ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো তাহের

বিশ্বে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে রোসাটম

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৯ নভেম্বর ২০১৬

বিশ্বে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে রোসাটম

রাশিয়ান স্টেট নিউক্লিয়ার এনার্জি কর্পোরেশন ‘রোসাটম’ নিউক্লিয়ার রি-এ্যাক্টর স্থাপন ও পরিচালনায় বিশ্বের বৃহৎ কোম্পানিসমূহের মধ্যে একটি। রোসাটম শুধু দেশে নয়. বরং পৃথিবীর নানা দেশে নিউক্লিয়ার রি-এ্যাক্টর তথা পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনায় দীর্ঘদিন যাবত দক্ষতা এবং সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। মোদ্দাকথা সারাবিশ্বে নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি সম্প্রসারণে রোসাটম গুরুত্বপূর্ণ এক প্রতিষ্ঠান। আগামী দিনে পৃথিবীর কোন্ কোন্ দেশে রোসাটম পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনায় অংশ নিতে যাচ্ছে তার একটি পরিসংখ্যান দেয়া যাক। তুরস্কে থ্রি-প্লাস প্রজন্মের ভিভিইআর-১২০০ মডেলের চারটি রি-এ্যাক্টর স্থাপনের চুক্তি রোসাটম ও তুরস্ক সরকারের মধ্যে সই হয় ২০১০ সালে, যা তুরস্কের পার্লামেন্টেও অনুমোদিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৬ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তুর্কী সেনাবাহিনী কর্তৃক রুশ বিমান ভূপাতিত করার জেরে এই ডেটলাইন পিছিয়ে যায়। তবে সম্প্রতি মস্কো ও আঙ্কারার সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর তুরস্কে রোসাটম কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শীঘ্রই শুরু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বেলারুশে রোসাটম ভিভিইআর-১২০০ মডেলের দুটি রি-এ্যাক্টরের নির্মাণ কাজ শুরু করে ২০১৩ সালে। যেগুলো থেকে বিদ্যুত উৎপাদন শুরু হবে যথাক্রমে ২০১৮ ও ২০২০ সালে। এদিকে ইরানে ভিভিইআর-১০০০ মডেলের দুটি রি-এ্যাক্টর স্থাপন চুক্তি রোসাটম ও ইরান সরকারের মধ্যে সই হয় ২০১৪ সালে। উল্লেখ্য, ইরান জার্মানির সহযোগিতায় নির্মিত ও পরিচালিত রি-এ্যাক্টর থেকে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন করে আসছে। ইরানের এই পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পের নাম বুশের-১। ২০১৩ সালে এই প্রকল্পের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ ফেডারেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এদিকে বুশের-২ নামে আরেকটি প্রকল্পে আরও ছয়টি রি-এ্যাক্টর স্থাপনে ইরান ও রুশ ফেডারেশনের মধ্যে শীঘ্রই চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৮৮ সালে ভারতের কুদানকুলামে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নির্মাণ শুরুর ১১ বছরের মাথায় ২০১৩ সালে অপারেশনে আসে কুদানকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র। দ্বিতীয় রি-এ্যাক্টরটিও অপারেশনের অপেক্ষায় রয়েছে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে রুশ ফেডারেশন ও ভারত ঘোষণা করে যে, কুদানকুলাম-২-এর পরিকল্পনা প্রস্তুত এবং ২০১৭ সালের যে কোন সময়ে এর নির্মাণ কাজ শুরু হতে পারে। ভিয়েতনামে নিন তুয়ান নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ এখন পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়েছে। যেখানে ভিভিইআর-১২০০ মডেলের থ্রি-প্লাস প্রজন্মের রি-এ্যাক্টর স্থাপন করা হবে। এটি হবে ভিয়েতনামের প্রথম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট। উল্লেখ্য, এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ ২০১৪ সালে শুরু হওয়ার কথা ছিল এবং সেই অনুযায়ী সাইট উন্নয়ন শুরু হয়েছিল। কিন্তু ভিয়েতনাম সরকার নিরাপত্তার ইস্যুগুলো নিশ্চিতকল্পের লক্ষ্যে নিন তুয়ান প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ ২০২০ সাল পর্যন্ত স্থগিত করে। উল্লেখ্য, ভিয়েতনামের ওই প্রকল্প রুশ ফেডারেশনের ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তায় নির্মিত হতে যাচ্ছে। একই এলাকায় জাপানের সহায়তায় ভিয়েতনাম আরেকটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ‘পাকস-২ প্রকল্প’ নামে হাঙ্গেরিতে ২০১৮ সালে ভিভিইআর-১২০০ মডেলের দুটি রি-এ্যাক্টর স্থাপনে হাঙ্গেরিয়ান কোম্পানি এমভিএম এবং রোসাটমের মধ্যে ২০১৪ সালের শেষের দিকে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উল্লেখ্য, প্রাথমিক পাকস-নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। যেখানে ভিভিইআর-৪৪০ মডেলের চারটি রি-এ্যাক্টর ছিল। যেগুলো কমিশন শুরু হয় ১৯৮২ সালে। ২০১০ সালের শেষে চীন তাইওয়ানের জন্য অতিরিক্ত দুটি রি-এ্যাক্টর রোসাটম থেকে সংগ্রহ করে। ভিভিইআর-১০০০ মডেলের রি-এ্যাক্টর দুটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় যথাক্রমে ২০১২ ও ২০১৩ সালে। এই দুটি রি-এ্যাক্টর ২০১৮ সালে অপারেশনে যাওয়ার কথা রয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা দাইচিতে পারমাণবিক দুর্ঘটনার কারণে তাইওয়ানের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ কাজ শুরু খানিকটা বিলম্বিত হয়। এদিকে তাইওয়ান প্রাথমিকভাবে ২০০৬ ও ২০০৭ সালে অপারেশনে যাওয়া দুটি রি-এ্যাক্টরের মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনের যুগে প্রবেশ করে। ফিনল্যান্ডে ভিভিইআর-১২০০ মডেলের একটি রি-এ্যাক্টরের নির্মাণ কাজ ২০১৮ সালে শুরু করতে যাচ্ছে রোসাটম। যেটির কারিগরি সহায়তা ও অর্থায়নও করবে রোসাটম। এদিকে বাংলাদেশের রূপপুরে থ্রি-প্লাস প্রজন্মের ভিভিইআর-১২০০ মডেলের দুটি রি-এ্যাক্টর স্থাপনে রাশিয়ার স্টেট নিউক্লিয়ার এনার্জি কর্পোরেশন রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তি সই হয় ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর। চুক্তি অনুযায়ী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের মূল নির্মাণ কাজ শুরু হবে ২০১৭ সালের আগস্টে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নয়টি দেশে ১৯টি রি-এ্যাক্টর স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে রোসাটমের। আর ৫টি রি-এ্যাক্টরের কাজ নির্মাণাধীন রয়েছে। এদিকে প্রায় পৃথিবীর সব দেশেই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনে নানা কাল্পনিক অজুহাতে বিরোধিতা লক্ষণীয়। কিন্তু বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন বিরোধিতায় কিছু সংখ্যক পরিবেশবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি বিশেষ মহল। আর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন বিরোধিতায় অতি সহজে এক থেকে অসংখ্য, জন থেকে বহুজনে এবং অশিক্ষিত থেকে শিক্ষিতজনে বিভ্রান্তি ছড়ানো যায়। এই বিভ্রান্তি বিস্তারণের অন্যতম অস্ত্র হচ্ছে ¯েপন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের থেকে, এমনকি স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে বলা হয়েছে রূপপুরের স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল চুক্তি অনুযায়ী ফেরত নেবে রাশিয়া। কে শোনে কার কথা! দাবি করা হচ্ছে স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল ফেরত নিয়ে পরিশোধনের পর রাশিয়া বাংলাদেশে নিয়ে আসবে এবং তা বাংলাদেশকেই সংরক্ষণ করতে হবে। প্রচার করা হচ্ছে স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল ব্যবস্থাপনা বিপজ্জনক। ভাবখানা এমন যে, পৃথিবীতে বাংলাদেশের রূপপুরেই প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। রোসাটমের স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল ব্যবস্থাপনার যেন পূর্বাভিজ্ঞতা নেই। আসলে ভুল, অজ্ঞতা ও মিথ্যাচারকে ভিত ধরেই নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন-বিরোধিতা ডালপালা গজাচ্ছে। লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক
×