ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তোফায়েল আহমেদ

’৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ও নির্বাচনের স্মৃতিকথা ‘আর্তের সেবায় আওয়ামী লীগ’

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১২ নভেম্বর ২০১৬

’৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ও নির্বাচনের স্মৃতিকথা  ‘আর্তের সেবায় আওয়ামী লীগ’

১৯৭০-এর ১২ নবেম্বর আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে ১০ লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করেছিল। অনেক পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। বহু পরিবার তাদের আত্মীয়-স্বজন, বাবা-মা, ভাই-বোন হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল। প্রতিবছর যখন ১২ নবেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে ফিরে আসে তখন বেদনাবিধুর সেই দিনটির কথা স্মৃতির পাতায় গভীরভাবে ভেসে ওঠে। সেদিন আমি ছিলাম জন্মস্থান ভোলায়। বঙ্গবন্ধু আমাকে আসন্ন নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। নির্বাচনের ক্যাম্পেনে ব্যস্ত ছিলাম এলাকায়। কয়েকদিন ধরেই গুমোট আবহাওয়া ছিল। বৃষ্টি এবং সেই সাথে ছিল ঝড়ো বাতাস। এরকম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শামসুদ্দীন আহমেদ মিয়া, মাওলানা মমতাজুল করিম, মোস্তাফিজুর রহমান মিয়াসহ অন্য নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আমার নির্বাচনী এলাকাসহ ভোলায় ব্যাপক গণসংযোগ করি। আমার নির্বাচনী এলাকা ছিল ভোলা থানা, দৌলত খাঁ থানা, তজিমুদ্দী থানা। তখন মনপুরা থানা হয়নি। কিন্তু মনপুরার তিনটি ইউনিয়নও আমার নির্বাচনী এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর একটি এলাকা ছিল বোরাহানউদ্দিন, লালমোহন এবং চরফ্যাশন। আমার নির্বাচনী এলাকাটি বড় ছিল। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু যখন আমাকে প্রস্তুতির নির্দেশ দেন তখন আমার বয়স মাত্র ২৬। ’৬৯-এর উত্তাল গণআন্দোলনে যে গণবিস্ফোরণ ঘটে তাতে ২৫ মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতাসীন হন। এ সময় মার্শাল ল’র মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ছিল। পরে সামরিক কর্তৃপক্ষ জুন মাস থেকে ঘরোয়া রাজনীতি দেয়। ’৭০-এর ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগে যোগদান করি। ’৭০-এ জানুয়ারির ১ তারিখ রাজনৈতিক তৎপরতার উপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহৃত হয়। তখন আমি ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ডাকসু’র ভিপি। ছাত্রলীগের উদ্যোগে আমার নেতৃত্বে সেদিন প্রথম জনসভা করি পল্টনে। তখনই বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই ভোলা যাবি। সকল এরিয়া সফর করবি। আমি তোকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিবো।’ এই কথাটা ভীষণভাবে আমার হৃদয়কে আলোড়িত করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো ভোলা সফরে যাই এবং ভোলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে-তখন ভোলায় রাস্তা-ঘাট, পুল-কালভার্ট কিছুই ছিল না, ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাই। বঙ্গবন্ধু ১৭০০ টাকা দিয়ে একটা মোটরবাইক আমাকে কিনে দিয়েছিলেন। এই মোটরবাইক ছিল আমার যানবাহন। ভোলার মনপুরার সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন মহান ব্যক্তি বসরতউল্লাহ চৌধুরী-আমরা যাকে শাহজাদা ভাই বলে শ্রদ্ধা জানাতাম-তার একটি জীপ ছিল। এই জীপটি তিনি ’৭০-এর নির্বাচনে আমার নির্বাচনী কাজে ব্যবহারের জন্য দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ভোলায় তার বাড়িটি আমার নির্বাচনী কর্মকা- পরিচালনার জন্য দিয়েছিলেন। তখন ভোলায় আমার কোন বাসা-বাড়ি ছিল না। আমি শ্বশুরবাড়িতে থেকে রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনা করেছি। বসরতউল্লাহ চৌধুরী অর্থাৎ শাহজাদা ভাইর বাসায় আমার নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন করি। শাহজাদা ভাইর কথা আমার ভীষণভাবে মনে পড়ে। তিনি ছিলেন উদার হৃদয়ের এক চমৎকার মানুষ। তার কৃতী সন্তান আজ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজিমউদ্দীন চৌধুরী। আমি যখন নাজিমউদ্দীন চৌধুরীকে দেখি তখন আমার শাহজাদা ভাইয়ের কথা ভীষণভাবে মনে পড়ে। এপ্রিল মাসে ভোলার ৭টি উপজেলায় নির্বাচনী সভা করি। কখনো পায়ে হেঁটে কখনো বা মোটরবাইক চালিয়ে বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়েছে। কারণ, রাস্তা নাই জীপ চলে না। যেখানে জিপ চলে সেখানে জীপের মধ্যে-শামসুদ্দীন চাচা, মাওলানা মমতাজুল করিম, মোস্তাফিজ মাস্টার, রিয়াজুদ্দীন মোক্তার-চারজন প্রবীণ নেতাকে নিয়ে সবজায়গায় যেতাম। কারণ আমি ছিলাম ছোট। বয়স খুব কম। বয়স্ক নেতাদের নিয়ে গেলে মানুষ সন্তুষ্ট হতো। যেখানে যেতাম মানুষ আমাকে দেখতে চাইতো। কারণ, আমার এই সময়টা ছিল ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে। যে গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আমি মানুষের কাছে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলাম। পত্র-পত্রিকায় বিভিন্নভাবে আমার সেই সংগ্রামী দিনগুলোর কথা প্রচারিত হয়েছিল। ভোলার যেখানেই গিয়েছি হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে। তাদের সামনে বক্তৃতা করেছি। এভাবে যখন ১৭ এপ্রিল ৭টি জনসভা শেষে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বাবাকে জানালাম যে, বাবা বঙ্গবন্ধু আমাকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এমএনএ পদে মনোনয়ন দিতে চেয়েছেন। তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘তুই এতো অল্প বয়সে এমএনএ হবি। তোর বয়স মাত্র ২৬। আর আমার পরিবারের কেউ কোনদিন রাজনীতি করেনি। এমনকি ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বারও কেউ হয়নি। তুই একসাথে এমএনএ হয়ে যাবি।’ আমি বাবার দোয়া নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম। তারপর বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৫ এপ্রিল আমার জনসভা ছিল চট্টগ্রামের মীরসরাই। যেখান থেকে এখন আমাদের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি তখন ’৭০-এ এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য) পদপ্রার্থী এবং আমাদের ফজলুল হক বিএসসি সাহেব এমএনএ (জাতীয় পরিষদ সদস্য) পদপ্রার্থী। মীরসরাইর জনসভায় আমাদের প্রিয় নেতা চট্টগ্রামের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি এমএ আজিজসহ যখন সভা করছি, তখন বঙ্গবন্ধু খবর পাঠিয়েছেন অনতিবিলম্বে আমি যেন ভোলা চলে যাই। বিশাল সেই জনসভায় লক্ষ লক্ষ লোক জমায়েত হয়েছিল। বক্তৃতা শেষ করে প্রয়াত নেতা আক্তারুজ্জামান বাবু সাহেবের ভাইয়ের-যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন-লালরঙের গাড়িতে করে চাঁদপুর পর্যন্ত পৌঁছাই এবং ২৬ তারিখ সকালবেলা গ্রামের বাড়ি পৌঁছি। ততক্ষণে বাবার দাফন হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু বাবা মৃত্যুবরণ করেছেন এটা জানাননি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, বাবা আর নাই। বাবার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ১৭ এপ্রিল। প্রতিমাসে ভোলায় যাই। রাজনৈতিক গণসংযোগ ও নির্বাচনী জনসভা করি। ডিসেম্বরের ৭ তারিখ নির্বাচন যখন ঘনায়মান ঠিক তার ২৫ দিন আগে ১২ নবেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ল-ভ- হলো দেশের উপকূলীয় অঞ্চল। আমি তখন ব্যাপকভাবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় লিপ্ত। ১২ নবেম্বরের তিন-চার দিন আগ থেকেই বিভিন্ন জায়গায় বিরাট বিরাট জনসভা করেছি। ১০ তারিখ আমার জনসভা ছিল তজুমুদ্দী। তখন তজুমুদ্দী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন টুনু চৌধুরী। জনসভা শেষ করে টুনু চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে রাতের খাবার খেয়ে ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা-পরে তজুমুদ্দীর উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছিলেন-মোশারফ হোসেন দুলালের বাড়িতে রাত কাটাই এবং ১১ তারিখ লালমোহনে মঙ্গল শিকদারে জনসভা করতে যাই। সেখানে বিশাল জনসভায় যখন বক্তৃতা করছি তখন শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি এবং প্রচ- ঝড়। এর মধ্যেই জনসভা শেষে প্রবীণ নেতৃবৃন্দসহ জীপে করে ভোলায় ফিরে আসি। ১২ তারিখ আমার জনসভা ছিল তজুমুদ্দীর দাসের হাট। আমি যখন শাহজাদা ভাইয়ের জীপে করে দৌলত খাঁ হয়ে (তখন দৌলত খাঁ হয়ে তজুমুদ্দী যাওয়া যেত) রওয়ানা করেছি তখন দৌলত খাঁ যাওয়ার পথে প্রচ- ঝড় শুরু হয়। সকলেই আমাকে নিষেধ করলো, আপনি এই জনসভায় যাবেন না। কিন্তু আমি তো রিকশা করে মাইক পাঠিয়েছি। আমার লোক চলে গেছে দাসের হাটে। আমার মা সংবাদ পেয়ে (শ্রদ্ধেয়া মা যিনি আমার জীবনের প্রেরণার উৎস) নিষেধ করলেন আমি যেন জনসভা বাতিল করি। বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম। ফিরে রাতে শ্বশুরালয়ে অবস্থান করছি। মধ্যরাতে শুরু হয় তুমুল ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস। আমি ছিলাম ভোলা-১ আসনে এমএনএ পদপ্রার্থী। আরেক আসনে এমএনএ প্রার্থী ছিলেন জনাব আজহারউদ্দীন আহমেদ। যিনি অবসরপ্রাপ্ত মেজরÑ বিএনপি নেতা হাফিজউদ্দীন আহমেদের শ্রদ্ধাভাজন পিতা। আর আমার নির্বাচনী এলাকায় এমপিএ প্রার্থী ছিলেন ভোলার মোশারফ হোসেন শাহজাহান। যিনি ’৭৫-এর পরে বিএনপিতে যোগদান করে এমপি এবং প্রতিমন্ত্রী হন। ক’বছর আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ভোলা সদর থানার এমপিএ পদপ্রার্থী ছিলেন। আর দৌলত খাঁ, তজুমুদ্দী, মনপুরায় এমপিএ পদপ্রার্থী ছিলেন নজরুল ইসলাম মাস্টার। তিনিও আমার প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। সকাল বেলা আমি এবং মোশারফ হোসেন শাহজাহান নদীর পাড়ে গিয়ে অবাক ও বিস্মিত হলাম। শুধু কাতারে কাতারে মানুষের মৃতদেহ। অসংখ্য লোকের মৃতদেহ আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। আমরা দিশেহারা হয়ে গেলাম। এখনো স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে শিবপুর ইউনিয়নে রতনপুর বাজারের পুকুর পাড়ে শত শত লোককে দাফন করার দৃশ্য! এতো মৃতদেহ যে, দাফন করে আর কুলাতে পারছি না। যতদূর যাই শুধু মানুষের হাহাকার আর ক্রন্দন। এই শিবপুর ইউনিয়নে একটা বাড়ি যেখানে ৯০ জন লোক ছিল। কিন্তু বেঁচে ছিল মাত্র ৩ জন। সকলেই মৃত্যুবরণ করেছে। যখন তজুমুদ্দীর খবর পাই তখন শুনি যে, ৪০% লোকের মৃত্যু হয়েছে। যে দাসের হাটে জনসভা করার কথা ছিল সেখানে কিছুই নাই। আমার মাইক যে বহন করেছিল তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। দাসের হাটে বড় বড় ব্যবসায়ী ছিলেন তারা সকলেই সর্বস্বান্ত। চিত্তবাবু নামে এক বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তার গুদাম ঘরে চাল, ধান, সুপারি ছিল। তিনি একেবারে রিক্ত। আমি দাসের হাট, তজুমুদ্দী গিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ দেখে অবাক হলাম। ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলে ১০ লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তখন নির্বাচনী গণসংযোগে সাতক্ষীরায় অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে লোক মারফত ৫ হাজার টাকাসহ বার্তা পাঠালেন, আমি যেন সর্বত্র দুর্গত মানুষকে আশ্রয় দেয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করি এবং শুকনো খাবার বিশেষ করে চিড়া, মুড়ি ইত্যাদি মানুষের কাছে পৌঁছে দেই। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ত্রাণ কাজ করেছিলাম ’৭০-এর এই দিনগুলোতে। আমার শ্বশুরের গদিঘরে টেলিফোন ছিল। বঙ্গবন্ধু নাম্বার সংগ্রহ করে আমাকে টেলিফোনে নির্দেশ দিলেন, “তুই দুর্গত এলাকার প্রত্যেকটা জায়গায় ক্যাম্প কর এবং লিখে রাখ ‘আর্তের সেবায় আওয়ামী লীগ।’ অনেক মানুষ রিলিফ নিয়ে যাবে কিন্তু এই দুর্গত অবস্থায় তারা মানুষের কাছে রিলিফ পৌঁছাতে পারবে না। কিছুটা বিলি করে বাকিটা তোর কাছে দিয়ে আসবে। তুই সেগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিবি।” আসলে হয়েছেও তাই। আমি ১২ তারিখের পর মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পানি, শুকনো খাবার, কেরোসিন তেল পৌঁছে দিয়েছি। হাবিবুর রহমান তালুকদার নামে একজন পরম শ্রদ্ধাভাজন মানুষ ছিলেন। যাকে আমি ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতাম। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন এবং আমাকে তার ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তার একটি লঞ্চ ছিল। সেই লঞ্চে করে আমি নদীর পাড়ে পাড়ে মানুষের সেবা করেছি। আমি যখন রাস্তা দিয়ে যেতাম হাট-বাজার ভেঙে মানুষ ছুটে আসতো। সন্ধ্যাবেলায় এমন হতো যে, মানুষ আমার মুখের উপর হারিকেন ধরতো আমাকে একনজর দেখার জন্য। মানুষজন বলতো, ‘ছেলেটাকে একনজর দেখি’। ভোলার আঞ্চলিক ভাষায় বলতো, ‘ছ্যামরাকে দেখি। ছ্যামরাকে দেখলে ছওয়াব হবে। আমাদের জন্য ও এতো কাজ করে।’ মানুষ এভাবে মাথায় তুলে আমাকে তাদের হৃদয়ে ঠাঁই দিয়েছিল। ১৪ তারিখ বঙ্গবন্ধু ভোলায় ছুটে এলেন। ভোলায় বঙ্গবন্ধু আমার শ্বশুরালয়ে উঠলেন। সেখান থেকে হাবিবুর রহমান তালুকদারের লঞ্চে করে বঙ্গবন্ধুকে আমরা দুর্গত এলাকায় নিয়ে গেলাম। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, লক্ষ মানুষের মৃতদেহ আর সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া দুঃখী মানুষের পাশে তিনি দাঁড়ালেন। তাদের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দিয়ে তাদের সমব্যথী হলেন। যখন মনপুরায় গেলাম, দেখি বহু লোকের ভিড়ে একজন সম্ভ্রান্ত মানুষ খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে তার স্র্রেফ একটা লুঙ্গি। আমি লঞ্চ থেকে নেমেই তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি আমার প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন শাহজাদা ভাই। ১০ তারিখে উনি মনপুরা গিয়েছিলেন আমার নির্বাচনী প্রচারকার্য চালাবার জন্য। যখন মনপুরা থেকে ফিরে এলাম উনি তখন থেকে গেলেন। আমি উনাকে অনুরোধ করেছিলাম আমাদের সাথে ফিরবার জন্য। কিন্তু উনি বললেন, ‘আমি ইলেকশন পর্যন্ত থাকবো।’ গিয়ে দেখি উনার কিচ্ছু নাই। আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে টেনে আদর করলেন। লঞ্চের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর যে পাজামা-পাঞ্জাবি ও মুজিব কোট ছিল সেগুলো তিনি শাহজাদা ভাইকে দিলেন। তারপর সেখান থেকে ফেরার সময় বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আর আমার পক্ষে এগুলো দেখা সম্ভবপর নয়! আমাকে তাড়াতাড়ি ঢাকা পাঠিয়ে দাও।’ যে বিশেষ লঞ্চে বঙ্গবন্ধু ভোলা গিয়েছিলেন সেই লঞ্চে করে ঢাকায় ফিরে এলেন। উপকূলীয় দুর্গত এলাকা ভোলা, রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ সফর শেষে হোটেল শাহবাগে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দুর্গত এলাকা আমি সফর করে এসেছি। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে লক্ষ লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করে। এভাবে আমরা মানুষকে মরতে দিতে পারি না। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এখনো দুর্গত এলাকায় আসেন নাই। আমরা যে কতো অসহায় এই একটা সাইক্লোন তা প্রমাণ করেছে। আরো একবার প্রমাণিত হলো যে, বাংলার মানুষ কতো অসহায়! একবার পাক-ভারত যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে, আরেকবার এই ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রমাণিত হলো। সুতরাং, আমরা এইভাবে আর জীবন দিতে চাই না। আমরা স্বাধিকারের জন্য, আমাদের মুক্তির জন্য আত্মত্যাগ করতে চাই।’ আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই নির্বাচনে আমি অংশগ্রহণ করবো। এই নির্বাচন হবে আমার জন্য একটা গণভোট। এই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে প্রমাণিত হবে কে বাংলাদেশের নেতা এবং কিভাবে এই অঞ্চল পরিচালিত হবে।’ ভোলা সহ উপকূলীয় দুর্গত এলাকা সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করে বাংলার মানুষকে তিনি এক কাতারে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। চলবে... লেখক ঃ আওয়ামী লীগ নেতা, বাণিজ্য মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঃড়ভধরষধযসবফ৬৯@মসধরষ.পড়স
×