ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এখনও কেউ গেস্খফতার হয়নি মধুবাগের এই হত্যাকাণ্ডে

অর্থ লেনদেনে ভাইবোনের দ্বন্দ্বে খুন হলো ডলি রানী বণিক!

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১০ নভেম্বর ২০১৬

অর্থ লেনদেনে ভাইবোনের দ্বন্দ্বে খুন হলো ডলি রানী বণিক!

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ডলি রানী বণিক। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়। হত্যাকারীরা বাসা থেকে কিছুই নেয়নি। এমনকি নিহতের শরীরে থাকা স্বর্ণালঙ্কারও না। অর্থ লেনদেনের সূত্র ধরে ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে। বেশকিছু দিন ধরে নিহতের সঙ্গে তার বড় ভাইয়ের নানা বিষয়ে ঝামেলা চলছিল। ঘটনার অন্তত পনেরো দিন আগ থেকেই হত্যার হুমকি পাচ্ছিলেন তিনি। বেশ কয়েক দিন ধরে তার বাসায় রেকি করা হয়। হত্যাকারীরা নিহতের পূর্ব পরিচিত বলে অনেকটাই নিশ্চিত তদন্তকারী সংস্থাগুলো। এ ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হয়নি। তবে অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এমনকি বুধবার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ এ ঘটনায় কোন মামলা হয়নি। মরদেহের সৎকারের পর নিহতের পরিবারের তরফ থেকে মামলা দায়েরের কথা রয়েছে। মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর রমনা থানাধীন মধুবাগের উদ্দীপন গলির ১০/ই/৮ নম্বর চারতলা বাড়ির চতুর্থ তলার পূর্বপাশের দুই কক্ষের একটি ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে খুন হন ডলি রানী বণিক (৪৬)। রাত একটার দিকে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায়। নিহতের পরিবার ও বাড়ির বাসিন্দারা জানান, হত্যাকা-ের সময় ডলি রানী একাই ফ্ল্যাটে ছিলেন। বড় ছেলে জুয়েল বণিক রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ছোট ছেলে দীপ্ত বণিক এবার নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অপেক্ষা করছে। একমাত্র মেয়ে ঝুমা বণিক ভারত প্রবাসী। ঘটনার সময় দুই ছেলেই বাসার বাইরে ছিল। নিহতের পিতার বাড়ি নরসিংদী জেলার মাধবী থানা এলাকায়। শ্বশুরবাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলায়। সরজমিনে দেখা গেছে, ডলি রানীর ফ্ল্যাটের ঠিক সামনের ফ্ল্যাটে বাড়ির মালিকের বড় ছেলে রাকিব হাসান সস্ত্রীক বসবাস করেন। আর নিহত ডলির ফ্ল্যাটের সামনের কক্ষটি ড্রয়িংরুম হিসেবে বাড়ির মালিক ব্যবহার করেন। রাকিবের স্ত্রী জানান, তিনি ঘটনার সময় বাড়িতেই ছিলেন। তিনি কোন কান্নাকাটি বা মারধর বা ধস্তাধস্তির শব্দ শুনেননি। তিনি বাড়িতে থাকলেও তাকে পারিবারিক কাজে সব সময়ই তৃতীয় তলা ও চতুর্থ তলায় হরহামেশাই যাতায়াত করতে হয়। তৃতীয় তলায় তার শাশুড়ি বসবাস করেন। এছাড়া তিনি সন্তান সম্ভবা হওয়ায় সবসময় সাবধানে থাকতে হয়। ফলে অনেক কিছুই খেয়াল করে ওঠা হয় না। বাড়িতে তিনি সন্দেহভাজন কাউকে প্রবেশ করতে দেখেননি। নিহতের মেয়ের জামাই সুমন জনকণ্ঠকে জানান, খবর পেয়ে মালয়েশিয়া থেকে নিহতের স্বামী সজল বণিক ঢাকায় আসেন। তবে তার স্ত্রী আসতে পারেনি। সজল বণিক বুধবার দুপুর দুটোয় লাশ বুঝে নেন। ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় মরদেহের সৎকারের কথা রয়েছে। এরপরই ঢাকায় ফিরে মামলা দায়েরের চিন্তাভাবনা করছেন তারা। তবে কি কারণে এমন হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়েই কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলছিলেন, হত্যাকারীরা ডলি রানীকে বাসার বেডরুমে বটি দিয়ে জবাই করে। খবর পেয়ে তারা সে বাড়িতে গিয়ে বটিটিও লাশের উপর দেখতে পেয়েছেন। তখন রাত আটটার মতো বাজে। তবে ঘটনা কখন ঘটেছে সে সর্ম্পকে তারা নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারেননি। বাড়িটির একাধিক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দীপ্তর পিতা মালয়েশিয়া প্রবাসী। সেখান থেকে পাঠানো টাকার একটি বড় অংশ নিহতের বড় ভাই ধার হিসেবে নেয়। সেই টাকা নিয়েই ভাই বোনের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। প্রায় পনেরো দিন ধরে মোবাইল ফোনে মাঝে মধ্যে হত্যার হুমকি পেয়েছে। এজন্য ছেলেরা বাইরে যাওয়ার পর ডলি রানী দরজা বন্ধ করে ঘরেই থাকতেন। তেমন কোথাও যেতেন না। বিষয়টি তিনি পরিবারের অন্য সদস্য ছাড়াও বাড়ির অনেককে হালকাভাবে জানিয়েছেন। এসব মোবাইল ফোনে হুমকি ধমকি তিনি খুব বেশি বিশ্বাসও করতেন না। তাই হয় তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি জানানো বা থানায় জিডি করার প্রয়োজন অনুভব করেননি। এ বিষয়ে রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার জনকণ্ঠকে জানান, নানা বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত হচ্ছে। জমিজমা সংক্রান্ত কোন বিষয়াদির তথ্য জানা যায়নি। তবে আর্থিক লেনদেনের একটি অভিযোগ তারা শুনেছেন। সেসব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হত্যাকারীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে হত্যাকারীরা নিহতের পূর্ব পরিচিত বলে সার্বিক পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। বাড়ির মালিক আনোয়ারা বেগম জানান, প্রায় দুই বছর ধরে ডলি রানী মাসিক নয় হাজার টাকা ভাড়ায় চতুর্থ তলার দুইটি রুমে দুই ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছিলেন। বাড়ির মালিকের মেয়ে রুবা জানান, বাড়িটির দুইটি গেটই রাত এগারোটা নাগাদ খোলা থাকে। তবে পুরোপুরি নয়। একজন মানুষ যাতায়াত করতে পারেন, এমন জায়গা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়। বাড়িতে কোন নিরাপত্তা প্রহরি নেই। নিহতের ছোট ছেলে দীপ্তর বরাত দিয়ে তিনি জানান, ঘটনার দিন দীপ্ত দুপুর বারোটার দিকে কলাবাগান মাঠে ক্রিকেট অনুশীলন করতে যায়। ফিরে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা কি সাতটার দিকে আচমকা দরজায় জোরে জোরে শব্দ শুনি। খুলে দেখি দীপ্ত। সে জানায়, মাকে অন্তত পঞ্চাশ বার ফোন করেছে। তার মোবাইল বন্ধ। দরজাও বন্ধ। এরপর ছাদের চাবি নিয়ে কার্নিশ বেয়ে ভেতরে তার মাকে বিছানার উপর শুয়ে থাকতে দেখে। আশপাশে রক্তের দাগ দেখতে পায়। এরপর খবর পেয়ে পুলিশ ও র‌্যাব সেখানে যায়। রাত একটার দিকে লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায় পুলিশ। রমনা মডেল থানার ওসি মশিউর রহমান জানান, বুধবার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ এ ঘটনায় কোন মামলা হয়নি। লাশের সৎকারের পর পরিবারের তরফ থেকে মামলা দায়েরের কথা রয়েছে। অন্যথায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করবে। এ ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হয়নি। হত্যাকা-ে জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
×