ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোহাম্মদ কামরুল হাসান

আতঙ্কের নাম হরিণবেড়

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ১১ নভেম্বর ২০১৬

আতঙ্কের নাম হরিণবেড়

আঁকা-বাকা তিতাস নদীর তীর ঘেঁষা একটি গ্রাম হরিণবেড়। এখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই পেশায় জেলে। তাই ঘাটে বহু মাছ ধরার নৌকা বাঁধা। ঘাট থেকে কিছুদূর এগোলেই চোখে পড়বে রোদে শুকাতে দেয়া মাছ ধরার অসংখ্য জাল যা কাঠের সারিতে বিছানো। স্থানটি বেড়া দিয়ে ঘেরা। জালের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা উচ্ছিষ্ট মাছের আশায় মাথার ওপর কাকের কর্কশ শব্দ। অপ্রশস্ত নদীটি এদিকটায় বেশ বাঁকানো। মাঝখানে কেবল ধু ধু বিল ও সর্পিল নদী। আষাঢ়-শ্রাবণ এ দুই মাস সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ী ঢলের কারণে পানিতে তলিয়ে থাকে পুরো এলাকা। তখন নদী ও বিল সব একাকার থাকে। বাকি সময়টা অর্থাৎ শীত মৌসুমে পানি কিছুটা নেমে এলে জেগে ওঠে সবুজ প্রান্তর। নদীর দূরের দিকটায় এমন মেঘলা আকাশেও ঘন সবুজ হয়ে দেখা দিচ্ছে হাওড় অঞ্চল। বন্যায় পলি জমার কারণে শুষ্ক মৌসুমে জমিতে বেশ ভালই ফসল হয়। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে এমন ভর-দুপুরেও এখানে বেশ অন্ধকার। এমন আধারেও ফসলের সবুজ রং দিগন্তে নিজেদের মেলে ধরেছে। আকাশজুড়ে কালো মেঘ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপের প্রভাব। তবে নদী নিথর-নিস্তব্ধ। একেবারে ঢেউহীন, শান্ত। বৃষ্টির ফোঁটায় মাঝে-মাঝে যেন কিছুটা প্রাণ ফিরে পাচ্ছে তিতাস। সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের চরিত্রদের মতো তিতাস তীরবর্তী মানুষেরা আজ নিগৃহিত। নদীর মতোই প্রাণ-স্পন্দনহীন এখন হরিণবেড় গ্রাম। এখানকার পুরুষরা আজ গ্রামশূন্য। মহিলারা -উদ্বিগ্ন। গ্রামে নেই শিশুদের প্রাণচঞ্চলতা। সবার মাঝে কেবল ভয় আর আতঙ্ক। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধান এর মাঝেই স্বদেশের সঙ্গে অধিবাসীদের তৈরি হলো মনুষ্যসৃষ্ট দুরত্ব। ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে প্রথম এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছিল। চার বছর পর আবার একই ধরনের ঘটনা ঘটল নাসিরনগর উপজেলায়। রাষ্ট্রীয় বিচারে এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার সমান। কেন একটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী একজন ব্যক্তির অপরাধের জন্য প্রতিবার তার সমাজকে দায়ী ও হামলা করবে। হরিণবেড় কিংবা রামু দুটো ঘটনার সূত্রপাত ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড। ফেসবুকের পেজে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে এমন অনাকাক্সিক্ষত ও লজ্জাকার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। হরিপুর ইউনিয়ন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানার অন্তর্গত। তবে হরিণবেড় গ্রাম কিংবা হরিপুর ইউনিয়ন হবিগঞ্জের সীমান্তবর্তী। হবিগঞ্জের মাধবপুর হরিপুরের যতটা নিকটবর্তী নাসিরনগর ততটা নয়। নাসিরনগর সদর থেকে হরিণবেড়ের দূরত্ব প্রায় ৮-১০ কিমি। দেশের সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস এই গ্রামকে ঘিরে সংঘটিত। এই গ্রামের একজন তরুণের ফেসবুক পেজে কথিত ধর্ম অবমাননার জিগির তুলে এমন তুঘলকি কা- করে বসে মৌলবাদী দুটি গোষ্ঠী। এ এলাকায় ইসলামী ঐক্যজোটের প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর বেশ প্রভাব এবং তাঁর অনুসারীরা বেশ সক্রিয়। বছরের শুরুতে এক মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তারা তা-ব চালায় সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে। পরিণত করে ধ্বংসস্তূপে। নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে এবার তাদের সঙ্গী হয়, ‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামা’আত’। সাম্প্রদায়িক এ দুটো গোষ্ঠী ৩০ অক্টোবর রবিবার নাসিরনগর, মাধবপুর ইউনিয়নে বিক্ষোভের ডাক দেয়। এদিন নাসিরনগর সদরের ভিন্ন দুটি স্থানে সমাবেশ করে আহলে সুন্নত ওয়াল জামা’আত ও অনুসারী হেফাজত ইসলাম। এ দুটো গোষ্ঠীর সমাবেশের পর সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু হয়। আহলে সুন্নত ওয়াল জামা’আতের সমাবেশে নাসিরনগরের নির্বাহী কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম ও স্থানীয় থানার ওসি আব্দুল কাদের বক্তব্য রেখেছিলেন। তাদের বক্তব্যও উস্কানিমূলক ছিল বলে দাবি করেন নির্যাতনের শিকার কয়েকজন। শনিবার ছিল কালীপূজা। সেই আনন্দের ক্ষণে নাসিরনগরের দত্তবাড়ির লোকজন ছিল ভয়ে তটস্থ। কারণ সমাবেশের মাইকে ভেসে আসছিল ‘মালাউনের মাথা চাই’ ঘোষণার প্রতিধ্বনি। দত্তবাড়ির লোকজন জানায় এমন পরিস্থিতিতে কারও বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে সেদিন তারা ভালভাবে ঢোলও বাজাননি। কেবল নিয়ম রক্ষার তাগিদে যেটুকু প্রয়োজন তা রক্ষা করতে একবার ঢোল পিটিয়েছেন। অত্যন্ত সাদামাটা পুজা উৎযাপন করেছিলেন। নাসিরনগর উপজেলায় দত্ত পরিবার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত। যে কোন পূজা-অর্চনায় এ বাড়ির আঙিনায় স্থানীয় হিন্দুরা ভিড় করেন। স্থানীয় মুসলিম প্রতিবেশীদেরও আনাগোনা থাকে এ বাড়িতে। হামলার দিন এমন মুসলিম প্রতিবেশীরাই তাদের রক্ষা করেছিল। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। অনেকেই সেদিন হামলাকারীদের দ্বারা প্রহৃত হয়েছিলেন। তবুও পথ ছাড়েননি যুবকেরা। নিজেদের সবটুকু উজাড় করে আগলে রেখেছেন দত্তবাড়ির মানুষদের। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক হামলার এক সপ্তাহ পর পরিস্থিতি অবলোকন করতে ৬ নবেম্বর ঢাকা ছেড়েছিলাম। উদ্দেশ্য নাসিরনগর। আগের দিন গুগলে ম্যাপ দেখে কিছুটা ধারণা নিলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে যাওয়ার ঠিক উল্টোপথে এই উপজেলা। ইচ্ছা ছিল ট্রেনে যাওয়ার কিন্তু সময়মতো পৌঁছাতে না পেরে অগত্যা বাসেই চড়ে বসলাম। মেঘে আচ্ছন্ন রাজধানী। গেল কয়েকটা দিন এমন আবহাওয়াই ছিল। নিম্নচাপ ‘নাডা’র প্রভাবে। যাওয়ার পথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ঠা-া বাতাসের কারণে জানালার কপাট আটকানো। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবদুল কুদ্দুস মাখন চত্বরে এসে পৌঁছল বাস। নাসিরনগর যাওয়ার উদ্দেশে বিশ্ব রোড মোড়েই নেমে পড়লাম। বাস চত্বর পেরিয়ে ডান দিকে মোড় নিল। নাসিরনগর যাওয়ার উপায় সিএনজি অটোরিক্সা। যাওয়ার কোন বাস কিংবা অন্য পরিবহনের ব্যবস্থা নেই। কেবল সিএনজি। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর অবশেষে একটি সিএনজি অটোরিক্সায় চেপে বসলাম। সিলেট মহাসড়কের পাশ দিয়ে সরাইল হয়ে নাসিরনগর যাওয়ার পথ। নাসিরনগর যাওয়ার পথটা বেশ উঁচু। হাওড় অঞ্চল হওয়ায় নিচু প্লাবিত অঞ্চল বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় ডুবে থাকে। অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিনে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ হয়। মাঠে এখন আউশ ও আমন দুই প্রজাতির ধান। অনেক জমিনে বিগত কয়েকদিনের বৃষ্টির কারণে পানিতে ফসল ডুবে আছে। সরাইল সিলেট মহাসড়ক থেকে নাসিরনগরের বেশ দূরত্ব। নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছুতেই এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছিলাম না। মাথার মধ্যে কেবল পত্রিকার পাতায় ছাপা মানুষগুলোর মুখোচ্ছবি। খানিক বাদে নাসিরনগর কলেজ মোড়ে নামিয়ে দিল সিএনজি চালক। এটাই নাকি নাসিরনগর। তেমন কোন বাড়তি উত্তাপ দেখলাম না। বাংলার চিরায়ত মফস্বল বাজারের মতোই নাসিরনগর বাজারের দৃশ্য। এক কিশোর থেকে জেনে নিলাম আক্রান্ত মানুষদের বসতভিটার ঠিকানা। সে পথেই এগোলাম। প্রথমেই দত্ত বাড়ির আঙ্গিনায় ঢুকলাম। এ পাড়ায় কেবল এ পরিবারের নিজস্ব পূজাম-প। দত্ত বাড়ির পৈত্রিক নিবাস বেশ পুরনো। তাতে কিছুটা জমিদার বাড়ির ছোঁয়া। কালীপূজা উপলক্ষে বাড়ির উঠানে শামিয়ানা টাঙানো। সকাল থেকেই বাড়িতে বিজিবি পাহারা । মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা প্রতিমা পাহারা দিচ্ছে তারা। রাস্তায় র‌্যাবের কয়েকটি জীপ দেখলাম। গত কয়েকদিনে ঢাকা থেকে বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এসেছেন। সান্ত¡না দিয়েছেন আক্রান্ত পরিবারগুলোকে। পুরো বাংলাদেশের নজর এখন নাসিরনগর। চট্টগ্রাম বিভাগের সর্বোচ্চ সংখ্যক পূজাম-প তৈরি হয় এ উপজেলায়। এ বছর ১৩৫টি ম-পে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ অঞ্চল আজ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করবেÑ এমনটা ভাবতে পারেননি দত্ত পরিবারের নবম শ্রেণীর ছাত্র প্রতীক। সে দত্ত পরিবারের একজন কনিষ্ঠ সদস্য। তাদের পরিবারের বৈঠকখানায় ঢুকে নজরে পড়ল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও নেতাজী সুভাষ বোসের বাঁধানো ছবি। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা জানালেন সেদিনের কথা। আগের দিনের পূজা শেষ করে তারা তখন কিছুটা পরিশ্রান্ত ছিলেন। সঙ্গে ছিল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ভয়। তবে হামলা হবে এমনটা তারা কেউই প্রত্যাশা করেননি। বিশেষ করে এত ভেতরের ঘরে হামলা হবে এমনটা তো ভাবনার অতীত । এলাকায় হিন্দু-মুসলিম দু’ সম্প্রদায়ে চরম ভ্রাতৃত্ব। তাই এমন ভাবার অবকাশও কারোর ছিল না। তবে প্রশাসন ছিল চরম নির্লিপ্ত। আগের দিন থানাকে এসব হুমকির কথা অবহিত করা হলেও তারা পর্যাপ্ত ফোর্সের ব্যবস্থা করেননি। বরং পাশাপাশি দুটো ইসলামী দলকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন। আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এবং কলেজ মোড়ে দুটো সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সে সব সমাবেশ থেকে মূলত উস্কানি দেয়া হয় বলে আক্রান্তদের অভিযোগ। হামলার দিন দত্ত বাড়িতে লোকজন ছিল কম। বাইরে কিছু আমন্ত্রিত অতিথি বসা ছিল। হঠাৎ বহিরাগত কিছু ছেলে বাড়িতে ঢিল ছোড়ে। বিষয়টিকে তখন তারা খুব একটা গুরুত্ব দেননি। এরপর আবারও কিছু তরুণ এসে চিৎকার করে বলতে থাকে ‘ওই মন্দির ভাঙ, মন্দির ভাঙ।’ এবারও খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে বাড়ির কর্তা এসে তাদের তাড়িয়ে দেন। প্রতিবেশী মুসলমানরাও এখন এগিয়ে আসে ও আগন্তুকদের তাড়িয়ে দেয়। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই একটি মিছিল এসে হামলে পড়ে পুরো বাড়িতে। মাত্র দশ মিনিটের ব্যবধানেই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির দেয়া ঢিলে দিশেহারা হয় দত্ত পরিবার। তাদের পথ আগলে রাখে প্রতিবেশী ৮-১০ জন মুসলমান। আক্রমণকারীদের রোষানলে পড়ে শারীরিকভাবেও তারা আহত হন। তবে ভেতর থেকে দরজা আটকানো থাকায় আক্রমণকারীরা ভেতরে ঢুকতে ব্যর্থ হয়। এ যাত্রায় রক্ষা পায় দত্ত পরিবার। তবে আতঙ্ক এখনও পিছু ছাড়েনি। ১৯৭১ সালেও নাসিরনগরে পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর আজ তারা নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন। নাসিরনগর উপজেলায় রবিবারের হামলার জের না কাটতেই পাঁচদিন পর শুক্রবার ভোরে চারটি বাড়ির সাতটি ঘর ও একটি মন্দিরে আগুন দেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকার পরও কিভাবে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটল তা ভেবে এখন নতুন করে শঙ্কিত এলাকাবাসী। বসতঘরের লাগোয়া রান্নাঘর, গোয়ালঘর এবং কাঠ রাখার স্থানে আগুন দেয়া হয়। বাড়িগুলোর অবস্থান অনেক ভেতরে। এমন জায়গায় পরিচিত ছাড়া কারও পক্ষে এভাবে আগুন দেয়া সম্ভব নয়। সরু পথ দিয়ে প্রবেশ করতে হয় বণিকপাড়ায়। যার দক্ষিণ দিকে টিএ্যান্ডটি অফিসের দেয়াল। পশ্চিম দিকে সরকারী কোয়ার্টারের বাউন্ডারি, উত্তর দিকে পল্লী উন্নয়ন একাডেমির দেয়াল। পূর্বদিকে ইউএনও কার্যালয় ও শহীদ মিনার এলাকার রাস্তা। এলাকা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ব্যক্তি ছাড়া এ কাজ কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। বর্তমানে স্থানীয় হিন্দুরা বসতঘরে আগুন দেয়ার আতঙ্কে শঙ্কিত। নিপীড়িত এসব মানুষের ভাষ্য শুনে খুব অসহায় বোধ করছিলাম। এমন ধর্মান্ধতার শেষ কোথায়। বণিকপাড়া পেরিয়ে নমশূদ্রপাড়ায় এলাম। এ এলাকার অধিকাংশ বসতভিটাই টিনের তৈরি। অধিকাংশ বাড়ির টিন ক্ষত-বিক্ষত। হামলার দিন মিছিল নিয়ে এ পাড়ায় ঢোকে আত্রুমনকারীরা। এ পাড়ার একজন বয়োজ্যেষ্ঠ অঞ্জু সরকার। তার বাড়ির পাশেই মন্দির। সেই মন্দিরেও আক্রমণ করা হয়। ভেঙ্গে ফেলা হয় প্রতিমা। অঞ্জু সরকার জানান, ‘পূজার পরদিন দুপুরে বাসায় ফিরে বউকে বললাম ভাত দাও। খুব ক্লান্ত। কলেজ মাঠে তখন প্রায় দশ হাজারের বেশি মানুষের সমাবেশ। তা দেখে আমি কিছুটা ভীতও বটে।’ কিন্তুঅঞ্জু সরকারের ভাত খাওয়ার ফুরসত আর হয়নি । ইতোমধ্যে হাজির আক্রমণকারী মিছিল। তাদের সবার হাতে লাঠি-দা। দরজায় খিল দিয়ে অঞ্জু সরকারের পরিবারের সকলে ঘরে ঢুকে আত্মরক্ষা করেন। তবে প্রতিমাটির শেষ রক্ষা হয়নি। মন্দিরের কিছু সামগ্রীও লুঠ করে আক্রমণকারীরা। মিছিলে অংশ নেয়া বেশিরভাগই তরুণ এবং বহিরাগত। ফলে হামলাকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের মিডিয়ায় নাসিরনগর নিয়ে যতটা উৎকণ্ঠা হরিণবেড় নিয়ে তার কিঞ্চিত পরিমাণেও নেই। অথচ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হরিণবেড় গ্রামের মানুষ। হরিপুর ইউনিয়নে এই গ্রামেই ঘটনার সূত্রপাত। শুক্রবার হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ফেসবুক পাতায় একটি পোস্ট নিয়ে যত তুলকালাম। স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় পরের দিন শনিবার পুলিশ তাকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে গ্রেফতার করে। এখানেই ঘটনার সমাপ্তি হওয়ার কথা। দোষী ব্যক্তিকে (যদিও তার পোস্ট ইচ্ছাকৃত না ষড়যন্ত্র তা এখনও প্রমাণিত হয়নি) আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু নষ্ট রাজনীতিবিদরা ঘটনা এখানেই শেষ করলেন না। বরং প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে তারা ‘সাম্প্রদায়িক কার্ড’ ব্যবহার করলেন। যার নির্মম শিকার নিম্ন আয়ের কিছু পরিবার। ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে হরিণবেড় গ্রামের মহিলারা আগের দিন অর্থাৎ শনিবার রাতেই বসতভিটা ছেড়ে দূরের আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এলাকার পুরুষরা বেশিরভাগ গা-ঢাকা দেন। রবিবার ইটখোলার ট্রাকে হাজার হাজার ধর্মান্ধ জড়ো হতে থাকে হরিপুর ইউনিয়নে। দুপুরের কিছু আগে হামলা শুরু করে হরিণবেড় গ্রামে। জনমানবশূন্য হওয়ার কারণে তারা বসতভিটায় ভাংচুর চালায়। লুট করে জেলেপাড়ার দরিদ্র মানুষের মূল্যবান সামগ্রী। এরপর তারা মিছিল নিয়ে নাসিরনগরের দিকে এগিয়ে যায়। হামলার এক সপ্তাহ পরও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এ গ্রামটি পুরুষশূন্য। তাই ঘাটে বাঁধা সব মাছ ধরার নৌকা অলস পড়ে আছে। জেলেপাড়ার এসব মানুষের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন মাছ ধরা। হামলার সময় তাদের মাছ ধরার বহু জালও পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসব অসহায় নিপীড়িত মানুষকে ছেড়ে ঢাকা ফিরে আসার প্রস্তুতি নিলাম। আকাশ আচ্ছন্ন করা কালো মেঘ ধীরে ধীরে সরতে শুরু করেছে। কিন্তু মানুষগুলোর মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা ভয় কি এত সহজে দুর হবে? এক গভীর সঙ্কট ও অনিশ্চয়তা গ্রাস করে আছে তাদের। পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি উপস্থিতির মাধ্যমে এই সঙ্কট দূর করা সম্ভব নয়, প্রয়োজন কেবল ধর্মীয়, রাজনৈতিক সচেতনতা ও সহমর্মীতা। শত বছর ধরে লালন করা সৌহাদ্য এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে প্রতিষ্ঠা করা। সেই সঙ্গে প্রসাশনের দায়িত্বশীল ভূমিকাও জরুরি। ভার্চুয়াল জগতের সংকট যেন বাস্তব জীবনকে প্রভাবিত না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। দীর্ঘ এক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যূদয়। কেবল নয় মাসে এ দেশের জন্ম হয়নি। দেশ ভাগের পর থেকে একাত্তর, বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে, শত বঞ্চনা সহ্য করে তবেই অর্জন করেছি স্বাধীনতা। বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। এবারও হারবে না বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী বাংলার তরুণদের যে জয়জয়কার তার মতোই জয় করবে রামু এবং হরিণবেড়।
×