ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কলাপাড়ায় নির্মিত হয়েছে ৬০ আশ্রয়কেন্দ্র

দুর্যোগ ঝুঁকি অর্ধেক কমেছে

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ৭ নভেম্বর ২০১৬

দুর্যোগ ঝুঁকি অর্ধেক কমেছে

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ৬ নবেম্বর ॥ ষাটোর্ধ শাহজাহান মিয়ার বাড়ি বড় বালিয়াতলী গ্রামে। ২০০৭ সালের প্রকৃতির বুলডোজার খ্যাত সুপার সাইক্লোন সিডরের কথা আজও এ মানুষটি ভুলতে পারেননি। আশ্রয়কেন্দ্র অনেক দূরে থাকায় সবাইকে নিয়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে এ মানুষটি বাড়ির দেড়তলা টিনশেড ঘরটিতেই ছিলেন। কোনমতে রক্ষা পেয়েছেন। তবে ঘরটি কাত হয়ে যায়। এ মানুষটি এখন ঘূর্ণিঝড়কালীন আশ্রয় নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত। পাঁচ মিনিটের পথ পেরিয়ে যেতে পারেন এমন কাছে দুটি বহুতল আধুনিক বহুমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাম আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। বড় বালিয়াতলী গ্রাম ছাড়াও আশপাশের অন্তত তিন হাজার মানুষের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ রয়েছে। একই মন্তব্য লেমুপাড়া আদর্শ গ্রামের নুর আলমের। সিডরে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে। লালুয়ার দুর্যোগ ঝুঁকিতে বাস করা গ্রামের মানুষ বানতিপাড়ায় সিডর-আইলায় যাদের ভাসতে হয়েছে জলোচ্ছ্বাসে। অস্বাভাবিক জোয়ার যাদের নিত্য দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। সিডরে এসব মানুষ হারিয়েছে কয়েকটি তরতাজা প্রাণ। তাদের এলাকায় নির্মিত হয়েছে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে একটি আধুনিক বহুমুখী ব্যবহারের আশ্রয়কেন্দ্র, যেটিতে পরিচালিত হচ্ছে একটি মাদ্রাসা শিক্ষার কার্যক্রম। এলাকার শিক্ষানুরাগী মিয়া মোহাম্মদ চান খান জানান, তাদের এলাকার মানুষ এখন দুর্যোগকালীন ঝুঁকি থেকে মুক্ত। ইসলামপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কালীনাথ হালদার জানালেন, সিডরের সময় কোন আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় তিনিসহ এখানকার তিনটি গ্রামের মানুষ চরম ঝুঁকি নিয়ে বাড়িঘরে অবস্থান করেন। তার ঘরটিও বিধ্বস্ত হয়েছিল। এখন বহুতল একটি আধুনিক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে শিশু শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করছে। এছাড়া ইসলামপুর, নেয়ামতপুর, ছলিমপুরের মানুষ দূর্যোগকালে নিরাপদ আশ্রয় নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। গৈয়াতলা গ্রামসংলগ্ন বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে জলোচ্ছ্বাসে দুই শিশুর প্রাণহানি ঘটেছিল। নীলগঞ্জ ইউনিয়নে তখন মোট আটজনের প্রাণহানি ঘটে। সিডরের তা-বে মানুষ চরম বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল। তখন কোন আশ্রয়কেন্দ্র ছিল না। বর্তমানে সেখানে দক্ষিণ গৈয়াতলা স্কুল কাম বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এভাবে চাকামইয়ার কাছিমখালী গ্রামে একটি বহুতল আধুনিক আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। চরচাপলী গ্রামটিতে সবচেয়ে ঘনবসতি মানুষের বসবাস। সাগরের কোলঘেঁষে গ্রামটি। এখানে মাত্র একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন ছিল। ছিল জরাজীর্ণ একটি আশ্রয়কেন্দ্র। সিডরে সেখানকার তিনজন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ আশ্রয়ের সঙ্কুলান হতো না। বর্তমানে একটি আধুনিক সাইক্লোন শেল্টার করেছে এলজিইডি বিভাগ। মোটকথা সিডরের সময় এ জনপদের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ মানুষেরও নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার মতো কোন সুযোগ ছিল না। ভয়াল ওই সিডর কলাপাড়ার ৯৪ জন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। এখনও নিখোঁজ রয়েছে সাত জেলে। উপজেলা প্রশাসনের সক্ষমতা ছিল না সকল মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ের সুযোগ সৃষ্টির। কিন্তু সিডরপরবর্তী সময় সাগরপারের দুর্যোগের গ্রাসে থাকা জনপদে সরকারীভাবে এবং বেসরকারী বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা দুর্যোগকালীন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মানের কাজ শুরু করে। জানা গেছে, স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিইডি) কলাপাড়ায় ১২টি স্কুল কাম আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। আরও পাঁচটির নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া আরও নয়টি নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দুটি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। আরও তিনটির কাজ চলমান রয়েছে। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর ১০টি স্কুল, পাঁচটি মাদ্রাসা ও তিনটি কলেজ কাম আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। এছাড়া বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন একটি নতুন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। মেরামত করেছে ১১টি। আমেরিকান নৌবাহিনী করেছে তিনটি। কারিতাস নির্মাণ করেছে আধুনিক বহুমুখী সুবিধাসংবলিত আটটি আশ্রয়কেন্দ্র, যেখানে একেকটিতে দুই সহস্রাধিক মানুষের দুর্যোগকালে আশ্রয় নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও ফায়েল খায়ের প্রতিষ্ঠান তিনটি এবং হীড বাংলাদেশ একাধিক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। মোটকথা কলাপাড়ায় অন্তত ৬০টি নতুন আশ্রয়কেন্দ্র সিডরের পর নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণাধীন রয়েছে আরও আটটি। পরিকল্পনা চূড়ান্ত রয়েছে অন্তত আরও ১০টির। এছাড়াও পর্যটন এলাকা কুয়াকাটায় আধুনিকমানের বিভিন্ন পর্যায়ের অর্ধশত বহুতল স্থাপনা রয়েছে, যেখানে দূর্যোগকালে মানুষ আশ্রয়ের সুযোগ পাচ্ছে। রয়েছে সরকারী-বেসরকারী অফিস ভবন। পাকা-আধা পাকা বাড়িঘর। মোটকথা কলাপাড়ার প্রায় তিন লাখ মানুষের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর এখন দুর্যোগকালে নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ফলে।
×