ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৃত অপরাধী চক্র চিহ্নিত ॥ গ্রেফতার আরও ২১, রিমান্ডে ৮ জন

নাসিরনগরে পুলিশী তৎপরতা জোরদার, রাত জেগে পাহারা

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৮ নভেম্বর ২০১৬

নাসিরনগরে পুলিশী তৎপরতা জোরদার, রাত জেগে পাহারা

স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ জেলার নাসিরনগরে সৃষ্ট ঘটনায় আরও দুটি মামলা হয়েছে। এ নিয়ে চারটি মামলা ও একটি জিডি করা হয়। মামলায় আসামি করা হয়েছে অন্তত ২৭শ’ ব্যক্তিকে। ইতোমধ্যে পুলিশ ৭৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। রবিবার রাতে সর্বশেষ ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের সোমবার কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালত তাদের জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেয়। এদিকে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনায় প্রথম দফায় গ্রেফতারকৃত ১১ জনের সোমবার নাসিরনগর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুলতান সোহাগ উদ্দিন আদালতে রিমান্ড শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আদালত তাদের আটজনকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এরা হলো- উজ্জ্বল মিয়া, মামুন মিয়া, ইয়ামিন মিয়া, শাহীদ মিয়া, রুনাইদ, খায়রুল মিয়া, বাবুল মিয়া ও ছোট্ট মিয়া। কোর্ট ইন্সপেক্টর মাহাবুবুর রহমান রিমান্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, তা-ব ও ভাংচুরপরবর্তী পরিস্থিতিতে হিন্দু বাড়িঘরে আগুন দেয়ার সঙ্গে কারা জড়িত তা শনাক্ত এবং নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। খুব অল্প সময়ে তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। আগুন লাগানোর ঘটনায় জড়িত চক্রটিকে গ্রেফতারে বিলম্বের কারণে হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে, নাসিরনগরে মৌলবাদী তা-বের ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে ব্যাপক পুলিশী তৎপরতা চালানো হয়েছে। সেই সঙ্গে রাতভর স্বেচ্ছাসেবকদের পাহারা বসানো হয়েছে। ঋষিপাড়া গ্রামের মনোহর ঋষি বলেন, প্রতি রাতে ২২ জনের একটি দল করে পাহারা দিচ্ছি। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই পাহারা দেয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসক মোঃ রেজাওয়ানুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেছেন, র‌্যাব-বিজিবি এবং পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক কর্মী, আনসার, ভিডিপিসহ সরকার ও প্রশাসনের সকল নিরাপত্তাকর্মী সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় কাজ করছে। পুলিশের পাশাপাশি তারাও পাহারা দিচ্ছে। এতে আতঙ্ক কেটে গেছে। ইতোমধ্যে হিন্দু-মুসলমানদের সম্বন্বয়ে সম্প্রীতি সমাবেশ হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছে। অন্যদিকে পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেছেন, আমরা কোন ধর্মের লোকের ওপর আঘাত করছি না। যারা অপরাধী তারাই গ্রেফতার হবে। যারা অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরে জড়িত তাদের নাম-ঠিকানা জেনেছি। নাসিরনগরের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, মানবাধিকার কর্মীগণ। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে টিন ও নগদ অর্থ বিতরণ ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সোমবার ৫১টি পরিবারের মধ্যে টিন ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। সকালে উপজেলা চত্বরে আয়োজিত বিতরণ অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক মোঃ রেজওয়ানুর রহমান, জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মোঃ আবুল কাশেম, উপজেলা চেয়ারম্যান এটিএম মনিরুজ্জামানসহ জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। নাসিরনগর উপজেলার কাশিপাড়ার ১২টি পরিবারকে তিন বান্ডিল করে টিন, নগদ নয় হাজার টাকা, হরিপুর ইউনিয়নের ১৬টি পরিবারকে দুই বান্ডিল করে টিন ও নগদ ছয় হাজার টাকা এবং সদরের আরও ২৩টি পরিবারকে দুই বান্ডিল করে টিন ও নগদ ছয় হাজার করে টাকা প্রদান করা হয়। জেলা প্রশাসক মোঃ রেজওয়ানুর রহমান বলেন, আমরা সবসময় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে আছি। নাসিরনগরের পরিবেশ আগের মতো শান্ত হয়ে এসেছে। আশা করছি সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে যে সম্প্রীতি ছিল সেটি আবারও ফিরে আসবে। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ॥ নাসিরনগরের ঘটনা সুপরিকল্পিত বলে মন্তব্য করেছে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম। নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক তা-ব পরিদর্শন শেষে সোমবার বিকেলে নাসিরনগর প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এ মন্তব্য করেন। এ সময় ফোরাম নেতারা বলেন, আমরা মনে করি যারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চায় এ হামলায় তাদের ইন্ধন রয়েছে। এর আগে রামু এবং উখিয়াতেও একই ঘটনা ঘটেছে। এখানে যে সহিংসতা হয়েছে তা সুপরিকল্পিত। দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে একটি চক্র এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এ সময় তারা ক্ষতিগ্রস্তদের পুনঃনিরাপত্তা দেয়ার দাবি জানান। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) কেএম শফিউল্লাহ বীরউত্তম, মহাসচিব হারুন হাবিব, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ বক্তব্য রাখেন। ১৫ সদস্যের ওই দলে সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক আলহাজ মোমারফ হোসেন, দফতর সম্পাদক মেজর (অব) শেখ দলিল উদ্দিন আহামেদ, প্রচার সম্পাদক তুষার আমিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ॥ এদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী বাঞ্ছারামপুরের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম সোমবার হেলিকপ্টারযোগে নাসিরনগর উপজেলার আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে অবতরণ করেন। পরে তিনি সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়িঘর ও মন্দির পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সান্ত¡না দেন ও প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দেন। পরে তিনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আলহাজ এ্যাডভোকেট ছায়েদুল হকের সঙ্গে স্থানীয় ডাকবাংলোয় সাক্ষাত করেন। এ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক তানজিল আহমেদসহ উপজেলার শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। ‘ইসলাম কখনও হামলা-ভাংচুর সমর্থন করে না’ ॥ সোমবার এদারায়ে তালিমিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আল্লামা মাওলানা আশেকে এলাহি ইব্রাহীমির নেতত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শীর্ষ আলেমদের একটি প্রতিনিধি দল নাসিরনগরে সম্প্রতি সৃষ্ট ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে। বেলা ১১টায় দলটি উপজেলার গৌরবাড়ি মন্দির, দত্তবাড়ি মন্দিরসহ ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনাসহ বাড়িঘর পরিদর্শন করে। এ সময় উলামা প্রতিনিধি দলেন নেতা মাওলানা সাজেদুর রহমান বলেন, এ ন্যক্কারজনক ঘটনায় আলেম সমাজ অত্যন্ত মর্মামত। ইসলাম কখনও হামলা-ভাংচুর সমর্থন করে না। ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং ভিডিও ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্ত করে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। সেই সঙ্গে নিরীহ লোকজন যাতে কোন ধরনের হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যাপারে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শীর্ষ আলেমগণ পবিত্র কাবা শরীফের অবমাননাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সকল ধর্মাবলম্বীর সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানে বসবাসের আহ্বান জানান। প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল আল্লামা মুফতি মুবারক উল্লাহ, জামিয়া দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল আল্লামা সাজিদুর রহমান, মুফতি আব্দুর রহিম কাসেমী, মাওলানা নোমান হাবিবী, মাওলানা বোরহান উদ্দিন কাসেমী, মুফতি এনামুল হাসান, নাসিরনগরের কওমী উলামা পরিষদের সভাপতি মাওলানা সামছুদ্দিন, মাওলানা আব্দুস সাত্তার, মাওলানা ইকবাল, মাওলানা আব্দুল মোমিন প্রমুখ।
×