ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খোকন তালুকদার

সৌন্দর্য বাহ্যিক না অভ্যন্তরীণ

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ৭ নভেম্বর ২০১৬

সৌন্দর্য  বাহ্যিক না অভ্যন্তরীণ

আমাদের চিন্তা, চেতনা আর বুদ্ধিমত্তা কি অনুমতি দেয় সবসময় সঠিক ধারণা পোষণ করতে? যুগ যুগ ধরে সমগ্র বিশ্বে এমনটিই প্রচলিত হয়ে আসছে যা মোটেও কাম্য নয়। সৌন্দর্যের পুরো ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে তাই এর সংজ্ঞাও ভিন্ন। সৌন্দর্যের রূপ কী? সৌন্দর্যের অনেক রকম রূপ রয়েছে। পৃথিবীতে সকলেই তাদের নিজ নিজ সৌন্দর্য, গুণাবলী ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে একজন অন্যজন থেকে আলাদা। বাহ্যিক সৌন্দর্যের তাই কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা বা আদর্শ মানদণ্ড নেই। ব্যক্তি ও তাদের প্রয়োজনের খাতিরে সবকিছু সদা পরিবর্তিত হয়। সবার চোখে কিংবা মস্তিষ্কে একই রকম জিনিস সুন্দর মনে হবে তা কিন্তু নয়। আমি যেভাবে এর ব্যাখ্যা দেব আপনি হয়ত তার সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন আবার আপনার চিন্তার সঙ্গে অন্যের চিন্তা নাও মিলতে পারে। একেক জনের চোখে তাই সৌন্দর্য একেক রকম। যেমন, আমরা তথা এশীয়-দক্ষিণ এশীয় যারা আছি আমাদের কাছে বাহ্যিক সৌন্দর্য বা সৌন্দর্য মানে হচ্ছে ফর্সা ত্বক। এখনও পুরো জনসংখ্যার একাংশ মানুষ এমনটাই বিশ্বাস করে-চেহারা, উচ্চতা, চলন-বলন যেমনই হোক না কেন, এখনও অনেক শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী, আত্ম-প্রত্যয়ী নারীদের মনেও কোথাও কোথাও যেন ফর্সা হওয়ার বাসনা থেকেই যায় যা খুবই দুঃখজনক হলেও সত্যি। এর কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। আমাদের দেশে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের এমনভাবে বেড়ে উঠানো হয়। তাদের মনে বদ্ধমূল ধারণা গড়ে উঠে যে সেহেতু আর গায়ের রঙ ফর্সা নয় আর মানে তিনি সুন্দরী নন। অপরপক্ষে পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বরং তারা সান-বাথ করে নিজেদের রংকে শ্যামলা করতে বেশি পছন্দ করছে। অন্য যে কোন দিক যেমন ফ্যাশন, কালচার এসব ক্ষেত্রে আমরা পশ্চিমাদের সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তাহলে এদিক দিয়ে কেন আমরা পিছিয়ে? এটা হচ্ছে সৌন্দর্যের ভৌগোলিক তারতম্য। যা প্রমাণ করে ফর্সা বা কালো ত্বক কখনোই সৌন্দর্যের পথে বাধা হতে পারে না। তবে কেন যুগ যুগ ধরে ফর্সা-কালো রংকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমরা আমাদের ব্যক্তিত্ব, নৈতিকতা কিংবা মানসিকতার নিম্ন স্তরকে প্রদর্শন করে চলেছি। বাস্তবিক রূপে যা সম্পূর্ণ অমূলক ও ভিত্তিহীন। ঠিক তেমনিভাবে গায়ের রঙের সঙ্গে ছোট চোখ, বোচা নাক, মোটা বা পাতলা ঠোঁট, সোজা বা কোঁকড়া চুল, লম্বা কিংবা খাটো, মোটা বা পাতলা দৈহিক গড়ন আপনার সৌন্দর্যের অন্তরায় নয়। এবার নিশ্চয়ই আপনারা সকলে আমার সঙ্গে একমত হবেন যে আপাত দৃষ্টিতে মনে হলও সত্যিকার অর্থে সৌন্দর্যের সঙ্গে গায়ের রঙের তথা অন্যান্য শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কোন সম্পর্ক নেই। আসলে সত্যি তো এটাই যে সৌন্দর্যকে এসব ক্ষণস্থায়ী (রূপ, যৌবন, বয়স) বিষয়াদির আদলে বাধা যায় না বরং সৌন্দর্য বলতে আপনার ব্যক্তিত্ব, মনুষ্যত্ব, আত্মবিশ্বাস, পরোপকারী মনোভাব এবং নিজের প্রতি ও অন্যের প্রতি আপনার ভালবাসাকেই বোঝায়। তাই যাদের মনে নিজেদের গায়ের রং বা চেহারার খুঁত নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল আজ- এখন থেকে তার সমূল উৎপাটনের কাজ শুরু করে দিন। আপনার চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করে নিন। কেননা সৌন্দর্যের অনুভব আমাদের দেখার দৃষ্টিতে, আমাদের হৃদয়ে আর সর্বোপরি আমাদের মস্তিষ্কে। মানসিক সম্প্রতি চালানো একটা গবেষণায় উঠে এসেছে যে সৌন্দর্য আসলে মানসিক ব্যাপার। বিউটি জগতের স্বনামধন্য ব্র্যান্ড ‘ডাভ’ দ্বারা পরিচালিত একটা জরিপে এমনটিই প্রকশিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের এবং বিভিন্ন বয়সের প্রায় ২ হাজার মহিলার উপর ডক্টর এ্যান কিয়ারনী কুকের তত্ত্বাবধানে এ জরিপটি চালানো হয়। ডক্টর এ্যান কিয়ারনী কুক একজন বিখ্যাত সাইকোলজিস্ট ও বডি ইমেজ এক্সপার্ট। যিনি বিগত ৩০ বছর ধরে মহিলাদের উপর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক এ গবেষণায় তিনি মহিলাদের ‘বিউটি প্যাচ’ সম্পর্কে জ্ঞাত করেন এবং গবেষণায় অংশ গ্রহণকারী নারীদের সবার বাহু তে সাদা, গোলাকৃতির একটা বস্তু আটকে দেন যাকে তিনি ‘বিউটি প্যাচ’ বলেছেন। এই প্যাচের সঙ্গে ঐ মহিলাদের কিছুদিন থাকতে বলেন এবং এরপরে তার সঙ্গে পুনরায় দেখা করতে বললেন। নির্দিষ্ট দিন শেষে প্রত্যেকেই তার সঙ্গে দেখা করলেন এবং বেশিরভাগ মহিলা জানালেন যে তারা ‘বিউটি প্যাচ’ লাগানোর পরেরদিন থেকেই বিশেষ কিছু অনুভব করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, তাদের ক্লান্তি কমে গেছে। কারও আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। কারও কারও ত্বকের সমস্যা দূর হয়েছে এবং আরও অনেক কিছু। অবশেষে ডক্টর এ্যান তাদের তথাকথিত বিউটি প্যাচের একটি প্যাকেট দিলেন এবং দেখতে বললেন। প্যাক এর উলটো দিকে লেখা ছিল ‘কিছুই না’। তিনি যখন সবাইকে ব্যপারটি বুঝিয়ে বললেন তখন এটাই স্পষ্ট হলো যে সৌন্দর্য এক ধরনের মানসিক অনুভূতি। যখন আপনি নিজের মন থেকে বিশ্বাস করবেন ও মেনে নিতে শুরু করবেন যে আপনি সুন্দর তখন সমগ্র পৃথিবীর চোখেই আপনি সুন্দর। তবে দুঃখের কথা এটাই যে মাত্র ৪% নারী এমনটি বিশ্বাস করে থাকেন। বাকিরা নিজেদের অসুন্দরভাবে কিংবা নিজের সৌন্দর্য আবিষ্কারে ব্যর্থই থেকে যান। প্রতিনিয়তই আমরা নিজেদের নিয়ে চিন্তিত থাকি, চেহারার কোথায় কী খুঁত রয়েছে তা খুঁজে বেড়াই আর অন্যের রূপ দেখে ঈর্ষান্বিত হই। যার কোনটাই সমীচীন নয়। দুশ্চিন্তা না করে আয়নায় দাঁড়িয়ে আপনার আপনাকে নতুন করে মিলিয়ে নিন। রোজ সকালে ঘুম থেকে জেগে সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করুন আর আয়নার নিজেকে দেখে বলুন ‘বাহ! তুমি তো অনেক সুন্দর। তোমার নিজের মতো করে সুন্দর’। তাহলেই আর ছোট-খাট খুঁতগুলো আপনার সৌন্দর্যের চেয়ে বড় রূপে আপনার নজরে আসবে না বরং তা আপনার সৌন্দর্যে যোগ করতে পারে নতুন মাত্রা যা আপনাকেই খুঁজে নিতে হবে। এতদিন ধরে নিজের যে খুঁতকে লুকানোর চেষ্টা করে চলেছেন আজ থেকে তার বদলে নিজের ভাল দিকটিকে সবার সামনে তুলে ধরুন আর অন্যদেরও এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে তুলুন। দেখবেন এতদিন ধরে জেনে আসা আপনার সৌন্দর্যের সংজ্ঞা আপনি নিজেই পাল্টে দিয়েছেন।
×