ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রদীপ সাহা

ভূমিকম্পরোধী ওয়ালপেপার!

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ১১ নভেম্বর ২০১৬

ভূমিকম্পরোধী ওয়ালপেপার!

পৃথিবীপৃষ্ঠের কোন অংশের হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তনই ভূমিকম্প। ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্প একটি। এর ফলে প্রতিবছর অনেক মানুষের প্রাণ যায়। ভেঙে পড়ে অসংখ্য ঘরবাড়ি। সম্প্রতি জার্মান বিজ্ঞানীরা এমন এক ধরনের ওয়ালপেপার আবিষ্কার করেছেন, যেটি বাড়ির দেয়াল ভেঙেপড়া প্রতিহত করতে পারে। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘ইন্টেলিজেন্ট কম্পোজিট সিসমিক ওয়ালপেপার’। তবে বিজ্ঞানীরা এর সহজ নাম দিয়েছেন ‘ভূমিক¤প ওয়ালপেপার’। গ্লাস ফাইবার দিয়ে তৈরি এই পেপার কোন বাড়ির দেয়ালে লাগালে সেটা ভূমিকম্পের সময় সহজে ভেঙে পড়বে না। আর পড়লেও ওয়ালপেপারের ভেতরে থাকা বিশেষ প্লাস্টিকের কারণে ইটের টুকরোগুলো হঠাৎ করে মানুষের মাথার ওপর পড়বে না। কেননা ওই প্লাস্টিক সেগুলোকে কিছু সময়ের জন্য আটকে রাখতে পারবে। আর ততক্ষণে ঘরের ভেতর থাকা মানুষগুলো বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে। জার্মানির কার্লসরুয়ে ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধীনে থাকা ইনস্টিটিউট অব সলিড কনস্ট্রাকশন এ্যান্ড কনস্ট্রাকশন মেটেরিয়াল টেকনোলজির বিজ্ঞানীরা এই ওয়ালপেপার আবিষ্কার করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, এতো বড় একটা কাজ করতে পারে যে ওয়ালপেপার সেটি মাত্র এক মিলিমিটার পুরু। প্রথম দেখে বিশ্বাসই হতে চাইবে না যে, কী করে এমন একটা সরু ওয়ালপেপার এতো বড় একটা কাজ করতে পারে! গবেষকদের একজন মরটিস উরবান এই ওয়ালপেপারের কাজ করার কৌশলটা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ফাইবার দিয়ে এই পেপারটা তৈরি। এটি একইসঙ্গে খুব শক্তিশালী এবং স্থিতিস্থাপক। ফলে যখন ভূমিক¤প হয় তখন এই ওয়ালপেপারটা পুরো দেয়ালেই কম্পনের মাত্রা ছড়িয়ে দেয়। তাই দেয়ালের দুর্বল অংশের উপর আঘাত হানার সুযোগ নেই ভূমিকম্পের। ফলে দেয়াল সহজে ভেঙে পড়বে না। কিন্তু এরপরও যদি ভাঙনের সৃষ্টি হয় তাহলে ভয়ের কিছু নেই। আছে ‘স্থিতিস্থাপক পলিপ্রোপিলিন প্লাস্টিক’। ওয়ালপেপারের মাঝে এই প্লাস্টিকের অবস্থান। এর কাজ হচ্ছে ভেঙে যাওয়া টুকরাগুলো আটকে রাখা, যেন সেগুলো মানুষের মাথার ওপর না পড়ে। অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও এই কাজ সাফল্যের সঙ্গে করতে সক্ষম এই প্লাস্টিক। এই সময়ের মধ্যে মানুষগুলো বাইরে বেরিয়ে যেতে পারবে। অন্য এক গবেষক লোথার স্টেম্পনিভস্কি বলেন, অন্যান্য ওয়ালপেপারের মতো ভূমিক¤প ওয়ালপেপারও প্লাস্টার করা দেয়ালে লাগানো যাবে। অবশ্য এজন্য বিশেষ ধরনের আঠা ব্যবহার করতে হবে। আর এই আঠাটি তৈরি করেছে জার্মান কোম্পানি ‘বায়ার আর্থ সায়েন্স’। এর একজন কর্মকর্তা মিশায়েল এঙ্গেল বলেন, সাধারণ ওয়ালপেপার লাগানোর আঠা হয় শক্তিশালী এবং স্থিতিস্থাপক নয়। কিন্তু ভূমিকম্প ওয়ালপেপারের আঠাকে অবশ্যই দুটি গুণেরই অধিকারী হতে হবে। বায়ারের তৈরি এই আঠাতে যে রাসায়নিক পদার্থগুলো রয়েছে সেগুলো একে অপরের সঙ্গে হাইড্রোজেন দ্বারা যুক্ত। ভূমিকম্পের কারণে কখনও এই বন্ধন ছুটে গেলে, মুহূর্তের মধ্যেই সেগুলো দেয়ালের অন্য কোন অংশে গিয়ে সংগঠিত হতে পারে। এভাবেই ওয়ালপেপারটি দেয়ালের সঙ্গে লেগে থাকবে। বিজ্ঞানী উরবান বলেন, তাঁরা বাস্তবে একটি ঘর তৈরি করে এই ওয়ালপেপারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং সফল হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, মাঝারি থেকে কম শক্তিশালী ভূমিকম্পে এই ওয়ালপেপার কার্যকরী। তবে এটা শুধুমাত্র ইটের তৈরি বাড়ির জন্য প্রযোজ্য, কংক্রিটের জন্য নয়। কংক্রিটের জন্য আরও শক্তিশালী ফাইবার প্রয়োজন এবং এটা নিয়েও কাজ চলছে। বায়ার্ন কর্মকর্তা এঙ্গেল বলেন, ‘বাজারে ছাড়ার জন্য ভূমিকম্প ওয়ালপেপার তৈরি। ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ যেমন জাপান, তুরস্ক অথবা চিলিতে এই ওয়ালপেপার কাজে লাগানো যেতে পারে। ঐসব দেশের সরকার চাইলে হাসপাতালে, বৃদ্ধাশ্রমে বা শিশুদের স্কুল তৈরিতে এই পেপার ব্যবহার করতে পারে।’ প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণ ওয়ালপেপারের চেয়ে ভূমিকম্প ওয়ালপেপারের দামটা একটু বেশি হলেও আস্তে আস্তে দাম কমে আসবে বলে জানান এঙ্গেল। সত্যি, প্রযুক্তির উৎকর্ষে কত কিছুই না আবিষ্কৃত হচ্ছে। কত অসাধ্য সাধন করাই না সম্ভব হচ্ছে। ভূমিকম্পের হাত থেকে বাঁচাতে বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত এই ওয়ালপেপার সত্যিই একটি সময়োপযোগী এবং বলিষ্ঠ আবিষ্কার এ কথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
×