ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

জননেত্রীর তুলনা তিনি নিজেই

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৮ নভেম্বর ২০১৬

জননেত্রীর তুলনা তিনি নিজেই

বঙ্গবন্ধু একজনই জন্মেছিলেন তিনি অদ্বিতীয়, অবিসংবাদিত ও অবিনাশী। শত চেষ্টা ও ইতিহাস বিকৃতি করেও বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী সত্তা মুছে দেয়া সম্ভব নয়। এটা নিছক ধৃষ্টতা ও অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয়। এখানে জননেত্রীকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তুলনা করার মতো সাহস আমার নেই। পীর, মুর্শিদ, আওলিয়া এমনকি মহামানবরা অনেক গুণের অধিকারী হয়ে থাকেন। ক্ষমা তাদের কাছে মহত্ত্ব। বঙ্গবন্ধু-পীর, মুর্শিদ না হলেও তিনি ছিলেন দরবেশ শেখ আউয়ালের রক্তের একজন ধারক, যিনি এক মহান আউলিয়ার সঙ্গী হয়ে অর্থাৎ হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (র) ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে এই বঙ্গীয় এলাকায় আগমন করেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক মহামানব, নিজের শত্রুকেও তিনি ঘৃণার চোখে দেখতেন না। সবাইকে ক্ষমা করার মতো এক মহৎ প্রাণ মহাপুরুষ ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন রাজনীতির এক বহুমাত্রিক দার্শনিক। উনাকে শুধু তুলনা করা যায় মহাত্মা গান্ধী ও বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ট্রো বা মহামতি লেনিনের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে যে অন্যায়, অবিচার নিয়ে, দারিদ্র্য নিত্য সঙ্গী করে যেভাবে আমাদের প্রিয় নেত্রী এবং প্রাণপ্রিয় ছোট আপা নির্বাসিত জীবনের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে ছিলেন এটা শুধু তারাই জানেন, আর অন্য কেউ তা কল্পনাও করতে পারবেন না। ছোট আপা যেভাবে সুইডেন থেকে ইউরোপজুড়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের সুস্পষ্ট দাবি নিয়ে ছুটেছিলেন তা ছিল একজন সংগ্রামী দৃপ্ত প্রত্যয়ের মানুষের প্রতিচ্ছবি। আমি আমার এই প্রিয় দুই আপাকে যে বিশেষণে ভূষিত করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি তা হলো ‘জগৎ নন্দিনী, জনম দুঃখিনী।’ আমি শুনেছি, বঙ্গবন্ধুর মা যখন মারা যান, তখন বঙ্গবন্ধুর চেয়েও বেশি যিনি কেঁদেছিলেন, তিনি উমি চাঁদ ও মীর জাফরের অন্যতম রক্তের ধারক খন্দকার মোশতাক আহমেদ। বঙ্গবন্ধু নাকি ওই দিন ধমক দিয়ে তাকে বলেছিলেন, মা মারা গেছে আমার, তুমি এত কাঁদছ কেন? নাটকের অনেক দৃশ্য আপনি দেখেছেন জননেত্রী। জাতির পিতার জীবনে মা সাহেরা খাতুন, স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা এবং জ্যেষ্ঠ কন্যা হিসেবে আপনার এক বিরাট ভূমিকা ছিল। ১৯৮১ সালে নির্বাসনে থাকা অবস্থায় আপনি সর্বসম্মতভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। যখন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন তখন নিশ্চয়ই আপনার প্রতিজ্ঞা ছিল বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার করবেন। জাতির পিতার নেতৃত্বে রচিত ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাবেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্নও নিশ্চয় আপনার স্বপ্ন ছিল। ধীরে ধীরে আইনী প্রক্রিয়ায়, আন্তর্জাতিক মানের বিচারের মাধ্যমেই আপনি তা সমাধান করতে পেরেছেন। এমনকি আইন প্রণেতাদের সংখ্যা গরিষ্ঠদের মতামত নিয়ে আপনি ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে এসেছেন। সুতরাং জাতির প্রত্যাশা আপনি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ জন্য আপনাকে সুস্থভাবে অনেক দিন বেঁচে থাকতে হবে। চিকিৎসকের কাছে রোগীর প্রত্যাশা যেমন আনলিমিটেড (সীমাহীন), তেমনি আপনার এবং পরিবারের কাছে এ দেশের জনগণের চাহিদাও অনেক বেশি। বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতিতে আপনারা যেমন সমর্থন যুগিয়েছিলেন, আজ আপনাদের সুশিক্ষিত পঞ্চরতœœ সন্তানরাও কিন্তু সমাজ বিনির্মাণে আপনাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছেন। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের লাখো কোটি নিবেদিতপ্রাণ কর্মী তো রয়েছেই। জয়, পুতুল, ববি, টিউলিপ এবং রূপন্তী- সবাই আপনার এবং আওয়ামী লীগের জন্য এক সহায়ক শক্তি। এরা প্রত্যেকেই এক একটি জেম। ১৯৮১ সালের পরে দেশে ফিরে এসে আপনি যেভাবে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-যুবক এবং সব ধরনের পেশাজীবীকে একত্র করে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণজাগরণ ও আত্মত্যাগী সংগ্রাম গড়ে তোলেন তা ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে সাক্ষী হয়ে থাকবে। স্বৈরশাসনকে ছিন্ন ভিন্ন করে, চিরতরের জন্য সমাধিস্থ করে, সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনেছেন, তা সম্ভব হয়েছে, শুধু আপনার দেয়ার ইচ্ছা ছিল বলেই, যেখানে প্রাপ্তির কোন চিন্তা আপনার ছিল না। পুরো বিশ্ব সেদিন অবাক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছিল, গণতন্ত্রের লেবাসধারী স্বৈরশাসক কিভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হয়। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এক উদাহরণ। প্রয়াত লেখিকা এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক বেবী মওদুদ আগেই উল্লেখ করে গেছেনÑ ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশকে আজ এক সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় তিনি সচেতন। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য কন্যা, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন। এর পেছনে রয়েছে তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, আন্তরিকতা, শ্রম ও সদিচ্ছা।’ জাতিসংঘে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে আপনার উত্থাপিত গ্লোবাল জলবায়ু, জঙ্গী দমন এবং শান্তির প্রস্তাব অনেক রাষ্ট্রপ্রধান ও সমাজবিজ্ঞানী কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক আপনি এর স্বীকৃতিও পেয়েছেন। সুতরাং এ মুহূর্তে আপনি শুধু বাংলাদেশের নেত্রী নন, গ্লোবাল আলোর দিশারীও বটে। ১৭ মে ১৯৮১তে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর, ১৯৮৩ সালে ১৫ দলীয় ঐক্য জোট গঠন করেন। ১৯৮৩ সালের ২১ জানুয়ারি তারিখে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন আমাদের প্রিয় ছোট আপা শেখ রেহানা। যিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ১৯৭৪ সালের পরেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য সোচ্চার ছিলেন। শেখ রেহানার সংবর্ধনা সভায় আপনি ঘোষণা করেন, ‘সামরিক জান্তা জনগণের প্রতিনিধি নয়, কারণ তারা বুলেটের মাধ্যমে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেছে। জনগণ গণতন্ত্র চায়, সামরিক শাসন চায় না। সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে।’ সমবেত জনতা আপনার বক্তব্য সমর্থন করে ১৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৮৩) তারিখে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ঢাকার ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের ফলে এক ছাত্র নিহত এবং ৩৭ জন আহত হয় (দি গার্ডিয়ান, লন্ডন, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত ছাত্রের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আপনি শহীদদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘এই রক্তপাত আমি বৃথা যেতে দেব না।’ ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩০ জন নেতাকর্মীসহ আপনাকে গ্রেফতার করা হলে, চোখ বেঁধে ভয় দেখানো, হুমকি দেয়া হলেও আপনি বলেছিলেন, ‘আমি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাব।’ ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে আপনিই স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যুগোপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। ১৯৮৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর জনসভার মাধ্যমে ২১ ও ২৩ ডিসেম্বর সর্বাত্মক ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। ১৯৮৫ সালের ৩ মার্চ আপনাকে গৃহবন্দী করা হয় এবং ২৫ মে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৮৬ সালে কৌশলগত কারণে আপনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন, যা বঙ্গবন্ধুর ১৯৭০-এ নির্বাচনে যোগদানের মতোই। ১৯৮৬ সালে বিদেশী সাংবাদিকদের উদ্দেশে আপনি বলেছিলেন, ‘আমাদের হাতে যখন অস্ত্র নেই, তখন আমরা কেবল ব্যালট বাক্সের সাহায্য নিতে পারি। আমরা জানি, আমাদের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সফল হবেই। (ইন্ডিয়া-টু-ডে, ১৫ মে ১৯৮৬)। নির্বাচনী ফলাফল আপনার কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি। এ প্রসঙ্গে আপনার বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আমরা ২৫০টি আসনে জয়ী হতাম। ভোট কারচুপির পরেও আমি নির্বাচনে যোগদানের জন্য অনুতপ্ত নই।’ নির্বাচনে যোগদান করে আমরা এরশাদের মুখোশ খুলে দিয়েছি। সে একজন ঠগ, মিথ্যুক ও ভোট ডাকাত- সবাই তখন তার আসল চেহারা দেখেছে, ‘(দি সানডে টাইমস, লন্ডন, ১ মে ১৯৮৬)।’ ১৯৮৭ সালের (সম্ভবত ১৬ আগস্ট) ৭ অক্টোবর ঢাকা অবরোধের ঘোষণা দিলেই জেনারেল এরশাদের ভিত কেঁপে ওঠে। ১৯৮৮ সালের নির্বাচন বয়কট ভারত বর্ষের স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৮৯ সালে নয়াদিল্লীতে প-িত জওহরলাল নেহরুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সাংবিধানিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের হারানো অধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার ঘোষণা আপনি দিয়েছিলেন। ১৯৯০-এর ৬ নবেম্বর পান্থপথের ঐতিহাসিক জনসভায় বক্তৃতা দানকালে জেনারেল এরশাদের পদত্যাগের পথ বাতলিয়ে দেন। তার পরেও জেনারেল এরশাদ অত্যাচারের রোলার চালাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। ৬ নবেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর, ২৮ দিনের মাথায় পদত্যাগে বাধ্য হন। উন্নয়নের যে রাস্তায় আপনি আমাদের এখন দাঁড় করিয়েছেন, যে গতিতে সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন অব্যাহত আছে তার চালিকাশক্তি হিসেবে আপনার অপরিহার্যতা আমাদের গভীর প্রত্যাশা। এখন জাতির কাছে স্বীকৃত আপনার নেতৃত্ব। আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। লেখক : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×