ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাশিয়ার এই যুদ্ধংদেহী ভাবের পেছনে...

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ৯ নভেম্বর ২০১৬

রাশিয়ার এই যুদ্ধংদেহী ভাবের পেছনে...

চার বছর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তৎকালীন রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি বলেছিলেন যে রাশিয়া হলো আমেরিকার এক নম্বর ভূ-রাজনৈতিক শত্রু। বারাক ওবামাসহ অনেকেই তখন তার সেই উক্তিকে উপহাসভরে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন যে ২০ বছর আগে যেখানে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে সেখানে এ ধরনের কথা অর্থহীন। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি বলে যে রমনির সেই উক্তির মধ্যেই ছিল প্রজ্ঞার পরিচয়। গত দু-তিন বছরের ঘটনাবলীই তার প্রমাণ। কারণ এ সময়ের মধ্যে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করেছে, সিরিয়ায় সেনা পাঠিয়ে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে চলেছে, পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ নিয়ে লাগামহীন বক্তব্য দিচ্ছে, এমনকি মার্কিন নির্বাচনেও ভালমতো নাক গলিয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন প্রতি সপ্তাহেই বিশ্ববাসীকে ভয় পাইয়ে দেয়ার মতো নতুন নতুন কৌশল খুঁজে বের করছেন। সম্প্রতি তিনি পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার কাছাকাছি সরিয়ে এনেছেন। অতি সম্প্রতি তিনি বিমানবাহী রণতরী বহর উত্তর সাগর ও ইংলিশ চ্যানেলে পাঠিয়ে দিয়েছেন। হুমকি দিয়েছেন যে সিরিয়ার সরকারী বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালালে মার্কিন বিমান গুলি করে ভূপাতিত করা হবে। জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেছেন যে রুশ- মার্কিন সম্পর্ক ৪০ বছরের মধ্যে এত উত্তেজনাপূর্ণ আর কখনও হয়নি। রাশিয়ার টিভি সংবাদগুলো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোম্ব শেল্টারের খবরে পূর্ণ থাকে। পুতিনের প্রচার বিভাগ প্রধান দিমিত্রি কিসেলেও হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে অপরিণামদর্শী আচরণের পরিণতিতে পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। পুতিনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন ‘যুদ্ধ যদি অনিবার্য হয় আপনাকেই প্রথম আঘাত হানতে হবে।’ বাস্তব অবস্থা হলো রাশিয়া আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে না। যুদ্ধের যেসব কথাবার্তা বলা হচ্ছে তার বেশিরভাগই বাগাড়ম্বর। তবে এই বাগাড়ম্বরই স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে। রাশিয়ার এই যুদ্ধংদেহী হাবভাব ও আচরণ তার শক্তির পুনরুত্থান নয় বরং অন্তর্নিহিত দুর্বলতারই পরিচয়। রাশিয়া অর্থনতি, রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন। বার্ধ্যকজনিত মৃত্যুর কারণে এর জনসংখ্যা ২০৫০ সাল নাগাদ ১০ শতাংশ কমে আসবে এদিকে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সরকারী লোকবল বেড়েছে, খরচও বেড়েছে। পুতিনের শাসনের শুরুতে রাশিয়ার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ শতাংশ । সেই অর্থনীতি এখন সঙ্কোচিত হয়ে পড়েছে। এর জন্য পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞা ও তেলের দরপতন অংশত দায়ী হলেও দূর্নীতিরও একটা ভূমিকা আছে। রাষ্ট্র ও অর্থনীতিকে আধুনিকীকরণের উদ্যোগ মার খেয়েছে। কে ধনী হবে বা হবে না তা ক্রেমলিনের মর্জির ওপর নির্ভর করে। পুতিন দেশের অভ্যন্তরের এসব সঙ্কট বিদেশে আগ্রাসী চেহারা ধারণ করে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। ২০১১-১২ সালে নানা বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার শহুরে মধ্য শ্রেণী আধুনিক রাষ্ট্রের দাবি জানিয়েছিল। আগে যখন তেলের দাম বেশি ছিল পুতিনের হাতে তখন পয়সাও ছিল। আর সেই পয়সার জোরে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তিনি এই মধ্য শ্রেণীর বিক্ষোভ প্রশমিত করতে পেরেছিলেন। এখন তেলের সেই দর নেই, সেই পয়সাও নেই। এখন তিনি বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ চালিয়ে এবং প্রচারযন্ত্রের দ্বারা জাতীয়তাবাদ উস্কে দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে চাইছেন। সমৃদ্ধ রাশিয়া গড়ে তোলার জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো অপরিহার্য যেমন আইনের শাসন, মিডিয়ার স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও অবাধ প্রতিযোগিতা- এগুলো পুতিনের পচন ধরা রাষ্ট্র ব্যবস্থার অস্তিত্বের প্রতি হুমকি। রাশিয়া আজ এক হীনবল দেশ। তথাপি পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী একটি দুর্বল দেশ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনকি সে সময়কার পরাক্রান্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়েও কোন কোন ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হতে পারে। আরও বেশি বিপদের কারণ এই যে পুতিন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোন ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠান নেই। তিনি বছরের পর বছর ক্ষমতায় থেকে যেতে পারেন। বয়স তার জন্য কোন বাধা নয়। বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে পুতিন একটা জিনিস বুঝতে পেরেছেন যে তিনি আমেরিকাকে অগ্রাহ্য করতে ক্ষমতা রাখেন। পাশ্চাত্যের নিষেধাজ্ঞার কারণে সাধারণ রুশরা বেগতিক অবস্থায় পড়েছে বটে। তবে একই সময় তারা একত্রে রুখে দাঁড়ানোর মতো একটা শত্রুও পেয়ে গেছে এবং পুতিনও তাদের এই দুর্ভাগ্যের দায় অন্য কারোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার মওকা পেয়ে গেছেন। উপরে বর্ণিত কারণের জন্য হোক আর সরকারী প্রচারণার বদৌলতে হোক রাশিয়ার জনগণের চোখে পুতিন তার দেশের মর্যাদাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের মর্যাদায় ফিরিয়ে এনেছেন। ক্রিমিয়া, ইউক্রেন, জর্জিয়া ও সিরিয়ায়, রাশিয়ায় যা করেছে ও করছে তাতে করে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে নিজের সামরিক শক্তি ব্যবহারে রাশিয়ার ক্ষমতা, সার্মথ্য ও আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে এটা রাশিয়ার শক্তির নয় বরং দুর্বলতারই লক্ষণ। এর মধ্য দিয়ে মস্কোর গভীর রিরাপত্তাহীনতাই ফুটে ওঠে। এই নিরাপত্তাহীনতা থেকেই রাশিয়া যুদ্ধংদেহী ভাব ধারণ করে আত্মরক্ষার পথ খুঁজতে চাইছে। চলমান ডেস্ক সূত্র : টাইম
×