ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেজওয়ানা আলী তনিমা

জঙ্গীবাদ ও নারী

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১১ নভেম্বর ২০১৬

জঙ্গীবাদ ও নারী

আবেদা ঢাবির সাংবাদিকতার প্রাক্তন ছাত্রী। দারিদ্র্যবিমোচন কি নারী ক্ষমতায়ন কি সাংস্কৃতিক কর্মকা- প্রতিটিতেই তার উৎসাহ সীমাহীন। সেভ দ্য চিলড্রেনে চাকরিতে করেন। ব্যক্তিগত জীবনও যথেষ্ট গোছালো। ব্যাংকার স্বামী তানভীর ও দুটি ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে সচ্ছল সুখের সংসার। হঠাৎ শোনা গেল জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলাকালে আবেদা ধরা পড়েছেন পুলিশের হাতে। অভিযোগ হলো-তিনি জঙ্গী তানভির কাদেরির স্ত্রী জঙ্গী আবেদাতুল ফাতেমা। পরিচিত আত্মীয়বন্ধুরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। গুলশান, শোলাকিয়া ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশের চালানো জঙ্গী অভিযানে এ পর্যন্ত মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসির ছাত্রী ও একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষানবিস চিকিৎসক, ইডেন কলেজ ক্যাম্পাস থেকে জঙ্গী সন্দেহে হিযবুত তাহরিরের চার মহিলাসদস্য গ্রেফতার হন মাত্র দু’মাসে পুরোদেশে গ্রেফতার ১০৩ জন, সন্দেহের খাতায় প্রায় ২৪০ জন। ধারণা হচ্ছে, সক্রিয় সদস্য অন্তত হাজার দেড়েক! ইডেনে গ্রেফতারকৃত নুরুন্নাহার ও তার স্বামী ঢাবির পরিবেশ ও ভূগোল বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। এই দম্পতির অধীনে ঢাকায় নারী জঙ্গীদের আলাদা ইউনিট আছে। ইউনিটের সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বস্তির দরিদ্র নারীরাও। এদেরকে সাহায্য করছে কয়েকটি ইসলামী দল ছাড়াও দেশী-বিদেশী এনজিও। এই খবরগুলো জনমানসে বেশ ধাক্কা দেয়। কারণ আমাদের মনে কেমন একটা ধারণা ঢুকে গেছে- জঙ্গী হবে, বোমা ফোটাবে, যতরকম বিধ্বংসী কাজকারবার করবে পুরুষেরা। তাই নারী যখন হন জেএমবির আত্মঘাতী দল, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম কিংবা আইএসের গ্রুপের সদস্য, সরকারী বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেন, অস্ত্র অর্থবহন করেন, বিস্ফোরক তৈরি করেন, দরকার হলে সরাসরি আক্রমণও করেন- এইসব ভূমিকা আমাদের হতবাক করে দেয়। কেননা, চিরায়ত বাঙালী সংস্কৃতিতে নারী মানেই মা, কন্যা, স্ত্রী- শান্তিনীড়ের আশ্রয়দাত্রী। কিন্তু সত্য হলো এই চরমপন্থী সংস্থাগুলোতে এখন নারীরা স্বেচ্ছায় যাচ্ছেন। কিন্তু কেন? নারীরা প্রধানত বৈবাহিক সূত্রে জঙ্গীবাদে যুক্ত হচ্ছেন। স্বামীদের কাছ থেকে জঙ্গী মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একপর্যায়ে সহযোগীর ভূমিকা নেন। উদাহরণস্বরূপ ব্লগার অভিজিতের হত্যামামলার আসামি মুকুল রানা বিয়ে করেন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের গুরুত্বপূর্ণ লিডার মুজিবুর রহমানের বোন মহুয়া আক্তার রিমিকে। বিয়েটির মধ্যস্থতা করেছিলেন সেনাবাহিনীর বরখাস্ত বিতর্কিত মেজর জিয়াউল। রিমি সরাসরি জঙ্গী না হলেও জঙ্গী স্বামী ভাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রাখেন। অনেকের বোনই ভাইয়ের কাছ থেকেই জঙ্গী দীক্ষা নিচ্ছেন। আর শিক্ষিত ধর্মভীরুরা অনলাইন প্রচারণায় আকৃষ্ট হয়ে এতে যোগ দেন। জঙ্গী সংস্থাগুলো কেন এদেরকে দলে নিচ্ছে? যেখানে বিশেষত কট্টর ইসলামী ভাবধারায় মেয়েদের ঘরে থাকতেই উৎসাহিত করা হয় ও জিহাদকে শুধুমাত্র পুরুষদেরই কাজ বলা হয়? আসলে ঘরভাড়া পাওয়া, সহজেই অস্ত্রবহন, তথ্যসংগ্রহ, স্ত্রীসন্তানসহ যাতায়াাত- দলে নারী থাকলে সবক্ষেত্রেই সুবিধা। জঙ্গীদের নিজেদের মধ্যে বিয়ের আরেকটি কারণ- তাতে তথ্যগোপন থাকে। স্ত্রীও জঙ্গী হলে আরও সুবিধা। এছাড়া নারীরা নতুন নারীসদস্য নিয়োগ উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে জঙ্গী মতবাদকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে লাগেন। পর্দাকারিণীদের চিহ্নিত করাও কঠিন। এদের সে কারণেই অস্ত্র চালান, সুইসাইডাল এ্যাটাকের কাজে লাগানো সুবিধাজনক। এই নারীদের আক্রমণের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। বিশেষত এখন যখন পুরুষজঙ্গীদের গোপন কর্মকা-ের খবর দ্রুত গোয়েন্দাসংস্থার জালে ধরা পড়ছে তখন নারীদের বায়তি সুবিধা ব্যবহার করে ভবিষ্যতে তাদের জঙ্গী আক্রমণে পাওয়া গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই নারীরা সমাজের সবস্তরের- অনেকেই শিক্ষিত, প্রযুক্তি জানেন। আর তাদের শিক্ষাপ্রযুক্তিজ্ঞানকে কাজে লাগাচ্ছে জঙ্গীরা। তরুণ বয়সে সমাজবদলের আগ্রহে ভুলপথকে ঠিক হিসেবে বেছে নিচ্ছেন মেয়েরা। ভাবছেন ‘জিহাদে’র পথে গিয়ে তারা পুরুষের পাশাপাশি এক ভারসাম্যপূর্ণ মর্যাদাকর জীবন, প্রকৃত ইসলাম ও ধর্মীয় সুশাসন পাবেন যেটা সমাজে এখন নিদারুণভাবেই অনুপস্থিত। এই ব্যাপারটি বাংলাদেশের মতো যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধাহীন দেশেই ঘটছে ভাবলে ভুল হবে। সারাবিশ্বেই নারীরা ভ্রান্ত ইসলামী বিপ্লব বা তারুণ্যের জোশে সিরিয়া যাচ্ছেন যাদের শেষ পরিণতি যৌনদাসী হওয়া। লন্ডনের ঘটনাই ধরুন। দুটি বাঙালী কিশোরী একদিন স্রেফ উধাও হয়ে যায়। পুরোপুরি অন্ধকারে থাকা তাদের পরিবার স্তম্ভিত হয় যখন জানতে পারে তারা আইএসে যাচ্ছে। বোঝাই যায় জঙ্গীবাদ স্রেফ বাংলাদেশের সমস্যা না, এর প্রভাব সর্বগ্রাসী, মোকাবেলাও চ্যালেঞ্জিং। আইনরক্ষাবাহিনীর মাধ্যমে পুরুষ জঙ্গীদের কর্মকা- অনেকটা ছেঁটে ফেলা গেলেও সেই জায়গায় দ্রুত ভরাট করছেন তাদের নারী কাউন্টারপার্টরা। ঐতিহাসিকভাবে এদেশবাসী ধর্মভীরু কিন্তু শান্তপ্রিয়। এমন জাতিসংস্কৃতিতে পুরুষের পাশাপশি নারীর জড়িয়ে পড়ায় আশঙ্কা জাগে পারিবারিকভাবে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও জঙ্গীবাদ হয়ত ছড়িয়ে পড়বে। তাহলে এত বছর ধরে তিলে তিলে আমাদের যে অর্জন তার সবই যে নিস্ফলা হয়ে যাবে! শুধু আশা ও প্রার্থনা এটুকু যে সব আশঙ্কা মিথ্যা হোক, ধর্মের নামে অধর্মের রক্তের হোলিখেলা বন্ধ হবে, আমাদের নারীরা প্রেরণা নেবেন রোকেয়া, সুফিয়া, জাহানারা ইমাম এদের কাছ থেকে।
×