ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইুরুল করিম নাসিম

জার্নাল

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১১ নভেম্বর ২০১৬

জার্নাল

কবিতার কথা আজকাল অনেকেই ছন্দ ভালভাবে না জেনেও দেদার কবিতা লিখছে। আবার আমার সেই সব কবি বন্ধু গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলছে, এখন ছন্দমিলের যুগ চলে গেছে, ছন্দহীন কবিতাই এখন আধুনিক কবিতা। তারা ছন্দ না জেনে যে কবিতা লিখছে এই কথাটি গোপন থাকছে না, তাদের কবিতা পড়লেই তা সম্যক বোঝা যায়। কবিতা কি ও কেন, কি করে কবিতা আজকের এই জায়গায় এসে পৌঁছল, এসব তথ্য আমার সেই সব শিল্পসহযাত্রী বন্ধু জানতে চান না। ‘ফ্রি ভার্স’ কবিতা কখন, কে, কিভাবে শুরু করলেন, তাও তাদের জানা নেই। আজকাল বই প্রকাশনা খুব সহজ ও সুলভ হয়ে গেছে। টাকা থাকলেই, টাকা বিনিয়োগ করলেই, বই ছাপা যায়। অতএব কবি শব্দটি ‘স্বঘোষিত’ হয়ে গেছে অনেকটা। আজকাল কবিতা পাঠের আসরে গেলে অসংখ্য নারী-পুরুষকে স্বরচিত কবিতা পড়তে দেখা যায়। একটু ভাল করে কান পাতলে কিংবা শব্দচয়ন ইত্যাদি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কোন খুব চেনা কবির কার্বন কপি তাদের সেই সব অপরিপক্ব কবিতা। কবিতা এত সহজ বিষয় নয়। অনেক শ্রম, অনেক মেধা, অনেক পাঠপ্রক্রিয়া, অনেক বিনিদ্র রজনী কাটানোর পর একটি সফল কবিতা ধরা দেয়। একই সঙ্গে দেখবার চোখ, যা-কে বলে ‘তৃতীয় নয়ন’, পঠনপাঠন, অভিজ্ঞতাও এর সঙ্গে সম্পৃৃক্ত রয়েছে। এ কথাটি আমরা অনেকেই ভুলে যাই, কবিতা কিংবা গল্প লেখার আগে প্রচুর পড়তে হয়। কথা বলে দেখেছি, আমার সেই সব বন্ধু, তেমন একটা পড়েন না। তাদের পাঠাভ্যাস বা জঊঅউওঘএ ঐঅইওঞ নেই বললেই চলে। শুক্রবারের সাহিত্য-সাময়িকী, সাহিত্য মাসিক কিংবা লিটল ম্যাগের কবিতাগুলোতেও যদি চোখ বোলাত আমার সেই সব বন্ধু, তা হলেও একটা সম্যক ধারণা হতো সাম্প্রতিক কবিতা সম্পর্কে। বিদেশে দেখেছি, স্বরচিত কবিতার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বরং কবিতার কর্মশিবির বা ওয়ার্কশপও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেখানে অভিজ্ঞ প্রবীণ কবিরা কবিতা রচনা সম্পর্কে কথা বলছেন, তাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা, কবিতার সুখ-দুঃখ নিয়ে কথা বলছেন। নতুন প্রজন্মের কবিদের সঙ্গে বাক বিনিময় হচ্ছে, তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে, কিন্তু কখনও কলহ হচ্ছে না। একটা চমৎকার নান্দনিক কবিতা সন্ধ্যা আমাদের অভিভূত করছে। আমাদের দেশের সংগঠকরাও এ রকম সৃজনশীল কবিতা সন্ধ্যার আয়োজন করতে পারেন। সেদিন হঠাৎ একটি বই হাতে পেলাম তরুণ কবি, সম্পাদক ও সংগঠক মুজিবুল হক কবির লেখা ‘ছন্দের ঘরবাড়ী’ এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম। ভাল লাগল। ঋদ্ধ হলাম। একই সঙ্গে মনে পড়ল শঙ্খ ঘোষের ‘ছন্দের বারান্দা’, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা কি ও কেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা বিষয়ক ৪টি বই... এবং ভিনদেশী লেখক উমবার্তো ইকোর সাহিত্যবিষয়ক একটি চমৎকার গ্রন্থ ‘অন লিটারেচার’। সেই বইতে কবিতার চিত্রকল্প, কবিতার প্রতীক ইত্যাকার বিষয়ের ওপর লেখা তাৎপর্যময় বেশ ক’টি প্রবন্ধ রয়েছে। আমার হাতে অফুরন্ত সময় নেই থাকলে সেই সব প্রবন্ধ আমি আমার বন্ধুদের জন্য অনুবাদ করতাম। আমাদের কবিরা অনেকেই ভাল কবিতা লিখছেন। তবে অধিকাংশ কবি বৃত্তবন্দী হয়ে একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছেন বলে কেউ কেউ মনে করেন। নিজেকে তারা অতিক্রম করতে পারছেন না বলেও অনেকের প্রাজ্ঞ অভিমত। এটা কেন হয়? আসলে আজকের কবিতা এই সময়কার কবিতা সময়ের পালাবদলে এখানে এসে পৌঁছেছে। কবিতার পালাবদলের এই ইতিহাস কবিকে জানতে হবে। যিনি কবি, যিনি স্রষ্টা, তিনি শুধু শব্দ শ্রমিক নন, তিনি একজন সৃজনশীল শব্দকারিগর। সেই কতকাল আগে ফরাসী কবি মালার্মে বলেছিলেন ‘ওয়র্ড ইজ প্রোয়েট্রি’ ডঙজউ ওঝ চঙঊঞজণ, কিন্তু কবিতা সম্পর্কে এটাই তো একমাত্র রায় নয়, কবিতা সম্পর্কে এটাই শেষ কথা নয়। আমাদের বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল বলেছেন, ‘কবিতা মূলত সংবাদ।’ এটাও একমাত্র কথা নয়। শুধু শব্দ দিয়ে যেমন কবিতা নির্মাণ করা যায় না, তেমন কবিতা কেবল সংবাদ বা ‘মেসেজ’ গঊঝঝঅএঊ পরিবেশন তার দায়িত্ব শেষ করে না। কবিতার আরও কিছু আয়োজন ও অনুষঙ্গ দরকার। ‘আবেগ’ কল্পনাও থাকতে হয় কবিতায়। এসব কথা অনেকদিন আগে ভিনদেশী এক কবি ওয়ার্ডস ওর্থ বলেছিলেন তার ‘প্রিফেস টু লিরিকাল ব্যালাড’ নামের এক প্রবন্ধে। তিনি বলে ছিলেন, ‘পোয়েট্রি ইজ স্পনটে নিয়াস ওভার ফ্লো অব পাওয়ারফুল ফিলিংস।’ এটা নিয়ে অনেক বাগ্বিত-া হয়েছে। সে সব রোমান্টিক যুগের কথা। টি.এস.এলিয়টও ‘ইউজেস অব পোয়েট্রি’ টঝঊঝ ঙঋ চঙঊঞজণ গ্রন্থে বেশ তাৎপর্যময় কিছু কথা বলেছেন। ছুটি কাটাতে লন্ডনে আমার প্রবাস জীবনে যখন ছুটি কাটাতে লন্ডনে আসতাম, বইপাড়া আর নাটকপাড়া ছিল আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। অন্য বঙ্গ সন্তানদের দেখতাম সন্ধ্যার পরে শুঁড়িখানা, যা ‘পাব’ বলে পরিচিত, অথবা নাইট ক্লাবে, কিংবা পিকাডেলি সার্কাস রোডে মনোরঞ্জনের জন্য যেত। কিছু ভাল, বিদগ্ধ ও ঋদ্ধ বন্ধু ও শুভাকাক্সক্ষী পেয়েছিলাম সেখানে, বেশ সৃজনশীল আড্ডায় আমার সময় কেটে যেত। সেই সময়, সেই সুদূর ১৯৮৬ সালে জীবনে প্রথম লন্ডন ম্যাগাজিন, পোয়েট্রি ম্যাগাজিন এবং নাম ভুলে যাওয়া আরও দু’-একটি সাহিত্যপত্র দেখবার এবং কিনবার সুযোগ হয়। ঢাকায় এসে আর সে সব কেনা সম্ভব ছিল না। প্রথম কথা বেশ দাম, দ্বিতীয়ত ঢাকার বই বা ম্যাগাজিন স্টলে পাওয়া যেত না। বন্ধু ও গ্রন্থকার আহমেদ বুলবুল ইসলাম একদিন আমাকে পুরনো বইয়ের দোকানে নিয়ে এলেন। আবার নিউইয়র্কার সাপ্তাহিক ও অন্য দু’-একটি সাহিত্যপত্রিকা পেলাম। দাম খুবই নগণ্য। শুধু পেলাম না লন্ডন ম্যাগাজিন এবং পোয়েট্রি ম্যাগাজিন। নিউইয়র্কারে প্রতি সপ্তাহে একটি সাম্প্রতিক ধারার গল্প এবং দুটি কবিতা পুস্তক সমালোচনা ইত্যাকার বিষয় পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলাম। এখন পত্রিকাগুলোর দাম অনেক বেড়ে গেছে। আগে যেখানে প্রতি সংখ্যা ১০ টাকায় কিনতাম, এখন ৫০ টাকায়ও বিক্রি করতে চায় না। তবুও কিনি, যেহেতু এক ধরনের অভ্যাস গড়ে উঠেছে। আমি মূলত পাঠক। পড়তে ভাল লাগে। যতক্ষণ জেগে থাকি পড়ি এবং পড়ি, শুধু পড়ি। তারপর লিখি। ঢাকায় সময় খুব নষ্ট হয়। অর্থহীন আড্ডা, তৃতীয় শ্রেণীর কবিতা পাঠের আসর এবং এমনসব অনুষ্ঠান যেখানে না গেলে জীবন থেমে থাকবে না। আমারও কোন ক্ষতি হবে না। প্রবাস জীবনের বেশ কিছুটা সময় আমি ল-নে কাটিয়েছিলাম। সেই সব স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা আমার বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরেছি। তবে লন্ডনের স্বল্পকালীন জীবনটা খুব ঘটনাবহুল। সাহিত্য সাময়িকীর আমার এক তরুণ কবি বন্ধু সেই জীবন নিয়ে উপন্যাস লিখতে বলেছেন বার বার। এ কথা ঠিক নয় যে, সময় পাইনি। আলস্য ভর করেছিল। লিখিনি তবে এখন মনে হয়, এসব বিষয় হারিয়ে যাওয়ার আগে লেখা যেতে পারে। তবে লন্ডন ভ্রমণ নিয়ে প্রয়াত কবি-সম্পাদক কায়সুল হক অধুনা লুপ্ত ‘শৈলী’ পত্রিকায় ‘টেমস নদীর তীরে’ শীর্ষক আমার নাতিদীর্ঘ ভ্রমণালেখ্য ছবিসহ যতœসহকারে ছেপে ছিলেন। অভিবাসী জীবন নিয়ে অসংখ্য গল্প-উপন্যাস ইংরেজীতে লেখা হয়েছে, বাংলা ভাষায়ও লেখা হয়েছে। ঝুম্পা লাহিড়ীর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ইন্টার প্রিটেশন অব ম্যালাডিজ’ এখন কলকাতা থেকে বাংলা অনুবাদে পাওয়া যায়, ভীষণ অভিভূত করেছিল সেই সুদূর ২০০০ সালে। বেশ কিছুসংখ্যক অভিবাসী কথাসাহিত্যিক আছেন যারা ওই জীবনের টানাপোড়েন নিয়ে চমৎকার সব উপন্যাস লিখেছেন। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী লেখক আদিব হাসানের লেখা ‘সিজনাল এ্যাডজাসমেন্ট’ দশ-বারো বছর আগে পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এরপর আদিব আরও উপন্যাস লিখেছেন। ‘ব্রিকলেন’ লিখে বিপুল খ্যাতি পেয়েছেন আরেক বাঙালী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখিকা মনিকা আলী। পরে তিনি আরেকটি উপন্যাস ‘ইন দ্য কিচেন’ লেখেন। সেখানে অভিবাসী জীবনের কথা উঠে এসেছে।
×