ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে সন্ত্রাসবাদ নেই

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১১ নভেম্বর ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে সন্ত্রাসবাদ নেই

দ্বিতীয় পর্ব ১০৯০ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের আলামুত পর্বত চূড়ায় ঘাঁটি স্থাপন করে হাসান আল সাবাহ গুপ্তঘাতক ভ্রাতৃ সংঘ নামে একটি সংগঠন তৈরি করে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়। তাদের মুখেও ইসলামের কথা ছিল। তারা হিংসাত্মক ও জিঘাংসামূলক কার্যকলাপ চালিয়ে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে। ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে হালাকু খাঁ এই উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী দলকে সমূলে উৎখাত করেন। যুগে যুগে যে সব অপশক্তি ইসলামের নামে, ইসলাম কায়েমের নামে ইসলামের ক্ষতিসাধন করার চেষ্টা করেছে এবং সেই সব অপশক্তি আজও রয়েছে। এরা ইসলামের প্রধান শত্রু। এরা মুনাফিক, এরা ভ- ও প্রতারক। কুরআন মজিদে মুনাফিকদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় ইরশাদ হয়েছে। মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা বলে: আমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী। কিন্তু তারা বিশ্বাসী নয়। আল্লাহ ও মুমিনদের তারা প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে নিজেদের সঙ্গেই নিজেরা প্রতারণা করে তা তারা বুঝে উঠতে পারে না। (সূরা বাকারা : আয়াত ৮-৯) তাদের (মুনাফিকদের) যখন বলা হয় পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কর না। তারা বলে আমরাই তো শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! ওরাই অশান্তি সৃষ্টিকারী। (সূরা বাকারা : আয়াত ১১-১২) প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ (স.) ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ৯ জিলহজ বিদায় হজের ভাষণে লা ইকরাহা ফিদ্দীন ধর্মে কোন জোরজবরদস্তি নেই কুরআন মজীদের এই আয়াতে কারিমা তিলাওয়াত করে সমবেত সকলকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন। তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেও তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। লা ইকরাহা ফিদ্্দীন কুরআন মজীদের এই বাণীর মাধ্যমে ধর্মের ব্যাপারে জোরজবরদস্তি করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলাম জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্্ বা কিতাল এর যে বিধান রয়েছে সেটা আত্মরক্ষার জন্য, সন্ত্রাস সৃষ্টি করা বা অন্যায় যুদ্ধ করার জন্য নয়। জিহাদ মূলত সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী বা ফিতনা ফ্যাসাদকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে বোঝায়। জিহাদের মূল অর্থ চেষ্টা, পরিশ্রম, অধ্যবসায়। জিহাদ শব্দমূল জুহদ-এর অর্থের সঙ্গে অস্ত্রযুদ্ধের কোনই সম্পর্ক নেই। আল্লাহু জাল্লা শানহু ইরশাদ করেন : যারা আমার জন্য কঠিন পরিশ্রম করে আমি তাদের অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব (সূরা আনকাবুত : আয়াত ৬৯) তাই তো আমরা দেখতে পাই নফ্্স বা প্রবৃত্তির সঙ্গে অবিরত লড়াই করবার জন্য নফ্সকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য ইলমে তাসাওফে রিয়াযত ও জুহদের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তরিকত অনুযায়ী রিয়াযত ও মুজাহাদর মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির বিশেষ অনুশীলন ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নফ্সের সঙ্গে জিহাদ করাকে বলেছেন জিহাদুল আকবার বা বড় যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মাধ্যমে রিপুসমূহকে কঠোরভাবে দমন করা যায়। বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে সপ্তম শতাব্দীর দুই/এক বছর আগে বা পর থেকে। মূলত এখানে ইসলাম প্রচার করেন পীর ওলিগণ। তাঁরা মানুষের সামনে ইসলামের শান্তি সৌকর্য তুলে ধরেছেন। মানুষকে প্রেমের পরশে আবদ্ধ করেছেন, মানুষকে ভালবাসা দিয়ে আপন করে নিয়েছেন। সৌভ্রাতৃত্বের ও মৈত্রীর বাণী প্রচার করেছেন। শ্রেণী বৈষম্যের নিগড় থেকে মানবতাকে উদ্ধার করেছেন। তওহীদ ও রিসালাতের আলোয় সবাইকে উদ্ভাসিত করেছেন। যার ফলে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তাঁরা হয়ে উঠেছেন শ্রদ্ধাভাজন। আজও ওলী আল্লাহগণের মাজার শরীফ জিয়ারত করে মানুষ অন্তরে শান্তি পায়, ফায়দা হাসিল করে। অথচ একশ্রেণীর বিপথগামী মানুষ যখন ওলী আল্লাহর মাজার শরীফ জিয়ারত করতে নিষেধ করে, মাজার প্রাঙ্গণে বোমাবাজি করতে কুণ্ঠাবোধ করে না, বোমা ফাটিয়ে মানুষ মারে তখন তাদের অমানুষ বলা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। তারা ইসলামের শত্রু, মানবতার শত্রু। ইসলামে যে কিতাল বা সশস্ত্র যুদ্ধের বিধান আছে সেটা আদৌ মানুষ হত্যা করার জন্য নয়, এই কিতাল বিধান আত্মরক্ষার জন্য। আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য, কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে: যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, কিন্তু সীমা লঙ্ঘন কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহু সীমা লঙ্ঘনকারীদের ভালবাসেন না। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৯০) সশস্ত্র যুদ্ধ (কিতাল)-এর অনুমতি দেয়া হলো তাদের যারা আক্রান্ত হয়েছে। (সূরা হজ : আয়াত ৩৯) যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে, অরাজকতা, দাঙ্গা হাঙ্গামা সৃষ্টি করে তারা মুসলিম থাকে না। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে সাম্প্রদায়িকতার দিকে আহ্বান করে সে আমার দলভুক্ত নয়। যে সাম্প্রদায়িকতার দাঙ্গা করে সে আমার দলভুক্ত নয়, যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করতে করতে মারা যায় সে আমার দলভুক্ত নয় (আবু দাউদ, মিশকাত শরীফ) ইসলাম বিনা বিচারে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করাকে যেমনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে তেমনি আত্মহত্যা করাকেও নিষিদ্ধ করেছে। এ সবই কবিরা গুনাহ- মহাপাপ। ইসলামে সন্ত্রাসবাদের কোন স্থান নেই। যারা সন্ত্রাসবাদী তারা শয়তানের দলভুক্ত। তাদের কোন অবস্থানেই ইসলামী অভিধায় অভিহিত করা আদৌ সমীচীন হবে না। বরং তারা বাতিল ফিরকা, তারা ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত অভিশপ্ত খারেজিদের নয়া সংস্করণ। ইসলাম মানুষকে মধ্যপন্থা অবলম্বনের শিক্ষা দেয়। উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা প্রভৃতির সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক কোন দিনই ছিল না। আজও থাকতে পারে না। যারা সন্ত্রাসী কর্মকা- করে তারা কোন অপশক্তির ক্রীড়ানক হিসেবে যে কাজ করে তার অনেক দৃষ্টান্ত ইতিহাসে রয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে কেউ সফলতা অর্জন করতে পারে না এবং নিজেদের কবিরা গুনাহর পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত করে। তারা সর্বকালের ধিকৃত হয়েছে আজও ধিকৃত হচ্ছে। লা ইকরাহা ফিদ্্দীন ধর্মে কোন জোরজবরদস্তি নেই- কুরআনের এই নির্দেশ ও নীতির আলোক ধারাই বিশ্বকে আলোকিত করেছে, শান্তির দুনিয়া গড়বার প্রেরণা যুগিয়ে আসছে। একমাত্র ইসলামই পারে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×