ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

প্রজ্বলিত সন্ধ্যা প্রদীপ

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১১ নভেম্বর ২০১৬

প্রজ্বলিত সন্ধ্যা প্রদীপ

ইতালির নাবিকরা দুরু দুরু বুকে সেই প্রাচীনকালে মহাসমুদ্রে ডিঙ্গি ভাসাবার সময় জানতেন ঝড় আসবে, উত্তাল ঢেউ আসবে, বজ্রাঘাত হবে। তবুও জীবিকার তাগিদে নৌকা ভাসাতেই হতো। যত ঝঞ্ঝাই আসুক না কেন তবু তাদের ভরসা-নিভর্রতা ওই সমুদ্রের কাছে। সমুদ্রের প্রতি তাদের স্বগোতক্তি নির্ভরতার মরমীয় উচ্চারণ, হে সমুদ্র তুমি কত গভীর ও বিস্তৃত আর আমার ডিঙ্গি নৌকা কত সামান্য তথাপি বিপদকালে তুমিই আমাদের সুরক্ষা দিও। ইতালির নাবিকদের মতো উচ্চারণ এ বছর অমর একুশে বই মেলায় কবি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত, কবি সাফায়েত ঢালী রচিত কাব্য গ্রন্থ ‘সন্ধ্যা প্রদীপ’-এর একটি কবিতায়। যেখানে কবি লিখছেন, আমাকে চেপে ধরে প্রবল আক্রোশে, আমি হয়ে যাই টর্নেডোর তীর্থ ভূমি, ল-ভ- হয়ে যায় সব তবুও তোমায় আমি আজও খুঁজে ফিরি বালুকাবেলায়, আমর মার্বেল সমুদ্র আজ আমাকে ভাবায় আমি লিখে যাই অন্য নামে তোমার নাম প্রতিটি কবিতায়। (প্রথম যখন সৈকতে) কবিতায়-সাহিত্য রচনায় কিংবা শিল্প সাধনায় মানব কল্যাণই তো শেষ কথা। মানুষের ওপর শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস রাখাটাই পরম সহিষ্ণুতা। ভালবাসার স্পর্শে দস্যু রতœাকর যদি মহাকবি বাল্মিকী হতে পারেন, ডাকাত অঙ্গুলি মালা যদি বুদ্ধের শরণাপন্ন হতে পারেন তবে আকুতি প্রার্থনায় পাষাণে প্রাণ পাবে না তাকি হয়। তই তো কবি সাফায়েত ঢালী লিখলেন, তোমর সৃষ্টিতে আমিই ছিলাম শ্রেষ্ঠ একটা কিছু, তোমার শব্দের বাতাস দোলে শব্দ খুঁজে পেলাম। (শেষ উপহার) শব্দ খুঁজে পাওয়াই শুধু না বরং চিও চাঞ্চল্যতা আসে চাঁদের উদয়ে সমুদ্রবক্ষে কিংবা রবির উদয়ে প্রাণিকূলে। ফুলের ঘ্রাণে মোহিত হয় ভ্রমর, বসন্তের আগমনে বিহঙ্গকূলে কোকিলের সুমিষ্ট সুর। তথাপি বিভেদের দাগ তো মোছে না। বিশ্বায়নে খর্বিত হয় আঞ্চলিকতা, সাম্রাজ্যবাদে কোণঠাসা স্বতন্ত্রতা, গোত্র-বর্ণ- আচারিক ব্যবধানে মনুষ্যত্বের জয়গাথা। যে কারণে কবি সাফায়েত ঢালী সামগ্রিকের অংশ হয়ে অংশত উচ্চারণ করেন, ভালবাসার শীর্ষ বিন্দু জয় করার সাধ ছিল তাই তো তোমাকে জড়িয়ে ধরা, তোমার ভালবাসা ছিল বটবৃক্ষ আমারটা ছিল লতা। (ভালবাসার শীর্ষ বিন্দু) লতা কিংবা পাতা বলে তাচ্ছিল্য প্রাপ্তিকে বলিষ্ঠভাবে প্রত্যাখ্যানে বিশ্বাসী কবি সাফায়েত ঢালী। অংশত বিন্দু বিন্দু জলকণা নিয়েই মহা সমুদ। সংসারে-সমাজে-রাষ্ট্রে সকলেরই রয়েছে কম-বেশি বাস্তবিক অংশগ্রহণ। প্রকা-ের অহমিকা সত্য জেনেও ক্ষুদ্রতার প্রতি কবির মমত্ব। যে কারণে কবি লিখলেন, তোমাকে ছোঁয়ার জন্য শিরদাঁড়া সোজা কারে তুফান চোখে খুঁজি, মহাকাশ নেমে আসে নক্ষত্রের হাত ধরে ছায়াপথের তারার মেলায় দেখি তোমার সদম্ভ বিচরণ। তোমাকে ছোঁয়ার জন্য) সদম্ভ বিচরণ আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার দাফটে আজ সভ্যতার পরিক্রমা এবড়ো খেবড়ো পথে দোদুল্যমান। এই বিভেদ- এই অসহিষ্ণুতা- এই দাম্ভিকতার অবসান হওয়া দরকারই নইলে সভ্যতা সঙ্কটে আবর্তিত হয়ে পরিণতি কি ভয়ঙ্কর হতে পারে সে ভাবনার আগাম সতর্কতা তার রচিত কবিতায়, প্রণয়ের সমস্ত সৌধ আজ ধ্বংসস্তূপ প্রলয়ের আঘাতে ¯িœগ্ধ বায়ু ল-ভ- দিকভ্রান্ত খ-িত বায়ুর দূষিত চাপ, শ্বাস-প্রশ্বাসে জাগায় মৃত্যুয় ঢেউ। (দিকভ্রান্ত) ঢেউও শেষ পর্যন্ত কূলে আচড়ে পড়ে মিলিয়ে যাবে, আগুন নিভে শীতল জল হবে, ধরিত্রীও আবার শান্ত হবে। বিভেদের অবসানে পরস্পর পরস্পরে পুনঃ দেখা হবে। অনুতাপ- অনুশোচনা শেষে মানুষের ধরিত্রীতে মানুষেরই দেখা মিলবে। কবির কবিতায় তারই আগমনী, ক্লান্তিময় পথচলা হয় না স্থির, আশার মশাল হৃদয়ে ধারণ করে শক্তি কুড়ায়ে চলি, তুমি ক্লান্ত হবে একদিন, ভুলেও যদি একবার ফের গোলাকার পৃৃথিবীতে আবার দেখা হবে সেই দিন। (নেশা)
×