ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় এম আর খান

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৮ নভেম্বর ২০১৬

বিদায় এম আর খান

বাংলাদেশের শিশু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ এম আর খান আর নেই। শনিবার অপরাহ্ণ ৪টা ২৫ মিনিটে রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে ৮৯ বছর বয়সে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বেশ কিছুদিন থেকে তিনি বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। পরিণত বয়সে হলেও তাঁর মৃত্যুতে দেশের চিকিৎসা অঙ্গনসহ অগণিত হিতাকাক্সক্ষী ও শুভানুধ্যায়ীর মধ্যে নেমে এসেছে অপার শোকের ছায়া। এর অবশ্য যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। সদালাপি, মিষ্টভাষী ও বিনয়ী প্রফেসর এম আর খান স্বয়ং ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান, স্বমহিমায় সুউচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত, সমুজ্জ্বল। দেশে প্রথম প্রজন্মের এমন কোন ডাক্তার, বিশেষ করে শিশু চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ নেই, যিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাঁর ছাত্র অথবা অনুপ্রাণিত হননি। মৃদু হেসে সম্ভাষণ জানিয়ে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে তিনি অপার স্নেহ ও ভালবাসায় কাছে টেনে নিতেন, প্রয়োজনীয় সুপরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিতেন। তাঁর দ্বারা কোন না কোনভাবে উপকৃত হয়নি, এমন মানুষ বিরল। সর্বোপরি দেশের অগণিত মা ও শিশুর জন্য তিনি ছিলেন এক অকৃত্রিম বরাভয়। অসুস্থ শিশুর আরোগ্যে তাঁর ভূমিকা ও অবদান ছিল ‘ধন্বত্বরির’ মতো। আর এর জন্যই প্রফেসর ডাঃ এম আর খানকে বলা হয় শিশু চিকিৎসার পথিকৃৎ ও প্রতিষ্ঠাতা- ‘ফাদার অব পেডিয়াট্রিশিয়ান এ্যান্ড ইনস্টিটিউশন।’ দেশের আরেক প্রখ্যাত চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডাঃ নূরুল ইসলামের সহায়তায় তিনি তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল) সর্বপ্রথম গড়ে তোলেন শিশু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিভাগ। আর এরপর থেকেই দেশে শিশু চিকিৎসায় ব্যাপক প্রসার এবং শিশু চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ সৃষ্টি হতে থাকে। বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ যে মা ও শিশু মৃত্যুর হার প্রতিরোধে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে, তার মূলে জাতীয় অধ্যাপক এম আর খানের অবদান অস্বীকার করা যাবে না কিছুতেই। এর জন্য তিনি দেশের চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তবে দীর্ঘ জীবনব্যাপী তাঁর এই নিরন্তর পথচলা এবং সাফল্য অর্জন মোটেও সহজ ও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। ১৯৫২ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে তিনি ব্রিটেনের এডিনবার্গ স্কুল অব মেডিসিনে ভর্তি হন। অতঃপর সেখানেই উচ্চশিক্ষা এবং শিশু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাশাস্ত্রে এমআরসিপি এবং এফআরসিপি অর্জন করেন। তবে শুধু ডিগ্রী অর্জনই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না কখনই। বরং তিনি ছিলেন শিশু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন নামী-দামী হাসপাতালে তিনি রেজিস্ট্রারের গুরু দায়িত্ব পালন করেন। বিদেশে থেকে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশমাতৃকার টানে ফিরে আসেন ১৯৬২ সালে। তারপর যখন যেখানেই কর্মরত ছিলেন, গড়ে তুলেছেন একের পর এক চিকিৎসা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিমিত্ত। ঐতিহ্যসম্মত ব্রিটিশ ক্লিনিক্যাল ডায়াগনসিসসহ রোগ নিরাময়ে তিনি ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য। আর তাঁর অগণিত ছাত্রকেও শিখিয়েছেন আন্তরিকভাবে। ১৯৮৮ সালে অবসর গ্রহণ করে পেনশনের টাকায় গড়ে তোলেন ডাঃ এম আর খান-আনোয়ারা ট্রাস্ট, শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন, শিশু হাসপাতাল, নার্সিং ইনস্টিটিউট, সেন্ট্রাল হাসপাতাল ইত্যাদি। দুস্থ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, তাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে এই ট্রাস্টের মাধ্যমে তিনি কাজ করে গেছেন নিরন্তর। শিক্ষা, চিকিৎসা, শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষা, দুর্গত অসহায় মানুষের সেবাসহ সমাজকল্যাণমূলক নানা কাজে প্রফেসর ডাঃ এম আর খানের অবদান অসামান্য। তাঁর মৃত্যুতে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হলো, যা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। আমরা জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডাঃ এম আর খানের মৃত্যুতে স্বজনদের জানাই গভীর শোক ও সমবেদনা। তাঁর মতো অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে বিরল। অতঃপর তাঁর আরাধ্য কাজ, বিশেষ করে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তাঁর অর্জনগুলোকে অনুসারীরা আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে বলেই প্রত্যাশা। আর এর মাধ্যমেই তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল।
×