক্ষিত, প্রকৌশলবিহীন কাজ চলছে। যদিও প্রকল্পের ঠিকাদার কর্মচারী বলার চেষ্টা করছেন ৮০% ভাগ কাজ শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু সরজমিনে দেখা যাচ্ছে সম্পন্ন কাজের পরিমাণ ৫০% পার হয়নি। যার কারণে বাইপাস রেলপথ নির্মাণের কাজ ২০১৮ সালে গিয়ে ঠেকলেও বলার কিছু নেই। তবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দাবি তারা ২০১৭ সালের জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করতে বদ্ধপরিকর। আর এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হলে তা কতটা বা কি পরিমাণ টেকসই হবে তা নিরূপণের উপায় নেই। তবে পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রকৌশল শাখার কোন কর্মকর্তা এই মুহূর্তে কোন মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এদিকে দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে তাগিদ না থাকায় প্রকৌশল শাখা কাজ নিয়ে ছিনিমিনি শুরু করেছে। প্রকল্প এলাকায় সংশ্লিষ্ট বিভাগ ঠিকাদারকে জরুরীভিত্তিতে টাকা না দেবার বা রিলিজ না করায় জনবল বৃদ্ধি করছে না। আর জনবল বৃদ্ধি না করলে কাজে গতি আসবে না। প্রকল্পটিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত জরুরী প্রকল্প এটা উত্তরাঞ্চল প্রকৌশল বিভাগ আমলে না নিয়ে তারা ঢাকা কোচ ও ট্রাক সমিতির ইশারায় কাজে গতি আনার চেষ্টা করছে না। অথচও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের মানুষের ঢাকা ভ্রমণে দুর্ভোগ লাঘবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল অবিলম্বে আন্তঃনগর ট্রেন চালু করার।
×