ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে

হিলারির পরাজয়ে বিএনপি হতাশ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১০ নভেম্বর ২০১৬

হিলারির পরাজয়ে বিএনপি হতাশ

শরীফুল ইসলাম ॥ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী হিলারী ক্লিনটন পরাজিত হওয়ায় হতাশ হয়েছে বিএনপি। এ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় থাকা বিএনপির সামনে আশার আলো ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। এ নির্বাচনে হিলারী ক্লিনটন বিজয়ী হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিএনপি বাড়তি কিছু সুবিধা পাবে এমন আশাবাদ নিয়েই দলীয় হাইকমান্ড আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন। কিন্তু রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ায় তাদের সকল হিসেব-নিকেশ পাল্টে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই বিএনপির ক’জন কেন্দ্রীয় নেতা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে হিলারী ক্লিনটনের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের অন্য সিনিয়র নেতারাও বিভিন্নভাবে হিলারী ক্লিনটনের পক্ষে কাজ করেন। আর নির্বাচনের বেশ ক’দিন আগে থেকেই জরিপের ফল যখন হিলারী ক্লিনটনের পক্ষে আসতে থাকে তখন থেকেই বিএনপি নেতাকর্মীরা উৎফুল্ল হন। এ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর সুদিন আসবে বলে দলটির সর্বস্তরে জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। দলের সিনিয়র নেতারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়েও বলতে থাকেন সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন বর্তমান সরকারকে হটিয়ে আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। সেদিন এ সরকারের সকল অপকর্মের বিচার হবে। কিন্তু নির্বাচনের ফলে ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী হিলারী ক্লিনটনকে পরাজিত করে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায় হতাশ হয়েছে বিএনপি। বিএনপি নেতারা ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হিলারী ক্লিনটনের পক্ষে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি হিলারী ক্লিনটনের অত্যন্ত কাছের লোক হিসেবে পরিচিত। আবার ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপি হাইকমান্ডের খুব কাছের লোক হিসেবে পরিচিত। ড. ইউনূসের মাধ্যমে বিএনপি ইতোপূর্বে কোন কোন ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পেয়েছেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। তাই বিএনপি নেতাকর্মীদের আশা ছিল হিলারী ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলে ড. ইউনূসের মাধ্যমে বড় ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। এ আশায় বুক বেঁধেই বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা যার যার অবস্থান থেকে হিলারী ক্লিনটনের বিজয়ের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। বুধবার দুপুরে নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা লক্ষ্য করা গেছে। বিএনপি কার্যালয়ের সামনে ক’জন দলীয় কর্মী নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে গিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘কি হলো, সব জরিপে বলা হলো হিলারী জিতবেন, আর এখন হলো উল্টো। তাহলে আমরা কি আর ভাল কিছু আশা করতে পারি?’ এদিকে হিলারী ক্লিনটন পরাজিত হওয়ার পর কৌশল পরিবর্তনের চেষ্টা করছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বুধবার দুপুরে ভোটের ফলে ট্রাম্পের বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর খালেদা জিয়া এ অভিনন্দন জানান। ট্রাম্পকে দেয়া অভিনন্দন বার্তায় খালেদা জিয়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার দল রিপাবলিকানকে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এ বিজয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে আরও মজবুত করবে এবং সে দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে সহায়ক হবে। পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র চর্চার পথ সুগম করবে বলে আমরা আশাবাদী। উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগেও বিএনপি নেতাকর্মীরা বিজেপির বিজয় কামনা করেছিল। নির্বাচনের পর ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করে স্বাগত জানান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এর পর ভারতের সঙ্গে অতীতের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে গিয়ে সে দেশের নতুন সরকার ও বিভিন্ন প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দেখা করে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। আমন্ত্রণ না পাওয়ায় ওই যাত্রায় ভারত যেতে না পেরে হতাশ হন খালেদা জিয়া। তবে থেমে থাকেননি তিনি। বিভিন্ন মাধ্যমে বিজেপি সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন। বিএনপি মনে করেছিল বিজেপি বিজয়ী হলে বিএনপি ভারতের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা পাবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে কংগ্রেসের সুসম্পর্ক থাকায় বিএনপি এমনটি মনে করেছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল থেকে শুরু করে ১২ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ভারতের লোকসভা নির্বাচনের পর বিজেপি বিপুল ভোটে বিজয়ী এবং নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও বিএনপি ওই সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পারেনি। বরং নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের কাছ থেকে দেশের জন্য আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হয়। আর এ পরিস্থিতিতে বিএনপি হতাশ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলও আবার নতুন করে বিএনপিকে হতাশায় ফেলেছে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতা ছাড়ার পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে। এর পর ওয়ান ইলেভেন পরিস্থিতির পর এক দিকে তারেক রহমান ও খালেদা জিয়াসহ দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা গ্রেফতার হওয়া ও অপর দিকে দলের মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুইয়ার নেতৃত্বে শতাধিক কেন্দ্রীয় নেতা আলাদা অবস্থানে থেকে সংস্কারের পক্ষে অবস্থান করে চরম নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় দলটি। এ পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ দলের অনেক নেতা জামিনে মুক্তি পেলেও সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। এর ফলে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভারাডুবি হয়। নির্বাচনের পর বিগত ৩ বছরে দলের জাতীয় কাউন্সিল ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী সফল করতে পারেনি বিএনপি। তবে জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ২০১৩ সালের শেষের দিকে সারাদেশে জ্বালাও-পোড়াওসহ ব্যাপক নাশকতা চালিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তারা। সে বছর ২৯ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া ঘোষিত মার্চ ফল ডেমোক্র্যাসি কর্মসূচী ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে সারাদেশে কেন্দ্রভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যথারীতি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যায় এবং নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে সরকার গঠন করে। নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ের ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারের পাশাপাশি ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে সরকার বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করার প্রস্তুতি নেয় বিএনপি। ৫ জানুযারি রাজধানীতে বড় ধরনের শোডাউন করতে ৩ জানুয়ারি রাতেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তার গুলশান কার্যালয় অবস্থান নেন। পুলিশী বাধায় গুলশান কার্যালয় থেকে বের হতে না পেরে ৫ জানুয়ারি বিকেলে তিনি ৬ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে টানা অবরোধ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেন। কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে এ আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে ৯২ দিন পর তিনি গুলশান কার্যালয় থেকে বাসায় ফিরে যান। টানা ৯২ দিনের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর রাজনৈতিকভাবে আরও বেশি বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয় বিএনপিকে। রাজনৈতিক দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়ায় সরকারও বিএনপির প্রতি আরও কঠোর হয়। এ কারণে আগের মতো রাজপথে কর্মসূচী পালন করতে পারছে না বিএনপি। অপর দিকে বিএনপির নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সরকার একদিকে দেশে উন্নয়নমূলক কাজ জোরদার করা ও অন্যদিকে সারাবিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের ইমেজ ক্রমেই বৃদ্ধি করতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির সামনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারী ক্লিনটনের বিজয় ছিল একমাত্র আশার জায়গা। ডোনান্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ায় এখানেও বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হলো বলে মনে করা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা আশা করেছিলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিলারী ক্লিনটন বিজয়ী হবেন। নির্বাচন পূর্ববর্তী জরিপের ফলাফলও এমন আভাসই দিয়েছিল। হিলারী ক্লিনটন বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন নিশ্চিত করার ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারতেন। তিনি বাংলাদেশের ভাল চান বলেই এ ধরনের সহযোগিতা করতে পারতেন। আর বিএনপিও দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারী ক্লিনটন বিজয়ী না হওয়ায় বিএনপি তার সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবে।
×