ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

শিশুদের উপযোগী বই প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৪:১২, ১১ নভেম্বর ২০১৬

শিশুদের উপযোগী বই প্রয়োজন

শিশুদের মনস্তত্ত্ব ও আনন্দঘন পরিবেশে পাঠদানের ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে বই। গত সাড়ে সাত বছরে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য সরকার নানাবিধ কার্যক্রম তৈরি করেছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করা, যুগোপযোগী শিক্ষা প্রদানের জন্য ডিজিটাল সিস্টেম প্রবর্তনের চেষ্টাকরণ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালুকরণ, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরির প্রয়াস নিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাকে উন্নীত করতে পারলে পঞ্চম শ্রেণীতে যে সম্মিলিতভাবে পরীক্ষা হচ্ছে সেটি বাতিল হয়ে স্কুলভিত্তিক বার্ষিক পরীক্ষা হবে। প্রাইমারীতে ড্রপ আউটের পরিমাণ কমে গেছে। সরকার মুক্তিযুদ্ধ চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পড়াশোনার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। অথচ যারা শিশুদের জন্য বই প্রণয়ন করছেন তাদের দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করা উচিত। কয়দিন ধরে প্রাইমারী পর্যায়ের প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণীর বইগুলো দেখছিলাম। বাংলা বই দেখতে গিয়ে একটু অবাকই হলাম। প্রথম শ্রেণীর বাংলা বইয়ের কথা ধরা যাক। বইয়ের শুরুতে জাতীয় পতাকা দেয়া হয়েছে এবং জাতীয় পতাকা ভবনে ব্যবহারের জন্য দেয়া হয়েছে। উল্টো পিঠে জাতীয় সঙ্গীত দেয়া হয়েছে, যা যথাযথ। তবে প্রসঙ্গ কথা এবং পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার সম্পর্কে নির্দেশিকা উক্ত বইয়ে দেয়া যথাযথ হয়নি। পাঠ-১-এ চিত্র সুস্পষ্ট নয় এবং বাচ্চাদের বোধগম্য হবে না। পাঠ-২ বাচ্চাদের উপযুক্ত নয়। সহপাঠীদের সঙ্গে পরিচিত হই এবং পাঠ-৩ ছোটদের প্রথমদিকে দেয়া যুক্তিযুক্ত নয়। পাঠ-৪-এ ডালিম গাছটি মানানসই হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। পাঠ-৫-এর দৃশ্য সুস্পষ্ট হওয়া দরকার। পাঠ-৯তে উটের দৃশ্য দেখানো হয়েছে, যা আসলে আমাদের দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। সাগরের ছবিটিও সুস্পষ্ট হওয়া দরকার। বর্তমানে ঐরাবত কয়জন ব্যবহার করে থাকে? স্বরবর্ণ পাঠ-১৩তে দেয়া হয়েছে। এটি পাঠ-১-এ দেয়া যেত। পৃষ্ঠা ২৪ ও ২৫-এ চরণ ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ ইদানীং এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করা উচিত নয়। ডাবের ছবিটিও সুস্পষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। পৃষ্ঠা ২৮-এ যে ভালুকের ছবি দেয়া হয়েছে তা আসলেই বাস্তবসম্মত নয়। একই অবস্থা পৃষ্ঠা ৩০-এ। পাঠ-২৯-এ দেয়া হয়েছে ব্যঞ্জনবর্ণ। এটি পাঠ-২তে দেয়া গেলে ভাল হতো। পাঠ-৩৭-এ বৃষ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ইদানীং কি এ শব্দটি সচরাচর ব্যবহার করা হয়? পাঠ-৪৫-এর বক্তব্য আরও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যেত। পৃষ্ঠা ৬৫তে ব্যবহৃত মোষের ছবিটি মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় প্রথম শ্রেণীতে যুক্তবর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে ছয় বছরের বাচ্চাকে যুক্তবর্ণ শেখানোর যৌক্তিকতা কোথায়? পাঠ-৫৫তে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শিরোনামে আরও সুস্পষ্ট করে জাতীয় ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, বঙ্গবন্ধুর রঙিন ছবি, বাংলাদেশের মানচিত্র, পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রাজাকারদের কথা উল্লেখ করা উচিত ছিল। পাঠ-৫৬-এ শব্দ বলার খেলাটি সুস্পষ্ট হওয়া উচিত ছিল। প্রথম শ্রেণীর বই আকর্ষণীয় হওয়া উচিত ছিল। এ পর্যায়ে খেলতে খেলতে মাতৃভাষা শেখার ব্যবস্থা করা দরকার। দ্বিতীয় শ্রেণীর বাংলা বইতে প্রসঙ্গ কথা, পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়ার প্রয়োজন ছিল না। আগের পাঠ থেকে জেনে নিই ছবিটি সুস্পষ্ট নয়। পৃষ্ঠা ৭-এ বাঘ ও হরিণের ছবি এক ধরনের বিকৃত করা হয়েছে। পৃষ্ঠা ২৩-এর প্রশ্ন ১ এবং ২ নম্বরে অঙ্ক লেখানোর প্রয়াস পৃথক করে না নিলে ভাল হতো। দুখুর ছেলেবেলা অনেকটা এলোমেলোভাবে লেখা এবং লেখকের নাম নেই। এটি জাতীয় কবির প্রতি অবজ্ঞাস্বরূপ। খামারবাড়ির পশু-পাখি প্রবন্ধে এত বেশি পশু-পাখির নাম দেয়া হয়েছে যা মোটেই বাচ্চাদের পক্ষে হজমযোগ্য নয়। ছয় ঋতুর দেশ আরও সহজ করা বাঞ্ছনীয়। মুক্তিযুদ্ধের একটি সোনালী পাতা আরও সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় বর্ণনা এবং ছবিগুলো সুস্পষ্ট করা যেত। ক্লাস-২তে শব্দের অর্থ জেনে নেই-এর প্রয়োজন নেই। বরং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দেয়া বাঞ্ছনীয়। এ দেশটি মুসলমান-হিন্দু-খ্রীস্টান-বৌদ্ধদের সম্মিলিতভাবে গড়ে ওঠা একটি রাষ্ট্রÑ এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ থাকলে ভাল হতো। তৃতীয় শ্রেণীর বইতেও প্রসঙ্গ কথা এবং নির্দেশনা থাকা উচিত ছিল না। ছবি ও কথা (পৃ. ১-৪) কোন ছবিই স্পষ্ট নয়। ভাষা শহীদদের কথায় সুচতুরভাবে জিন্নাহ ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের কথা তোলা হয়নি। ভাষা শহীদদের ছবি স্পষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। রণসঙ্গীত হিসেবে ‘চল্ চল্ চল্’ গাওয়ার কথা সেটির উল্লেখ থাকা উচিত ছিল। পৃষ্ঠা ২৬-এ ‘স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে’ লেখায় অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি যে, ২৬শে মার্চ ১৯৭১ স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া, পাকিস্তানী রাজাকারদের অত্যাচার সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। মনে হয় পঁচাত্তরের প্রেতাত্মাদের কেউ এটি লিখেছে। কুঁজো বুড়ি গল্পটি বাদ দেয়া গেলে ভাল হয়। ‘একাই একটি দুর্গ’ লেখাটি অনেক বেশি গুছিয়ে লেখা উচিত ছিল। পৃ ৭২-এ ‘একজন পটুয়ার কথা’ এটি তৃতীয় শ্রেণীর উপযোগী করে লিখা উচিত। যে গদ্য কবিতাটি আছে তা বর্জন করা যেত। চতুর্থ শ্রেণীর বইতে দশ বছরের শিশুকে ‘বাংলাদেশের প্রকৃতি’ প্রবন্ধটিকে আরও সুন্দর ও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা উচিত ছিল। অনুশীলনীর প্রশ্ন ৫, ৭ মোটেই শ্রেণীর উপযুক্ত নয়। পৃষ্ঠা ১৫-এর ছবিটি স্পষ্ট হয়নি। ‘বীরশ্রেষ্ঠ বীরগাথা’ প্রবন্ধে বীরশ্রেষ্ঠদের ছবি সুস্পষ্ট হওয়া উচিত। পৃষ্ঠা ৩১-এ প্রশ্ন ৬-এর ছবিটি স্পষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে লেখার জন্য কিছু ইঙ্গিত দেয়া হলে ভাল হতো। মহীয়সী রোকেয়া প্রবন্ধটিতে ছবিটি অস্পষ্ট। প্রবন্ধটি সুপঠিত হতে পারত। পাঠান মুলুকের বদলে সৈয়দ মুজতবা আলীর আরও আকর্ষণীয় ও বর্তমান সময় উপযোগী প্রবন্ধ দেয়া যেত। ‘শব্দের অর্থ জেনে নেই’ এ পর্যায়ে না দেয়াই উচিত। শুদ্ধভাবে মাতৃভাষা চর্চার ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু মানসিক চাপ সৃষ্টি করে শিশু মনকে কষ্ট দেয়া হচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণীতে এ প্রসঙ্গ কথা ও পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার সম্পর্কে নির্দেশনা না থাকলেই ভাল হয়। ‘এই দেশ এই মানুষ’ প্রবন্ধে আরও সুন্দরভাবে দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা, বিশ্বাস, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি সম্পর্কে লেখা দরকার। পাশাপাশি কিভাবে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হয় সে সম্পর্কে আলোচনা থাকা উচিত। সাধু-কথ্যের মিশ্রণ দূষণীয়। সংকল্প কবিতাটি সংক্ষেপিত না করে সবটুকু দেয়া দরকার। কবিতাটির মূলভাব সহজ করা বাঞ্ছনীয়। সুন্দরবনে প্রাণী প্রবন্ধটি আরও সুন্দরভাবে সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রাণীর বর্ণনা সহজভাবে দেয়া উচিত। চতুর্থ শ্রেণীর বইও তৃতীয় শ্রেণীর বইয়ের মতো ১০ বছর বয়সের বাচ্চাদের উপযোগী নয়। উদাহরণস্বরূপ পৃষ্ঠা ৪২-এর কথা বলা যায়। কাগজের ঠোঙ্গা তৈরি এটি শ্রেণীকক্ষে বা ল্যাব তৈরির ব্যবস্থা থাকা দরকার। পৃষ্ঠা ৫৯ তে রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। আবহাওয়া ও জলবায়ু অধ্যায়টি আরও সহজ করে লেখা উচিত ছিল। পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক বিজ্ঞান বইগুলোও আগের থেকে ব্যতিক্রম নয়। কোন ছবিই স্পষ্ট নয়। পরিবেশ দূষণ অধ্যায়ের পৃষ্ঠা ৯-এ যে পর্যবেক্ষণ ফরম দেয়া আছে তা ল্যাবের ভিত্তিতে দিলে ভাল হতো। গ্লাসের গায়ে পানির বিন্দু এবং বায়ুতে পানি আছে তাও ল্যাবের ভিত্তিতে দিতে হবে। বায়ুপ্রবাহ কিভাবে কাজ করে তাও ল্যাবের ভিত্তিতে দিতে হবে। শক্তির রূপ যেভাবে আলোচনা করা হয়েছে তা বোধগম্য নয়। বইটি অষ্টম শ্রেণীর উপযোগী হয়েছে। বিজ্ঞানচর্চা কত কঠিন করা যায় তার অবৈজ্ঞানিক চর্চা হয়েছে। এ ব্যাপারে নাগরিক সমাজ একটি ভাল উদ্যোগ নিতে পারে। শিশু মনের বিকাশে ভীতির সঞ্চার রোধ করা উচিত। জননেত্রী যে শিক্ষার গুণগতমান চাচ্ছেন তার জন্য সর্বাগ্রে বইগুলোর সংস্কার সাধন করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সবাইকে সহজ হতে হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ [email protected])
×