ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিউটি পারভীন

দুঃসাহসী যোদ্ধা মাশরাফি

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৯ নভেম্বর ২০১৬

দুঃসাহসী যোদ্ধা মাশরাফি

‘যে সহে, সে রহে’- অনেক সয়েছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত। বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সিতে খেলা শুরুর পর থেকে বাড়ি থেকে দূরে থাকার কষ্ট! কিন্তু ক্যারিয়ারে এরচেয়েও বড় কষ্ট আছে, যা যোগ হয়েছে দীর্ঘদিন মাঠে থেকে ক্রিকেট খেলার পর। সেই কষ্টটা ২০১১ বিশ্বকাপ খেলতে না পারার কষ্ট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ বছর পার করে ফেলেছেন- সয়েছেন বেশ কয়েকবার বড় ধরনের ইনজুরির কারণে দুই হাঁটুতে অস্ত্রোপচার করা এবং সে কারণে মাঠের বাইরে বসে থাকার কষ্ট। ২০০১ সালের নবেম্বরে মাত্র ১৮ বছর পেরনো মাশরাফি বিন মর্তুজার অভিষেক ঘটেছিল জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে। ইনজুরির কারণে বারবার দীর্ঘদিন ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। এভাবেই নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে জীবনের ১৫ বছর ক্রিকেটের সবুজ মাঠে কাটিয়ে দিলেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’। এই ক্রিকেটকে ঘিরেই আছে অনেক আনন্দঘন মুহূর্ত, আছে কিছু বেদনাময় স্মৃতি। থেমে যাবেন মাশরাফি? বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিদিন ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকা এ ডানহাতি পেসারের নেতৃত্বেই এসেছে দারুণ সব সাফল্য। এখনও যথেষ্ট উদ্যম, ছন্দ আছে তার মধ্যে। এরচেয়ে বড় কথা প্রতিটা সময় আগের চেয়ে ভাল করার প্রাণপণ প্রচেষ্টা টিকে আছে। ভাল করার জন্য প্রচেষ্টা চালানোর এই ক্ষুধাটা যতদিন থাকবে ততোদিনই থাকবেন ক্রিকেটে। তবে বাংলাদেশের মানুষ, ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থকরা মনেপ্রাণেই চায় আরও অনেকদিন থাকবেন মাশরাফি। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম একটা বছর পেরোতেই ডাক্তারের ছুরি-কাঁচির নিচে যেতে হয়েছে মাশরাফিকে। প্রথম অস্ত্রোপচার। নিউজিল্যান্ড সফরের সময় টিম ম্যানেজমেন্টের ভুলে সাইড-স্ট্রেইন নিয়ে খেলার কারণেই বড় ইনজুরি হয়েছিল। আবার নিজেরও কিছুটা দোষ ছিল, ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে হাঁটুকে জোর ব্যথা লেগেছিল। সেটাকে পাত্তা না দিয়েই খেলা চালিয়ে গেছেন কাউকে কিছু না জানিয়ে। তবে প্রথমবার অস্ত্রোপচার হওয়ার পর যখন আর খেলতে হবে না, সেটা জেনে বেশ খুশি হয়েছিলেন। কারণ বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে থাকতে পারবেন। এমনটা বেশ কয়েক বছর ছিল। কারণ মাশরাফি নিজেই জানিয়েছেন বয়স কম থাকার কারণে টেস্ট কিংবা ওয়ানডে খেলার যে মর্যাদা সেটা বোঝার মতো উপলব্ধি ছিল না তার। এমনকি ২০০৩ বিশ্বকাপের মাঝপথে ইনজুরি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেও খুশি হয়েছিলেন। ২০০৪ সালে আবার ফিরেই ভারতের বিরুদ্ধে প্রথমবার ওয়ানডে জয়ের নায়ক হয়ে যান মাশরাফি ৩৯ বলে ৩১ রান করার পর বল হাতে ৩৬ রানে ২ উইকেট নিয়ে। ২০০৫ সালে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট বিজয়ের ম্যাচেও দারুণ ভূমিকা রেখেছিলেন। একই বছর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম ওয়ানডে জয়ের ম্যাচেও দারুণ বোলিং করেছিলেন। তবে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে ক্যারিয়ারের সেরা বছর কাটিয়েছেন ২০০৬ সালে। সে বছর ক্রিকেট বিশ্বের শীর্ষ উইকেট শিকারি বোলার হন ২৭ ওয়ানডেতে ৪৯ উইকেট নিয়ে। আবার বাংলাদেশ দলও ২৮ ওয়ানডে খেলে ১৮টিতেই জয় তুলে নেয়। মাশরাফি জানিয়েছেন ক্যারিয়ারের এই বছরটা তিনি আজীবন মনে রাখবেন। আর এ বছর থেকেই ক্রিকেট একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে, উপলব্ধি করেন মর্যাদা-সম্মান, মানুষের ভালবাসার ব্যাপারটি। বাংলাদেশ, ক্রিকেট এবং দেশের সব মানুষই মাশরাফির ভালবাসা। যার সঙ্গেই মাশরাফি পরিচিত হয়েছেন, মুহূর্তেই আপন করে নিয়েছেন এবং একেবারেই চিরাচরিত যে ভাষায় নিজের পরিবারের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন সেভাবেই আলোচনা করেছেন। এ কারণেই মাশরাফির কথার বাইরে যাওয়ার কেউ নেই। দলের সতীর্থরাও তাকে মেনে চলেন অক্ষরে অক্ষরে। আর সেই সঙ্গে এত ইনজুরি নিয়েও দুর্দান্ত বোলিং করে যাওয়া ও দারুণভাবে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে একের পর এক সাফল্য এনে দেয়াটা তাকে করে তুলেছে আরও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে। তার সরল আর ভদ্র-নম্র আচরণের সবচেয়ে বড় প্রমাণ এবার আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে চলমান তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচে। ১ অক্টোবর আফগানদের বিরুদ্ধে মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচ চলার সময় এক পাগল ভক্ত মাশরাফিকে জড়িয়ে ধরার জন্য নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেঙ্গে মাঠে ঢুকে পড়ে। নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও মাশরাফি তাদের আঁটকেছেন এবং ওই ভক্তকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা এ জন্যই মাশরাফিকে এত ভালবাসেন। এই ভালবাসা একদিনে হয়নি। তিনি অনেকবারই একা বাংলাদেশ দলকে জয় পাইয়ে দিয়েছেন। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত বোলিং করে মাশরাফি নিয়েছিলেন ৩৮ রান দিয়ে ৪ উইকেট। দারুণ এক জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ দল। অথচ এই ম্যাচের আগের দিনই বন্ধু মানজারুল ইসলাম রানা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন খবর পেয়ে মুষড়ে পড়েছিলেন মাশরাফি। খেলতে চাননি। কোচ ডেভ হোয়াটমোর তাকে বলেন, মানজারের জন্যই খেলতে হবে। সে ম্যাচটাকে তাই বন্ধুকেই উৎসর্গ করেন তিনি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন সময় এসেছিল। নিষিদ্ধ ক্রিকেট আসর ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লীগে (আইসিএল) খেলতে গিয়েছিলেন দারুণ গোছানো একটা দলে পরিণত হওয়া দলের অধিকাংশ ক্রিকেটারই। মাশরাফিও প্রস্তাব পেয়েছিলেন, বিশাল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে খেলার জন্য। বাকি সবাই গেলেও যাননি মাশরাফি। কারণ আইসিএল খেলে ৮/৯ কোটি টাকা কামানোর সুযোগ থাকলেও বিভিন্ন দেশের বোর্ডসহ বিসিবিও সম্মত হয়েছিল আইসিএল ফেরত ক্রিকেটাররা জাতীয় দলে সুযোগ পাবেন না। তখন থেকেই মনে একটি কথা গেঁথে নিয়েছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বেঈমানী করে কিছু করবেন না। ২০০৯ সালে আইপিএল খেলার সুযোগ পান মাশরাফি। কলকাতা নাইট রাইডার্স তাকে দলে নিলেও মাত্র একটি ম্যাচ খেলিয়েছিল। সে বছরই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে প্রথমবার দলের অধিনায়ক নিয়োজিত হন। ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে হারের পর দারুণ কেঁদেছিলেন মাশরাফি। কারণ লঙ্কানদের ৬ রানেই ৫ উইকেট ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মুত্তিয়া মুরলিধরন অবিশ্বাস্য ব্যাটিং করে জিতিয়ে দেন দলকে। অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ম্যাচ হিসেবে ক্যারিবীয়দের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেই ইনজুরিতে পড়েন। ছিটকে যান প্রায় বছর খানেকের জন্য। ২০১০ সালে ফিরেই আবার অধিনায়ক হয়েছেন। ইংল্যান্ড সফরে তাদের বিরুদ্ধে প্রথমবার ওয়ানডে জেতার ম্যাচে হন ম্যাচসেরা। কিন্তু ওই বছরই আবার ইনজুরিতে পড়েন নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। বেশ কয়েকবার অস্ট্রেলিয়ার শৈল্যবিদ তার অস্ত্রোপচার করেছেন। তার দারুণ চিকিৎসায় বারেবারেই কঠিন সব ইনজুরি থেকেও ফিরে এসেছেন মাশরাফি মাঠে। তবে ইয়াং অনেক আগেই বলেছিলেন খেলা ছেড়ে দিতে। কিন্তু সেটা শোনেননি মাশরাফি। অধিনায়ক হলেই ইনজুরি, সে কারণেই ২০১৪ সালে তৃতীয়বারের মতো অধিনায়ক হওয়ার প্রস্তাব আসলে প্রথমে রাজি হতে চাননি। কিন্তু বাবার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তা হয়েছেন। আর এরপর নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে স্বর্ণালী সময় যাচ্ছে বাংলাদেশ দলের। তার অধীনে টানা ৬ ওয়ানডে সিরিজ জয় করেছে বাংলাদেশ দল। এরপর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২-১ ব্যবধানে হারের মাধ্যমে সেটাতে ছেদ পড়েছে। অথচ ২০১০ সালে কোচ জেমি সিডন্স বিরক্ত হয়েছিলেন মাশরাফি অধিনায়ক হওয়ার পর। যদিও সেটা বেশিদিন থাকেনি। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দারুণ জয়ে মুখ্য ভূমিকা রেখে ম্যাচসেরা হওয়ার পর সিডন্সই তার পিঠ চাপড়ে অনেক ভাল অধিনায়ক হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন মাশরাফিকে। তিনি জানিয়েছেন সেটাই তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক ঘটনা। সবচেয়ে কষ্টদায়ক ব্যাপার ঘটেছে পরের বছরই। যেন হাসির পরেই কান্না আসেÑ এই চিরন্তন সত্য কথার প্রতিফলন! দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো আয়োজিত বিশ্বকাপের মতো ইভেন্টে খেলা হয়নি। ইনজুরির কারণে ফিটনেস ঘাটতিই ছিল মূল কারণ। মাঠে নিজে খেলতে পারেননি, দেখতে হয়েছে মাঠের বাইরে থেকে। সেটা ছিল সিডন্সেরই সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র কয়েকদিন আগে যখন নেটে বোলিং করছিলেন তখন সেই সিডন্সই বলেছিলেন, ‘আমি ভুল করেছি তোমাকে না নিয়ে।’ অনুর্ধ-১৯ দলে সুযোগ পাওয়ার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং কোচ এ্যান্ডি রবার্টস তাকে করেছেন আরও ধারালো। তারই পরামর্শে বাংলাদেশ ‘এ’ দলে নেয়া হয়েছিল মাশরাফিকে এবং মাত্র একটি ম্যাচ খেলেই জাতীয় দলে সুযোগ করে নেন। এ কারণেই মাশরাফির দেখা প্রিয়তম বোলিং কোচ ছিলেন রবার্টস। প্রথম শ্রেণীর কোন ম্যাচ না খেলেই টেস্টে অভিষেক হয়েছিল তার। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’কে। চট্টগ্রামে কিংবা পোর্ট অব স্পেনে-ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম দুটি জয়েই ম্যাচসেরার পুরস্কার তার। ৩৬ টেস্টে ৭৮ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি তিন হাফসেঞ্চুরিসহ ৭৯৭ রানও আছে তার নামের পাশে। আর ১৬৬ ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বাধিক উইকেট পেয়েছেন ২১৬টি। হয়তো আরও অনেক এগিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটেই অন্যরকম এক উচ্চতায় থাকতেন মাশরাফি। কিন্তু ইনজুরি সেটা হতে দেয়নি। যে ১৫ বছর তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ছিলেন এর মধ্যে সবমিলিয়ে অন্তত ৫ বছরই তার মাঠের বাইরে কাটাতে হয়েছে। দলের অপরিহার্য বোলার হিসেবে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই মাশরাফি ওই ৫ বছর খেলতে পারলে দেশের ক্রিকেটও ভাল কিছু সাফল্য পেত এবং মাশরাফির উইকেট সংখ্যা হয়তো এখন ওয়ানডে ক্রিকেটে তিন শতাধিক থাকতো। ১৫ বছর আগে শুরু করলেও এখন পর্যন্ত ক্রিকেটের প্রতি নিবেদন, ভাল কিছু করার সামর্থ্যে কারও চেয়ে পিছিয়ে তো নেই-ই বরং অনেকের চেয়ে এগিয়ে, অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত অপরের জন্য। সেটা এখন পর্যন্ত ফিটনেস টেস্টে প্রমাণ হয়ে যায়। দলের তরুণ ও অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকেন বিপ টেস্টে- প্রথমে নাম থাকে তার। সে কারণেই ক্রিকেটের ক্ষুধাটা কমে না। এ বিষয়ে মাশরাফি বলেন, ‘বহুত সমস্যা, বহুত ভাল লাগা সবকিছুই আছে ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে। আমি অনুভব করি আমার ভাল লাগার সংখ্যাই বেশি। আর যে কয়দিন খেলি চেষ্টা করব ভাল খেলার। ফর্ম তো এমন একটা জিনিস যখন তখন আসতে পারে, যখন তখন খারাপ হয়। কিন্তু আমি যেটা বললাম আপনার চেষ্টাটা কতটুকু বা বাংলাদেশ দলে সবাই খেলতে চায় কিন্তু তারজন্য চেষ্টা করতে হবে, কষ্ট করতে হবে। তো ওই ক্ষুধা থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওইটা যতদিন আছে ততোদিন চেষ্টা করব।’ ক্যারিয়ারের ১৫ বছরে নিজের প্রিয়-অপ্রিয় বিষয়গুলো জানিয়েছেন মাশরাফি।
×