ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশেষ প্রদর্শনী জাদুঘরে

তিন বছরের দুর্লভ সংগ্রহ, ইতিহাস ঐতিহ্যের খোঁজ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৯ নভেম্বর ২০১৬

তিন বছরের দুর্লভ সংগ্রহ, ইতিহাস ঐতিহ্যের খোঁজ

মোরসালিন মিজান ॥ সাম্প্রতিককালে জাতীয় জাদুঘরের একটি সমালোচনা খুব হয়। অনেকের অভিযোগ- এই প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা একাডেমির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। নানা উৎসব অনুষ্ঠান নিয়ে সারাবছর হই হুল্লোড় সময় কাটায় কর্তৃপক্ষ। নিদর্শন সংগ্রহ, গবেষণা সেমিনার আয়োজন ও প্রকাশনার মতো মূল কাজের খবর কী? জানার তেমন সুযোগ হয় না। তবে এখন ঠিক এই মুহূর্তে ২৩ নম্বর গ্যালারি ঘুরে দেখলে কিছু উত্তর মিলবে। তৃতীয় তলায় অবস্থিত গ্যালারিতে গত তিন বছরের নির্বাচিত সংগ্রহ। মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে বিশেষ প্রদর্শনী। দুই মাসব্যাপী প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি সচিব বেগম আকতারী মমতাজ। জাদুঘরের নিদর্শন সংগ্রহ কার্যক্রমের একটি চিত্র এখানে তুলে ধরা হয়েছে। বাড়তি কৌতূহল নিয়ে দেখছেন দর্শনার্থীরা। গ্যালারিতে ২০১৪, ২০১৫ এবং চলতি ২০১৬ সালের নির্বাচিত সংগ্রহ। তিন বছরে মোট নিদর্শন সংগ্রহভুক্ত হয় ৪ হাজার ১০৭টি। প্রথম বছরে সংগ্রহভুক্ত হয় ১ হাজার ৭৩৫টি। দ্বিতীয় বছর পাওয়া যায় ১ হাজার ২৬৯টি। এবং তৃতীয় বছরে ১ হাজার ১০৩টি নিদর্শন জাদুঘরে আসে। উল্লেখযোগ্য ৭০০ নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে গ্যালারিতে। প্রথমেই বলতে হয় ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগের কথা। বিভাগটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ শুঙ্গযুগের পোড়ামাটির ফলক। খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের অমূল্য স্মারক যক্ষিণী। মহাস্থানগড় থেকে পাওয়া। আছে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের স্বর্ণমুদ্রা। চতুর্থ-পঞ্চম শতকের ইতিহাস বলছে নওগাঁর একটি পুরনো দীঘি বা পুকুর থেকে পাওয়া জলপাত্র। এটি গুপ্ত বা পাল যুগের বলে ধারণা করা হচ্ছে। খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকের ৬০টি রৌপ্যমুদ্রা সংগ্রহ করা হয়েছে সাতক্ষীরা থেকে। মৌর্যযুগের মুদ্রাগুলোর ৫টি রাখা হয়েছে প্রদর্শনীতে। দর্শনার্থীদের সহজেই আকৃষ্ট করে গ্লাসশোকেসে রাখা একটি কলস। মাটির নিচে পুঁতে রাখা কলসের ভেতরে ছিল ব্রিটিশ শাসনামলের রৌপ্যমুদ্রা। এগুলোর বেশ কয়েকটি কলসের পাশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়াও আছে ইদ্রাকপুর দুর্গ থেকে সংগ্রহ করা দুটি কলস। একই বিভাগ থেকে গ্যালারিতে দেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। একাধিক নথিতে সে সময়ের তথ্য। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমএলএদের শেয়ারমার্কেটের শেয়ার বন্ধের গোপন নির্দেশ একটি নথিতে। আছে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা। মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর গেরিলা সেক্টরের অধিনায়ক কর্তৃক প্রচারিত লিফলেট প্রদর্শিত হচ্ছে। বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তার ব্যবহার করা সেফটি হেলমেট, সেফটি বুট এবং সিজার (কাঁচি)। গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের হাতে লেখা পা-ুলিপি। শিক্ষাবিদ বাসন্তি গুহ ঠাকুরতার ডায়েরি মেলে ধরা আছে। রাখা আছে হাসান আজিজুল হকের ‘সাবিত্রি উপাখ্যান’র দ্বিতীয় খ-ের পা-ুলিপি। জাতিতত্ত্ব ও অলঙ্করণ শিল্পকলা বিভাগের সংগ্রহভুক্ত নিদর্শন ১৫৫টি। নিদর্শন। প্রদর্শিত হচ্ছে ১১০টি। রয়েছে ঐতিহ্যবাহী মসলিনবস্ত্র। আঠারো শতকের শেষভাগের নিদর্শন ভারতের দিল্লী থেকে সংগ্রহ করা হয়। সুতি শাড়ির দৈর্ঘ্য ২৫৪ সেমি.। প্রস্থে ১২৭ সেমি.। আছে তৈজসপত্র, ধাতব শিল্পকর্ম, পোশাক-পরিচ্ছদ। কাঁচামাটি, পোড়ামাটি ও কাপড়ে তৈরি পুতুল আছে। আছে চাকমা এবং রাখাইনদের বিভিন্ন নিদর্শন। সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা বিভাগের সংগ্রহভুক্ত নিদর্শন ৫৫টি। প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে ৪৫টি নিদর্শন। ১১০ বছরের পুরনো পিতলের ঘণ্টি বেশ নজর কাড়ছে। বহু বছরের পুরনো চিমনিওয়ালা হারিকেনও কৌতূহল নিয়ে দেখছেন দর্শনার্থীরা। যোগ হয়েছে হাশেমখানসহ বরেণ্য শিল্পীদের আঁকা কিছু ছবি। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের কিছু পোস্টার থেকেও সময়টা সম্পর্কে ধারণা নেয়া যায়। প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে এবং পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষাকে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে নিদর্শন সংগ্রহ করে থাকে। মোট সংগ্রহ সংখ্যা ১৬৭। প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে বাঘের চমড়া। অজগরের চামড়া। শামুক-ঝিঁনুক ইত্যাদি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সংগ্রহের কথা আলাদা করে বলতে হয়। বাংলার লোকশিল্পের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর। বিভিন্ন আকার আকৃতির মাটির পুতুল সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। পুতুলগুলো ৪০ বছর ধরে পরিবারের সদস্যরা আগলে রেখেছেন। জাদুঘরের সংগ্রহভুক্ত না হলেও, রাখা হয়েছে প্রদর্শনীতে। ৯টি কাঁচামাটির পুতুল। পোড়ামাটির ৬৩টি। সব মিলিয়ে ভাল আয়োজন। তিন বছরে জাদুঘরের সংগ্রহ সম্পর্কে একটি ধারণা অন্তত পাওয়া যায়। বিশেষ প্রদর্শনী ঘুরে দেখার আহ্বান জানিয়েছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
×