ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

৫৪ ও ১৬৭ ধারা নিয়ে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

আসামিকে নির্যাতন নয়, গ্রেফতারের সময় পরিচয় দিতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১১ নভেম্বর ২০১৬

আসামিকে নির্যাতন নয়, গ্রেফতারের সময় পরিচয় দিতে হবে

বিকাশ দত্ত ॥ বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার (৫৪ ধারা) ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ধারা (১৬৭ ধারা) নিয়ে আপীল বিভাগের রায়ের ১৭০ দিন পর বেশ কিছু গাইডলাইন দিয়ে বৃহস্পতিবার ৩৯৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই দুটি ধারা নিয়ে আপীল বিভাগ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট, ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের প্রতি মোট ১৯ দফা গাইডলাইন (নির্দেশনা) দিয়েছেন। এর মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি ১০ দফা আর ট্রাইব্যুনাল, ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারকদের প্রতি ৯ দফা গাইডলাইন দেয়া হয়েছে। কিছু গাইডলাইন আছে আসামিদের সঙ্গে কি ধরনের ব্যবহার করা যাবে, সে বিষয়েও। উল্লেখ্য, ২৪ মে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যবিশিষ্ট আপীল বেঞ্চ হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপীল খারিজ করে দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চে অন্যান্য বিচারপতি ছিলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করবে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা জনকণ্ঠকে বলেছেন, আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে ‘নির্দেশনা আছে বিচারক, ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি। কিছু নির্দেশনা আছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিও। কিছু গাইডলাইন আছে আসামিদের সঙ্গে কি ধরনের ব্যবহার করা যাবে, সে বিষয়েও।’ তিনি বলেন, ‘গাইডলাইনে প্রথমেই বলা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় যারা আছেন, তারা যেন অতি উচ্চমানের দায়-দায়িত্ব পালন করেন। সে বিষয়ে যথাযথ সক্ষমতা তাদের দেখাতে হবে। যাকে গ্রেফতার করা হবে তাদের ক্ষেত্রে যেন মানবাধিকার ক্ষুণœ না হয়। যে আসামিকে ধরা হবে তাকে যেন কোন ধরনের নির্যাতন বা হেয়প্রতিপন্ন করা না হয়। গ্রেফতারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় জানাতে হবে। পছন্দ মতো আইনজীবীর সহায়তা দেয়া। আহত আসামিকে চিকিসা প্রদান করা। তবে দেশে যদি যুদ্ধ থাকে বা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে, জাতীয় নিরাপত্তা যদি বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় অথবা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকে, সে সব পরিস্থিতিকে ব্যতিক্রম হিসেবে ধরা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, কাউকে ১৫ দিনের বেশি রিমান্ড দেয়া যাবে না। আসামি যদি কাস্টডিতে থাকে, যদি আসামিকে শোন এ্যারেস্ট দেখাতে হয়, তাহলে তাকে আদালতে হাজির করতে হবে এবং ডায়রি এনে সেখানে (আদালতকে) শোন এ্যারেস্ট দেখাতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, রায় পুরোপুরি পর্যালোচনা করে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে রিভিউয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’ পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরও বলা হয়েছে, যাকে গ্রেফতার করা হবে তার মেমোরেন্ডাম অব এ্যারেস্ট দেখাতে হবে এবং তাতে তার স্বাক্ষর নিতে হবে। পাশাপাশি কখন কোথায় কিভাবে তাকে এ্যারেস্ট করা হয়েছে সে সব বিষয় উল্লেখ থাকতে হবে তাতে। এছাড়া কাউকে এ্যারেস্ট করা হলে তার নিকট আত্মীয়, নিকটাত্মীয় না থাকলে তার বন্ধুকে অবশ্যই ১২ ঘণ্টার মধ্যে জানাতে হবে। আরেকটা বিশেষ নির্দেশনা হলো; বিশেষ ক্ষমতা আইনে কাউকে যদি ডিটেনশনে নেয়া হয় তাহলে তাকে ৫৪ ধারায় এ্যারেস্ট করা যাবে না। এছাড়া কাউকে ১৫ দিনের বেশি রিমান্ড দেয়া যাবে না। আসামি যদি কাস্টডিতে থাকে, যদি আসামিকে শোন এ্যারেস্ট দেখাতে হয়, তাহলে তাকে আদালতে হাজির করতে হবে এবং ডায়রি এনে সেখানে (আদালতকে) শোন এ্যারেস্ট দেখাতে হবে। অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা জনকণ্ঠকে আরও বলেন, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার ও রিমান্ড বিষয়ে আপীলের রায়ে হাইকোর্টের রায়টি মোডিফাই করে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বেশ কিছু গাইডলাইন দেয়া হয়েছে। এর আগে হাইকোর্টের রায়ে ১৫ দফা নির্দেশনা ও সাতটি সুপারিশ করা হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপীল করলে আপীল বিভাগ সেই আপীল খারিজ করে দেন। ফলে হাইকোর্টের রায়ই বহাল রয়েছে। ব্লাস্ট সূত্রে জানা গেছে, এ মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় সন্দেহবশত বিনা পরোয়ানায় কাউকে গ্রেফতার এবং ১৬৭ ধারায় অধিকতর তদন্তের নামে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ফলে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু ঘটানোর সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের করা হয়। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ছাড়াও, আইন সালিশ কেন্দ্র, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন এবং আরও কতিপয় ব্যক্তি ছিলেন ওই রিটে দায়েরকারীর মধ্যে। ওই রিটে আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের মহাপুলিশ পরিদর্শক, সহকারী পুলিশ সুপারসহ ৫ জনকে বিবাদী করে এ পিটিশন দায়ের করা হয়। রিট পিটিশনে গ্রেফতার ও তদন্ত সংক্রান্ত প্রচলিত আইন ও সাংবিধানিক বিধি বিধান (অনুচ্ছেদ ২৭, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৫) যথাযথভাবে পালন এবং গ্রেফতারের পর আসামিকে আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগদানের জন্য আবেদন করা হয়। হাইকোর্ট ১৯৯৮ সালের ২৯ নবেম্বর সন্দেহবশত কাউকে গ্রেফতার এবং তদন্তের নামে রিমান্ডে এনে আসামিকে শারীরিক নির্যাতন করা থেকে নির্বৃত্ত করার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, সে ব্যাপারে সরকারের ওপর রুলনিশি জারি করেন। রুলের শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল বিচারপতি মোঃ হামিদুল হক এবং বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের জন্য এক যুগান্তকারী রায় প্রদান করেন। উক্ত রায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও ১৬৭ ধারায় রিমান্ডে নিয়ে প্রচলিত বিধান পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে সংশোধন করার জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেন। পাশাপাশি এই ধারাগুলো সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত রায় ঘোষণার পর থেকেই সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও কর্তৃপক্ষকে ১৫ দফা নির্দেশনা মেনে চলতে নির্দেশ দেন। ২০০৪ সালে আপীল বিভাগ সরকারের লিভ টু আপীল (আপীলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) মঞ্জুর করেন। হাইকোর্টের রায় কার্যকর রেখে আপীল বিভাগ আইন সংশোধন করতে হাইকোর্ট কোন নির্দেশ দিতে পারেন কিনা সে বিষটি শুনানির জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। এরপর ২০০৭, ২০০৮ ও ২০১০ কার্যতালিকায় আসে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ২২ মার্চ আপীল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়। দুই কার্যদিবস শুনানি করে গত ১৭ মে আদালত রায়ের জন্য ২৪ মে দিন ঠিক করে দেয়। ২৪ মে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যবিশিষ্ট আপীল বেঞ্চ বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার (৫৪ ধারা) ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ধারা (১৬৭ ধারা) সংশোধনে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপীল খারিজ করে দেন। কিছু সংশোধন সাপেক্ষে হাইকোর্টের রায়ই আপীল বিভাগ বহাল রাখেন। পুলিশ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের ভিত্তিতে যে কোন ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারে। যদিও যুক্তিসঙ্গত এর কোন ব্যাখ্যা নেই। এর ফলে এ ধারায় কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের নিয়ন্ত্রণহীন (ঁহভবঃঃবৎফ) ক্ষমতা প্রয়োগ করে। যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপব্যবহার করে থাকে। ক্ষমতার অপব্যবহার সবচেয়ে বেশি দেখা যায় যখন কোন ব্যক্তিকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ ধারায় নিবর্তনমূলক আটক (ঢ়ৎবাবহঃরাব ফবঃবহঃরড়হ) আদেশ প্রদান করা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ব্যতীত আরও কয়েকটি ধারায় পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে। সেগুলো হলো ৫৫, ১৫০, ১৫২ ও ১৫৫ ধারায় পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারে। পুলিশ রংপুর মেট্রোপলিটন এলাকা ব্যতীত অন্য সকল মেট্রোপলিটন এলাকায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫, ১৫০, ১৫২ ও ১৫৫ প্রয়োগের পাশাপাশি মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশও প্রয়োগ করতে পারে। এছাড়াও পুলিশ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারে। এছাড়া পুলিশ ১৬৭ ধারায় অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়ে থাকে। আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের মতে রিমান্ড প্রয়োজনীয়, কারণ জরুরী তথ্য বের করা, তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন করা, মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি, দাগী অপরাধীর কাছ থেকে তথ্য বের করা কৌশলে জিজ্ঞাসাবাদে বড় ধরনের অপরাধীর সূত্র পাওয়া এবং অজ্ঞাত পরিচয়ের অপরাধীর প্রকৃত পরিচয় জানার জন্য। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা ঔপনেবেশিক আমলের আইন যা ১৮৬০ সালে লর্ড ম্যাকুলে প্রবর্তন করেন।
×