ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হারুন হাবীব

একাশি বছরের তরুণ ভ্রাতা

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১১ নভেম্বর ২০১৬

একাশি বছরের তরুণ ভ্রাতা

মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে ১৯৭২-এর জানুয়ারি মাসেই যোগ দিয়েছি সেদিনকার বিপিআই বার্তা সংস্থায়। সালেহ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ করে আবারও যোগ দিয়েছেন তাঁর পুরনো পত্রিকায়। পত্রিকাটির নতুন নাম দৈনিক বাংলা। শ্রদ্ধেয় তোয়াব খান স্বাধীনতার আগে ছিলেন দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদক। স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলার সম্পাদক। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করেই সালেহ ভাই ঢাকা ছাড়েন ১৯৭১-এ। সম্ভবত তোয়াব ভাই ঢাকা ছাড়েন তারও কিছুদিন পর এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। সরাসরি যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন এমন সাংবাদিকের সংখ্যা হাতে গোনা। কিন্তু সালেহ চৌধুরী কলম ছেড়ে অস্ত্র ধরেন। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে যুক্ত করেন অসীম আন্তরিকতায়। যদ্দুর মনে পড়ে, সদ্য-স্বাধীন দেশের নতুন সংবাদকর্মী হিসেবে ঝাঁকড়া চুল, দবেজ শরীরের অগ্রজ সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীকে আলাদা চোখে দেখতে থাকি আমি। নিজস্ব স্টাইল- যেখানেই যান হাতে একটা সুদর্শন ছড়ি। বহুকালের অভ্যেস তাঁর। পুরানা পল্টনের দৈনিক পাকিস্তান- দৈনিক বাংলা অফিস থেকে ছড়ি হাতে দ্রুত হাঁটেন প্রেসক্লাবের দিকে। রিক্সায় চড়েন কম। দেখা হলেই বলেন- হাবীব, ভাল আছ? আমি মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের একজন, সালেহ ভাই জানেন। আরও জানেন রণাঙ্গনের সাংবাদিকতাও করতে হয়েছে আমাকে। বলাই বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধের টান কাজ করেছে স্বাভাবিকভাবে দু’জনের মধ্যে, যা কাউকে দূরে সরে যেতে দেয়নি। সেই সালেহ ভাইয়ের ৮১তম জন্মদিন। জন্মদিনে এই অগ্রজকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাই। সম্পর্কের ৪৫ বছর গেছে এরই মধ্যে। আমি নিজেও ’৭০-এর কাছাকাছি। কিন্তু সালেহ ভাই আশি পেরিয়ে একাশি। ফারাক বছর দশ-এগারো বছরের মাত্র। তবে বয়সের এই ফারাক বন্ধুত্বে বাদ সাধেনি। অবলীলায় গল্প করি আমরা এখনও। রসগল্পে সালেহ ভাই তুখোড়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে নানান গল্প মিলিয়ে রীতিমতো আসর জমান। মিরপুরের সাংবাদিক পল্লীতে একটা বাড়ি আছে সালেহ ভাইয়ের। এক সময় থাকতেন। আমিও সেখানেই। সেই সুবাদে অনেক বছর নিয়মিত আড্ডা দিয়েছি আমি, সালেহ চৌধুরী আর গুণী চিত্রশিল্পী আমার আরেক অগ্রজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন। এরপর ছেলে, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে থাকবেন বলে অধিকতর ভাল জায়গায় বাড়ি নিয়েছেন তিনি। ২০০১ সালের জোট সরকার বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা থেকে আমাকে চাকরিচ্যুত করার পর কী করব ভাবছিলাম। অমন একটা পরিস্থিতিতে কিই বা করা যায়। তবু একটা ফিচার সার্ভিস শুরু করেছিলাম। চালিয়েছিলামও বেশ কয়েক বছর। সালেহ ভাই ছিলেন তার অন্যতম চালিকাশক্তি। অসাধারণ হাত তাঁর অনুবাদে। অসামান্য বুদ্ধিদীপ্ত, সৃজনশীল ও সাহসী মানুষ সালেহ চৌধুরী। একসময় কবিতা লিখতেন। ছবি আঁকতেন। পত্রপত্রিকার জন্য কার্টুন আঁকতেন একসময়। এখন ওসব নেই। কেন নেই তা তিনিই জানবেন। শিশুদের জন্য ছড়া লিখেছেন। অতি সম্প্রতি বেরিয়েছে ‘নরওয়ের রূপকথা’। দাবার সঙ্গে তাঁর আজীবন সখ্য। খেলতেন না কেবল, দাবারু বানাতেনও। গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদকে গড়ে তুলতে তাঁর ভূমিকা অনেকেরই জানা। দৈনিক বাংলায় দীর্ঘকাল ফিচার বিভাগ দেখতেন। কবি আহসান হাবীবের সম্পাদনায় দৈনিক বাংলার সেই বিভাগটি সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান আশ্রয় হয়েছিল সেই সময়। কবি শামসুর রাহমানের বহু বছরের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন সালেহ ভাই। রাহমান ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা মারতে আমাকেও তাঁর বাড়িতে নিয়েছেন অনেকবার। জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তাঁর সখ্য আজীবনের। আমার জানা মতে, প্রয়াত হুমায়ূনের ওপর অনেক বই তিনি সম্পাদনা করেছেন। বলতে গেলে গোটা জীবনই সাংবাদিকতা আর শিল্পসাহিত্যের ভুবনে ডুবে আছেন তিনি। এখনও লেখালেখিতেই। এখনও হাঁটেন দ্রুত। সকলের সঙ্গে হেসে কথা বলেন। তবে আমার এই একাশি বছরের ভ্রাতা একটু রগচটা বটে, কত বখাটে ছেলেছোকড়ার পিঠে যে ওর ছড়ি ভেঙ্গেছে- তার ইয়ত্তা নেই। অবলীলায় ছড়ি চালাতে পারেন তিনি- পরে কি হবে না ভেবেই। কিন্তু সালেহ চৌধুরী যে কত হৃদয়বান তা আমি জানি। আমার মতোই সালেহ ভাই নেশাগ্রস্ত মুক্তিযুদ্ধে। একাত্তরে সুনামগঞ্জের দিরাই, শাল্লা, জগন্নাথপুর এবং নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ির হাওড় অঞ্চলে ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্র। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ১৯৭১। আমারও যেমন। দু’জনে যখন একসঙ্গে বসি, স্মৃতি রোমন্থন করি একাত্তরের রণাঙ্গনের। ১৯৭৫-এর পর পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধকে অবদমন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক মহলকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সালেহ ভাই ও আমি সেই অবাঞ্ছিত ধারার বিরুদ্ধাচরণ করেছি। কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধা তাঁর একাত্তরের স্মৃতি আজও লেখেননি- যা তাঁর বড় অপরাধ। দেখা হলেই বলি, দেরি করছেন কেন? কাজটা শেষ করুন, সময় তো পেরিয়ে যাচ্ছে। সিগারেটে একটা টান দিয়ে হেসে উত্তর দেন- এত তাড়াতাড়ি মরলে কি চলে, মাত্র তো আশি বছর। হয়ত লিখবেন, হয়ত লিখবেন না। তবে এই বীর সহযোদ্ধার স্মৃতি লিপিবদ্ধ হওয়া দরকার। নিজেরসহ অন্য কারও জন্মদিন মনে থাকে না আমার। তবে আমার সন্তানদের ঘরে সন্তান আসার পর সেই দিন-তারিখ বেশ মনে থাকে। সে কারণে সালেহ ভাইয়ের জন্মদিনও ভুলে যাই। গত বছর এই দিনে হঠাৎ ফোন পেলাম- হাবীব, আজ কিন্তু আমি আশি। প্রথমে হকচকিয়ে যাই। ভাবি আজ তো সালেহ ভাই আসেনইনি, তাহলে আসি আসি বলছেন কেন! একটু পর একগাল হেসে বললেন, তুমি কোন্ আসি মনে করেছ হাবীব, বানানটা কিন্তু তালি প্প্ শ’ দিয়ে হবে! সেদিনকার পশ্চিম পাকিস্তানে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন সালেহ চৌধুরী। বেশ কয়েক বছর ছিলেন পাঞ্জাবের বিশ্ববিদ্যালয়ে। বন্ধুবান্ধবও প্রচুর। এরপরও বাঙালীদের প্রতি ওখানকার বিদ্বেষ তিনি বিলক্ষণ জানেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত আওয়াজ পত্রিকায় কাজ করেছেন। অসংখ্য ফিচার- প্রবন্ধ লিখেছেন সারাজীবন। আজ যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে অপরাজেয় বাংলা দাঁড়িয়ে আছে, তার স্রষ্টা শিল্পী আব্দুল্লাহ খালেদের সঙ্গে দিনের পর দিন সময় দিয়েছেন তিনি অসাধারণ সেই স্থাপত্য নির্মাণে। বয়সে ছোট বলে আমি তাঁর যৌবন দেখিনি। তবে ছবি দেখে বুঝি, অসামান্য তারুণ্য তাঁকে বর দিয়েছিল। এতই প্রেমিক যে নিজ হাতে এক অসামান্য প্রতিকৃতি তৈরি করেছেন তাঁর স্ত্রীর। মাটির তৈরি সে এক অসামান্য শিল্পকলা- যা তাঁর আয়ত্তের বাইরে নয়। একাশিতম জন্মদিনে এই অগ্রজ সাংবাদিক ও একাত্তরের সহযোদ্ধার সুস্বাস্থ্য কামনা করি। আমার এই একাশি বছরের তরুণ ভ্রাতার আরও দীর্ঘজীবন কামনা করি। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও কথাসাহিত্যিক
×