ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মাসুদ রানা

মৃত্যুমিছিলের শেষ কোথায়?

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১০ নভেম্বর ২০১৬

মৃত্যুমিছিলের শেষ কোথায়?

কিছুদিন আগে অয়ন রাজধানী শহর ঢাকায় এসেছে। একটা ভাল চাকরি পাবার আশায়। বেশ কয়েক জায়গায় চাকরির সাক্ষাতকার দেয়ার পর অবশেষে একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি পেল। গ্রামে বয়স্ক বাবা-মা এবার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ভাবল সংসারের দুঃখ-কষ্টগুলো বুঝি এবার বিদায় নেবে। দেখতে না দেখতেই ঈদ-উল-আযহা চলে আসল। বাবা মায়ের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাসে চড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করল অয়ন। তার বাবা-মা কয়েক ঘণ্টা পর জানতে পারল, অয়ন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে। একটা দুর্ঘটনাই শেষ করে দিল অয়নের বাবা মায়ের সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। এটা কল্পিত গল্প হলেও অয়নের মতো অনেকেই প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অকালে মৃত্যুবরণ করছেন। সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশের অন্যতম একটি সমস্যা। প্রতিদিন পত্রপত্রিকা খুললেই সড়ক দুর্ঘটনার খবর অহরহ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় সারাদেশে যথাক্রমে ৮,৫৮৯ ও ৮,৬৪২ জন নিহত এবং ১৭,৫২৪ ও ২১,৮৫৫ জন আহত হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি, চলতি বছরেই গত ঈদ-উল- আযহায় সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ দিনে ২৬৫ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং আহত হয়েছিল ১০৫৬ জন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া গত বছরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০,০০০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। জাতিসংঘের কয়েকটি সদস্য দেশসমূহের অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নেমে আনার লক্ষ্য হাতে নেয়। বাংলাদেশও সেই অঙ্গীকারনামায় সই করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে বৈকি বরং দিনে দিনে বেড়েই চলছে। দুর্ঘটনা ঘটবে, কিন্তু এত বেশি এত দুর্ঘটনা ঘটলে এটা মোটেই স্বাভাবিক নয় এবং একে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়াটাও ঠিক হবে না। প্রশ্ন হলো কেন এত বেশি দুর্ঘটনা ঘটে? দুর্ঘটনার পিছনে প্রধান কারণগুলো কি কি হতে পারে? আসুন তা দেখি- প্রথমত, অদক্ষ ড্রাইভার, ট্রাফিক আইন বিষয়ে অজ্ঞ কিংবা মাদক নেশায় জড়িত এমন ড্রাইভারদের নিয়োগ দেয়া। দ্বিতীয়ত, ফিটনেসবিহীন গাড়ি ব্যবহার, যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা, দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, অসম প্রতিযোগিতা করার জন্য ওভারটেকিং, গাড়ির ধারণ ক্ষমতার বাইরে যাত্রী ও মালামাল বহন করা, গাড়ি চালানো অবস্থায় ফোনে কথা বলা, ঘুম ঘুম চোখে গাড়ি চালানো, রাস্তায় ছোট ছোট যানবাহনের আধিক্য। তৃতীয়ত, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা, ফুটপাথ দখল করা, ফুটপাথ কিংবা ওভারব্রিজ ব্যবহার না করা, রাস্তায় পর্যাপ্ত পরিমাণ রোড ডিভাইডার কিংবা জেব্রা ক্রসিং ও সিগন্যাল না থাকা। চতুর্থত, দুর্ঘটনার পর মামলা না হওয়া কিংবা হলেও এর সুরাহা না হওয়া। এর ফলে ড্রাইভাররা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পঞ্চমত, জনগণের আত্মসচেতনতার অভাব। প্রধাণত এসব কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। সড়ক দুর্ঘটনা একটি ব্যক্তির পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও অর্থনৈতিক জীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। হাইওয়ে পুলিশ বিভাগের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দুর্ঘটনায় পতিত ব্যক্তিদের ২৪% লোকের বয়স ১৫ বছরের নিচে এবং ৩৯% লোকের বয়স ১৬-৫০ এর মধ্যে। বুয়েটের র্দ্ঘুটনা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে যে, বেশিরভাগ সময়ই উপার্জনক্ষম ব্যক্তিই হচ্ছে দুর্ঘটনার প্রধান শিকার। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আহত কিংবা নিহত হলে একটি পরিবারের মেরুদ- পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে যায়। তাছাড়া দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিরা অনেক সময় কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং জীবিকার তাগিদে ভিক্ষাবৃত্তি অথবা অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। আর এটি শুধু ব্যক্তির পারিবারিক জীবনের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী নয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক বিপর্যয়ের জন্যও দায়ী। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে দেশের জনসম্পদের অপচয় ঘটছে। ফলে দেশের মোট জিডিপির প্রায় দেড় থেকে দুই শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা শূন্যের কোঠায় নেমে আনতে মাননীয় সরকার মহোদয় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ আমাদের সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। যেসব পদক্ষেপ নেয়া একান্তই জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে- এক. ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোকে রাস্তায় নামানোর অনুমতি না দেয়া। দুই, রাস্তায় গাড়ি নামানোর আগে গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটি পরীক্ষা করা, গাড়িতে অতিরিক্ত মালামাল ও যাত্রী বহন না করা এবং গাড়ির ছাদে লোকজন অথবা মালামাল না নেওয়া। তিন, চালক নিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালকদের নিয়োগ দিতে হবে। লাইসেন্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ গাড়ি চালককে অনেক ভালভাবে পরীক্ষা করার পর ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করবে। দিনাজপুর থেকে
×